বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

সরকার কি দায় এড়িয়ে যেতে পারে?

সরকার কি দায় এড়িয়ে যেতে পারে?

কমল দাশ

photo

১৫ অক্টোবর। বিকেল সাড়ে চারটে। ধর্মতলা মোড়। মেট্রোরেলের দু’ নম্বর গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে ডানদিকে ঘুরতেই এক অবাক দৃশ্য চোখে পড়ল। একজন বয়স্ক মানুষ ডানহাতে একটি লাঠি মুষ্টিবদ্ধ করে উপরে তুলে “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” বলতে বলতে একা একা ফুটপাত ধরে জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন মঞ্চের দিকে এগিয়ে চলেছেন। কাছে এগিয়ে গিয়ে, জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোথা থেকে আসছেন? মাথাটা ঈষৎ ঘুরিয়ে বললেন, উত্তরপাড়া।
আমি আবার একটু নিচু হয়ে জানতে চাইলাম, আপনি এখানে কেন এসেছেন?
- বিচার চাইতে।
- কার কাছে বিচার চাইছেন?
- সরকারের কাছে। মমতার কাছে।

কথা বলতে বলতে তিনি আগত হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেলেন। ধর্মতলা চত্বরে তখন দ্রোহকাল সমাগত। জন সমুদ্রে যেন জোয়ার নেমেছে। ডোরিনা ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করলে শুধু অগণিত কালো কালো মাথা চোখে পড়ে। মানুষের দৃপ্ত স্লোগানে মুখরিত জনপদ। জন জোয়ারে উন্মথিত রাজপথ। বিচিত্র স্লোগান আর শঙ্খধ্বনিতে কল্লোলিত কল্লোলিনী। লক্ষ মানুষের প্রতিস্পর্ধী কন্ঠ আওয়াজ তুলেছে – ন্যায় বিচার। এ এক অভূতপূর্ব জনজাগরণ। শুধু ১৫ অক্টোবরের দ্রোহের কার্নিভাল বা মানববন্ধন নয় – আর জি করের চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ-খুনের প্রতিবাদে ৯ অগাস্ট থেকে সারা রাজ্য এবং দেশ জুড়ে যে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন। দলমত নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। ভয়কে জয় করে, শাসকের শাসানিকে উপেক্ষা করে, সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ সুবিচার চেয়ে আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছেন। জুনিয়ার ডাক্তরদের লালবাজার অভিযান, স্বাস্থ্যভবনে অবস্থান, শেষে ১৭ দিনের অনশন। দীর্ঘ অনশনের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে লাইভ স্ট্রিমিংয়ে বৈঠক।

এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জুনিয়র চিকিৎসকরা তাদের দশ দফা দাবির কতটা আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন, তার উত্তর সময় দিতে পারবে। তবে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে সেদিনের বৈঠকে বঙ্গবাসী যা দেখতে পেলেন তাকে হুমকি সংস্কৃতির রাষ্ট্রীয়করণ বলা যেতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী এবং জুনিয়র ডাক্তারদের সভায় সরকারের দ্বিতীয় কোনও মন্ত্রী ছিলেন না। একটি নৃশংস অপরাধ এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও হুমকির সংস্কৃতির প্রতিবাদে গড়ে ওঠা এক ব্যাপক সামাজিক আন্দোলনের সমাধানসূত্র খোঁজার বৈঠকে, আমলাদের মাঝখানে রেখে, মুখ্যমন্ত্রী সভা করলেন। সভা দেখে মনে হল, গণতন্ত্র বিষয়টি দূর্গা প্রতিমার সঙ্গে নিরঞ্জন গিয়ে আর ফিরে আসেনি। ৫৮০ জন জুনিয়র চিকিৎসকের তালিকা সম্বলিত কাগজ নাড়িয়ে মাননীয়া যে নিদান দিলেন তাতো শুধু হুমকি সংস্কৃতির নামান্তর নয়, আধিপত্যবাদের দ্যোতকও বটে। ‘অভিযোগ’ এবং ‘অভিযুক্ত’ শব্দদ্বয়ের ব্যুৎপত্তিগত নিষ্পত্তিও মানতে নারাজ তিনি। বরং বুঝিয়ে দিলেন শব্দের ব্যকরণগত অর্থের ওপরও খোদকারি করার ক্ষমতা তাঁর আছে। তিনি যা বললেন, সেটাকেই ধ্রুব সত্য হিসেবে মেনে নিতে হবে।

