বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
মিছিলগুলো একে একে এসে জড়ো হচ্ছিল রুবি মোড়ে। বাঁধ-ভাঙা জলের মতো মানুষের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে চৌরাস্তা। দলে দলে মহিলারা আসছে বিভিন্ন দিক থেকে। আট থেকে আশি ঘর-গৃহস্থালি-কাজ ফেলে যোগ দিচ্ছে মিছিলে। কেউ কাউকে ডাকছে না। জোর-জুলুমও করছে না কেউ। বধ্যবাধকতায় বাধ্য নয় কেউ। হুমকদারি পালন করছে না কেউ। প্রাণের টানে নয়, প্রাণের দায়ে যেন আবালবৃদ্ধবনিতা মিশে যাচ্ছে জনস্রোতে। ঘৃণায়, ক্ষোভে, রাগে জারিত হতে হতে তারা হয়ে উঠছে মিছিলের মুখ। কবি সুকান্তের মতো তারা যেন বলতে চাইছে “আমি নিমগ্ন তাই দোলে মিছিল।” তাদের কারো হাতে জলন্ত মোমবাতি। গলায় ঝোলানো পোস্টার। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আকাশে তুলে “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” স্লোগানে মুখরিত করে তুলছে আকাশ-বাতাস। শুধু রুবি মোড়ে নয়, স্বতস্ফূর্ত এই প্রতিবাদে গত একমাস ধরে সাগর থেকে পাহাড়, পাহাড় থেকে সমতল আন্দোলিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মৃত এবং নির্যাতিতা কন্যার বিচার চেয়ে প্রতিবাদ আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে। বোরখা পরা মুসলিম মহিলা থেকে শুরু করে রিকশা চালক, কলকারখানা কাজ করা মেহনতি মানুষ, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, গায়েগতরে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ, ডাক্তার-উকিল-শিক্ষক সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ বিচার চেয়ে পথে নামছে প্রতিদিন। রঙ-তুলির টানে শিল্পী ফুটিয়ে তুলছেন প্রতিবাদের অন্য ভাষ্য। গায়কের কন্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে প্রতিরোধের গান। সৃজনশীল মানুষ পুরষ্কার ফিরিয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে মাইলের পর মাইল মানববন্ধনে সামিল হচ্ছে মানুষ। স্বাধীনতার পর এরকম জনজাগরণ শুধু এ রাজ্যে নয়, সারা দেশেও ঘটেছে বলে কেউ বলতে পারবে না। এখন প্রশ্ন হল, এই দ্রোহের অন্তর্দাহ কি আরজিকরের নৃশংস ঘটনার মধ্যে নিহিত আছে? নাকি দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, দুঃখ, যন্ত্রণা, ঘৃণা, হতাশার বারুদে তিলোত্তমার মৃত্যু স্ফুলিঙ্গের কাজ করল?
আর জি কর মেডিকেল কলেজের পড়ুয়া ডাক্তারের ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে ১৪ অগাস্ট রাত দখলের ডাক দিয়েছিল গুটিকয়েক মানুষ। প্রাক স্বাধীনতা দিবসে কলকাতার মাত্র তিনটি জায়গায় মূলত মেয়েরা “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” স্লোগান দিয়ে রাত দখলের ডাক দিয়েছিল। সেই ডাক কলকাতার চৌহদ্দি পেরিয়ে জেলাগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই রাতে। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় রাত দখলের কর্মসূচি পালনে অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে। অচিরেই এই আন্দোলনের ঢেউ দেশের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিদেশের মাটিতে। তারপর গত একমাস ধরে তিলোত্তমার বিচার চেয়ে সাধারণ মানুষ আন্দোলনের আগুনকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছে তা অভূতপূর্ব। হাসপাতালের সেমিনার রুমে কর্তব্যরত ডাক্তার ছাত্রীর নির্যাতন ও খুন এবং তারপরে কলকাতা পুলিশের সহযোগিতায় প্রমাণ লোপাটের সরকারি আয়োজন সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। মানুষের কাছে এই বার্তা পৌঁছাতে দেরি হয়নি যে, কলকাতা শহরের মেডিকেল কলেজের সেমিনার রুমে যদি একজন ডাক্তারকে নিরাপত্তা দিতে সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে মফস্বল শহর বা প্রত্যন্ত গ্রামে মেয়েরা কিভাবে নিরাপত্তা পাবে? এর সঙ্গে সরকারের প্রমাণ লোপাট করার মরিয়া চেষ্টা মানুষকে আরো বেশি ক্ষুদ্ধ করে তোলে। তবে মানুষের বিক্ষোভ-প্রতিবাদের পেছনে দীর্ঘদিনের রাগ-ঘৃণা-হতাশাও যে সমানভাবে সক্রিয় একথা অস্বীকার করার উপায়। এই সরকারের দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, জুলুমবাজি, দারিদ্র, স্বৈরাচার সহ্য করতে করতে মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে বলেই আজ এই দ্রোহকাল সমাগত। মানুষ এই যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ চাইছে। তবে সব সামাজিক আন্দোলন শেষমেশ একটি রাজনৈতিক অবিভাকত্ব চায়। সেই অবিভাবকত্বের ভূমিকায় বামপন্থীদের অবতীর্ণ হতে হবে। নাহলে রাজনীতির বাইনারির ঘোলাজলে চরম দক্ষিণপন্থীরা আখের গুছিয়ে নেবে। শ্রমজীবী মানুষের জীর্ণ জীবনে প্রতিবাদের ভাষা দেওয়ার জন্য বামপন্থীদের এগিয়ে যেতে হবে।