বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
রাত তখন ৯-৫০। পাড়ায় পাড়ায় স্বাধীনতার উৎসবের মেজাজ। শাসকদলের স্থানীয় অফিসগুলোয় রক্তদান শিবিরের প্ল্যাকার্ড লাগানো… গান বাজছে ... সারে জাহা সে আচ্ছা... রাস্তা জুড়ে আলোর মলা নিয়ে মোড়ে মোড়ে পতাকার দোকানে পতাকা বিক্রি হচ্ছে ... সঙ্গে তেরঙ্গা হাতের ব্যান্ড ... একেবারেই উৎসবের পরিবেশ ... অফিস থেকে ফেরার সময় এসব দেখতে দেখতে মনের মধ্যে কোথাও যেন একটা ছবি আঁকা হয়ে যাচ্ছে ... অন্তত গত ১০ -১২ বারো বছরের অভিজ্ঞতা জানান দিচ্ছিল ... এগারোটায় রাত দখল মানে জনা কয়েক পঞ্চাশোর্ধ আর সামান্য কিছু মাঝবয়সী শ্রমিক কৃষকের রক্তে রাঙানো ঝান্ডা হাতে “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” বলে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে গোল মিটিং করবে অথবা আর একটু বড় করে ভাবতে গিয়ে ভেবে বসলাম হয়তো কিছু মশাল মিছিল হবে। শাসক দলের পোষা মানুষগুলো বাঁকা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে।
রাত তখন ১১-৩০। অফিস ফেরত বাড়িতে এসে স্নান খাওয়া করে প্রচন্ড একটা টান থেকেই কাছেই পাড়ার মোড়ে পৌঁছে যাই। ভাবনার মতোই গুটিগুটি পায়ে তখন সেখানে জমায়েত হতে শুরু করেছে সবে ৪০-৫০ জন মানুষ আরও খানিকটা এগিয়ে গড়িয়া স্টেশন মোড়ে যখন পৌঁছলাম রাত তখন ১১-৫০ কাঁটায়... সেখানে আশপাশের দোকানের আলো নিভে গেছে... শাসকদলের স্থানীয় অফিসের ঝাপ বন্ধ ... রক্তদান শিবিরের ম্যারাপের তলায় গুটিকয়েক নারী পুরুষ। আর ব্রিজের নিচে জমায়েত তখন ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। শুরু হল মশাল মিছিল রাত তখন ১১-৫৫। কোনও মাইক ছিল না শুধু শ’পাঁচেক মহিলার কন্ঠে “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” ... সঙ্গে মশালের আগুন রঙা আলো যেন এক নতুন দিনের প্রস্তুতির গল্প শোনাচ্ছিল।
ইচ্ছেটা আরও খানিকটা বেড়ে উঠলো গড়িয়া স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে পা বাড়ানো অটোয় চেপে পৌঁছলাম গড়িয়া মোড়ে। সেখানে একটা মিছিল চলছে মেয়েদের মিছিল। বয়স ৭ থেকে ৭০ ... সবাই হাতে “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” লেখা ধরে চুপ করে হাঁটছে... না, কোনও স্লোগান ছিল না সেই মিছিলে ... একেবারেই মৌন মিছিল। মিছিলের মেয়েদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে যখন গড়িয়া ৫ নম্বর স্ট্যান্ডে পৌঁছলাম সেখানে জমায়েত দেখে চমকে উঠলাম কয়েক হাজার লোক এবং ক্রমাগত লোক আসছে। যে যার নিজের নিজের বাড়ি থেকে, ফ্ল্যাট থেকে, দোকান থেকে, ক্লাব থেকে, পাড়ার মোড়ের চা দোকান থেকে ক্রমাগত লোক আসছে। ওই ভিড়ের মধ্যেই এগুতে পারছিল না একটি বেসরকারি পরিবহনের বাস ... তার ছাদে উঠে পড়ল একদল যুবক ... বুকের মধ্যে জাতীয় পতাকাখানা জড়িয়ে নিয়ে মানুষের সেই মহাসাগর গর্জন করে উঠল ... স্বাধীনতার এক অনন্য মুহূর্ত ছড়িয়ে পড়ছিল ... সময় তখন ঠিক রাত ১২টা।
ওই ভিড়ের মধ্যে দিয়েই পাশ কাটিয়ে ক্রমশ হাঁটতে শুরু করলাম গাঙ্গুলিবাগানের দিকে ... ক্রমাগত পথে একটার পর একটা মিছিল আসতে লাগল ... এবার আর মৌন মিছিল নয়। কন্ঠে একটাই আওয়াজ “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” ... সময় এগিয়ে যায় কথাটি ছড়িয়ে পড়ে একটা তরঙ্গের মতো করে ... সঙ্গে অজস্র মানুষ ... কারো হাতে জাতীয় পতাকা ... কারো হাতে তা নেই ... আবাসন থেকে অজস্র মানুষ নেমে এসেছে ঐ মানুষের সেই মহাসাগরকে স্বাগত জানানোর জন্য...।
পাঁচ নম্বর বাস মোড় থেকে অনেকটা এগিয়ে এসেছি। পিছন ফিরে তাকালাম ... দেখলাম আলোয় আলোয় ভরে গেছে আকাশটা... আটাত্তরে পা রাখা স্বাধীনতার এক ভিন্নতর রূপ ... রাত তখন ১২-৩০ ... পথে আরও মানুষ ... ক্লান্তি নেই ... সুলেখা মোড় পেরিয়ে গেলাম ... রাত প্রায় দেড়টা ... ফেসবুক থেকে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গার লাইভ আসছে ... দেশের এবং অন্যান্য দেশের মেয়েদের রাত দখলের খবরও আসছে ... আচমকাই ভিড়টা নড়ে উঠল ... পুলিশ তাড়া করেছে ... কেন কি বৃত্তান্ত কিছুই বুঝতে পারলাম না ...। বিচার চাওয়ার ভেতরে কি সমস্যা বোঝা গেল না ... তাড়া খাওয়া মানুষের ভেতর থেকেই এক বাইকওয়ালা বললেন ফিরবেন কি? হাতে যেন চাঁদ পেলাম। বাইক চেপেই ফিরে এলাম গড়িয়া স্টেশন। পুরো রাস্তা তখন থমথম করছে। বাইকওয়ালার কাছেই খবর পেলাম কে বা কারা যেন আরজিকর হাসপাতালে প্রবেশ করে ভাঙচুর করেছে। পুলিশকে মেরেছে। বাইকওয়ালা যাবে সুভাষগ্রাম। গড়িয়ায় আমাকে নামিয়ে দিয়েই এগিয়ে গেলেন চালক।
গড়িয়া স্টেশন রেল ব্রিজের জমায়েত যখন ৫০০ থেকে ২০০০ এ পৌঁছে গেছে ... টিমটিম করছে শাসকদলের রক্তদান শিবির ... ঘরে ফিরে এলাম আরও এক বাইকওয়ালার সাহায্যে ... মানুষের মহাসাগর থেকে পাওয়া তেরঙ্গা টাঙিয়ে দিলাম ছাদে। সময় জানিয়ে দিয়েছে, মানুষের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে দুর্বৃত্তরা ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তাই আসুন আমরা আসেপাশের সকলকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি এক নতুন স্বাধীনতার ভোরের।