তবে এই আধিপত্যের অন্ধকার ভেদ করে, দলীয় রাজনীতির সংশ্রবকে দূরে রেখে, নাগরিক সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত এই আন্দোলন রাজ্য রাজনীতিতে একটা অন্য ভাষ্য রচনা করল। প্রায় শীত ঘুমে চলে যাওয়া বঙ্গবাসীর চেতনাকে জাগ্রত করে “মরা গাঙে বান” ডেকে আনার পেছনে জুনিয়র চিকিৎসকদের লাগাতার সংগ্রাম – এই জাগরণের পিছনে সদর্থক ভূমিকা পালন করেছে। আরজিকর কাণ্ডের পর থেকে তাঁরা যেভাবে লাগাতার অনমনীয় মনোভাব নিয়ে আন্দোলন পরিচালিত করেছেন, তা সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করেছে। তবুও জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলনের অভিমুখ নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর অনালোচিত থেকেই যাচ্ছে।

অবস্থান-বিক্ষোভ বা অনশন মঞ্চ থেকে তাঁরা যে দাবি সনদ সরকারের কাছে তুলে ধরেছেন, তার অন্যতম হল স্বাস্থ্য অধিকর্তা, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা, পুলিশ সুপারের অপসারণ। এখন প্রশ্ন হল, এই অধিকর্তাদের নিয়োগকর্তা কে? নিশ্চয়ই সরকার। তাহলে সরকারি আধিকারিকদের দুষ্কর্মের দায় সরকার কি এড়িয়ে যেতে পারেন? ফলে সরকারের কাছে কৈফিয়ত না চেয়ে, শুধুমাত্র কয়েকজন আধিকারিকের সম্মানজনক পদান্তর ঘটলেই কি একটি দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও পরিকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব? আরজিকর মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক-পড়ুয়ার নিষ্ঠুর লাঞ্ছনা ও খুন এবং প্রমাণ লোপাটের প্রশাসনিক তৎপরতা যে, কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ নয়, প্রাতিষ্ঠানিক চক্রান্তের চক্রব্যূহ, তা অনুধাবন করার জন্য পেশাদার গোয়েন্দা হওয়ার প্রয়োজন হয় না। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সরকারের চরম ঔদাসীন্যের খেসারত একজন সংবেদনশীল তরুণী চিকিৎসককে জীবন দিয়ে দিতে হল। স্বাস্থ্য দপ্তর এবং স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়কে অস্বীকার করে, সরকারের কাছে কৈফিয়ত না চেয়ে, আন্দোলন পরিচালনা অনেকটাই ভাবের ঘরে চুরি করার নামান্তর হয়ে পড়ছে।

আরজি কর সহ রাজ্যের সমস্ত মেডিকেল কলেজগুলিতে যে হুমকি সংস্কৃতির কথা জনমানসে উঠে আসছে তা একদিনে কোনও অসৎ ব্যক্তির প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠেনি। তদন্ত কমিটি এবং আরজি করের স্পেশাল কাউন্সিল সদস্যদের কাছে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত ভয়াবহ। ভয় দেখিয়ে বেআইনিভাবে টাকা তোলা, যৌন নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, জুনিয়র ডাক্তার এবং পড়ুয়াদের ভয় দেখিয়ে বেআইনি মদ কিনতে বাধ্য করা ইত্যাদি কুকর্ম হুমকি সংস্কৃতির পান্ডারা বহু দিন ধরে করে বেড়াত। তদন্তকারীদের কাছে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন যে, হুমকি সংস্কৃতির সদস্যদের কথা না শুনলে কপালে জুটতো মারধোর, যৌন হেনস্তা, এমন কি পরীক্ষায় ফেল করে দেওয়ার হুমকি। ২০২১ সালের পর থেকে লাগাতার আরজিকরে এই হুমকিরাজ চলে আসছে প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের নেতৃত্বে। এইভাবে দীর্ঘদিন ধরে সরকারি বদান্যতার জল সিঞ্চনে মেডিকেল কলেজেগুলিতে হুমকি ও দুর্নীতির বৃষবৃক্ষ ফুলে ফলে পল্লবিত হয়েছে। তাই শুধুমাত্র কয়েকজন আধিকারিকের অপসারণে মেডিকেল কলেজগুলিতে রাতারাতি স্বচ্ছতায় বাতাস প্রবাহিত হবে, এ ভাবনাও অমূলক। সরকার তার দায় কোনও ভাবেই এড়াতে পারে না। তাই জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের অভিমুখ যদি সরকারের সহযোগিতার খাতে প্রবাহিত হয়, তাহলে আন্দোলন তার গতি হারিয়ে কানা গলিতে ঘুরপাক খাবে। কোনও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না।

চলমান গণআন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্বতঃস্ফূর্ততা। সমাজের সর্ব প্রকারের মানুষ প্রাণের টানে, নিজের তাগিদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। বলা ভাল, সামিল হয়েছেন, ডুবন্ত অসহায় মানুষ যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করে সেইভাবে। এক দশকের বেশি সময় ধরে এই রাজ্যে নারীদের উপর লাঞ্ছনা, অত্যাচার, ধর্ষণ বেড়ে চলেছে; শিক্ষা, খাদ্য, আবাস, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি এবং গ্রাম-শহরে সমাজ জীবনের প্রতিটি রন্ধ্রে ত্রাসের আগুনে পুড়তে পুড়তে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী জেলের ঘানি টানছেন। খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসের মত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষের মনে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভে চিকিৎসক তরুণীর হত্যা এবং জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন ঘৃতাহুতি দিয়েছে। জুনিয়র চিকিৎসকরা যেন মানুষের এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের যন্ত্রণাকে উপেক্ষা না করেন। সাধারণ মানুষের দিন যাপনে যে যন্ত্রণার বীজ উপ্ত ছিল তাকে অঙ্কুরিত হওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ দিয়েছে এই আন্দোলন।

এই আন্দোলনে আইটি কর্মী, ক্যাব-ড্রাইভার, গিগ-শ্রমিক, রিক্সা চালক বা সংগঠিত শ্রমিক ও কর্মচারীদের একটি অংশ সামিল হয়েছেন। তবে শহর-গ্রামের সব থেকে বঞ্চিত অসংগঠিত শ্রমজীবী, প্রান্তিক কৃষক, খেতমজুর, দিনমজুরদের ব্যাপততম অংশই এই আন্দোলনের থেকে দূরেই থেকে গেছেন। এই সমস্ত অসহায় শ্রমজীবীদের কাছে আন্দোলনের ভাষা পৌঁছে দিতে না পারলে চলমান আন্দোলন ধীরে ধীরে গতি হারাবে। শাসকরা যেভাবে প্রতিদিন জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেছে - ‘গণশত্রু’ হিসেবে দাগিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন - সেই প্রচার জয়যুক্ত হবে। চিকিৎসক তরুণীর জন্য ন্যায়বিচার থেকে, সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকাঠামোর অভাব, স্বাস্থ্যের জন্য সরকারি বাজেটের অভাব, সরকারি হাসপাতালগুলিতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, হুমকির সংস্কৃতি শুধু নয় হুমকিরাজ, সব কিছুই আড়ালেই চলে যাবে। তাই খেটে খাওয়া অসহায় মানুষদের সঙ্গে এই আন্দোলনের যোগসূত্র জোরালো করতে শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুরদের সংগঠনগুলির সঙ্গে আন্দোলনের যোগসূত্র গড়ে তুলতে হবে - যেতে হবে জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামান্তরে। আন্দোলনের অঙ্কুরকে মহীরুহে পরিণত করার দায়িত্ব জুনিয়র চিকিৎসক, সিনিয়র চিকিৎসক থেকে সমস্ত সংবেদনশীল মানুষের। অভয়া মঞ্চের সংগঠকদের ধন্যবাদ।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.