বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

ফিরে এসো, লাল ফিতে

ফিরে এসো, লাল ফিতে

স্বাতী ভট্টাচার্য

photo

মুর্শিদাবাদের সুতি, শমসেরগঞ্জের দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকার মানুষ বিরোধী নেতাদের কাছে নালিশ করেছেন, তাঁদের উপর যখন আক্রমণ চলছিল, ঘরে আগুন ধরানো হচ্ছিল, তখন থানায় বারবার ফোন করেছিলেন তাঁরা, পুলিশ আসেনি। দশ মিনিটের দূরত্বের গ্রামে পুলিশ এসেছে চার-পাঁচ ঘণ্টা পর। এখন এই গ্রামগুলোতে দাবি উঠেছে, পুলিশে ভরসা নেই, বিএসএফ ক্যাম্প বসাতে হবে। টিভির খবরে ত্রস্ত, ক্রুদ্ধ মানুষগুলির বিএসএফ ক্যাম্প বসানোর দাবি শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল, সীমান্তে খবর করতে গিয়ে বিএসএফ-এর হয়রানি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের কত অভিযোগই না শোনেন সাংবাদিক, সমাজকর্মীরা। উর্দি যেমনই হোক, উর্দিধারী যদি নিজের ডিউটি না করে, নাগরিক অসহায়।
সুতি, শামসেরগঞ্জের থানার ওসিদের সরানো হয়েছে, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। এ সব তদন্তের পরিণাম অজানা নয়। যা আরও অজানা, তা হল পুলিশের ভয়ে পুলিশের কাছে যান না কত লোক। হুগলির এক সাংবাদিক বন্ধু খবর দিলেন, “এখানে ক’দিন আগে বছর চোদ্দোর এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করল। অনলাইনে অর্ডার করে শাড়ি আনিয়েছিল, তাই প্রচণ্ড মারধর করেছিল শ্বশুরবাড়ি। মেয়ের বাবা ভয়ে থানায় অভিযোগ করেননি। তাই আমরাও কিছু লিখতে পারিনি।”
শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হল। এক মুঠি জলে যেমন সারা আকাশ দেখা যায়, তেমনই এক স্বল্পায়ু জীবনে যেন গোটা দেশের পরিস্থিতি প্রতিফলিত হল। এক বালিকার এই পরিণাম রাষ্ট্রের কতগুলি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার সাক্ষ্য দিচ্ছে? স্কুল তার ছাত্রীকে বুনিয়াদি শিক্ষা শেষ করাতে ব্যর্থ, নাবালিকা কন্যার বিয়ে দেওয়া থেকে পরিবারকে নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ কন্যাশ্রী প্রকল্প, স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন নাবালিকা বিবাহের অপরাধ রুখতে ব্যর্থ। গৃহনির্যাতনের শিকার মেয়েদের জন্য সহায়তার যা কিছু ব্যবস্থা রয়েছে নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের, কিছুই পৌঁছয়নি মেয়েটির কাছে। কী করে পৌঁছবে, সব জেলার জন্য একটিমাত্র ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স প্রটেকশন অফিসার বরাদ্দ, তাঁর ঠিকানা-ফোন নম্বরের নাগাল কেউ পায় না। মৃত্যুর পরেও বিচারের আশা নেই — থানা হয় উদাসীন, নয় অত্যাচারী। দাঙ্গায় মৃত্যু থেকে নাবালিকা বিবাহ, প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয়ের বিষময় ফল চারিদিকে।
‘প্রতিষ্ঠান’ তো কেবল একটি দফতর নয়। সংবিধানের নির্দেশ, আইন, বিধিনিষেধ, নানা স্তরের কর্মীদের মধ্যে দায়িত্বের বিন্যাস, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দায়ের বণ্টন, সরকারি কাজে বিরোধীর, নাগরিক সংগঠনের অংশগ্রহণের পরিসরের সুরক্ষা, এ সব কিছুই ‘প্রতিষ্ঠান’ বা ইনস্টিটিউশন-এর ধারণায় ঢুকে রয়েছে। এই সব নিয়ম দিয়ে তৈরি গণতন্ত্রের মন্দির। গণতন্ত্র নামক দেবতাটি বহু কোটি টাকায় নির্মিত সংসদে, বা সাজানো-গোছানো বিধানসভায় বিরাজ করেন না। সেখানে মূর্তিটি থাকে শুধু। গণতন্ত্রের আত্মার অধিষ্ঠান পানের পিক-শোভিত, প্রস্রাবের গন্ধ-মোহিত সরকারি দফতরে, পুলিশ থানায়, ঘুপচি আদালত-কক্ষে, খাড়া সিঁড়ি-বাহিত, লিফটহীন লিগাল এড-এর অফিসে। ফাইলের গোছায় লেখা থাকে সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের সঙ্গে তার নাগরিকের লড়াইয়ের ধারাবিবরণী। পুলিশ-প্রশাসন নড়বড় করে হলেও যতক্ষণ চলে আইন-নির্দিষ্ট পথে, ততক্ষণ গণতন্ত্র সচল থাকে, শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়। ধুলো-ভরা ফাইল থেকে উঠে-আসা প্রাণবায়ু।
এই দফতরগুলো চিরকাল নাগরিকের বিরক্তির কারণ হয়ে থেকেছে। ঘুষের দাবি, হয়রানি তো আছেই, সবার উপরে আছে লাল ফিতে। চিরকাল লোকে পথ খুঁজেছে কী করে দাদা-দিদি ধরে সরকারি ফাইলের দীর্ঘ টেবিল-পরিক্রমাকে শর্ট সার্কিট করা যায়। তার সুযোগ নিয়ে এখন বিধিনিয়ম খারিজ হতে বসেছে। মুখ্যমন্ত্রী প্রায়ই বলেন, ‘ভুল করার অধিকার সকলের আছে।’ নিয়ম মেনে কাজ করতে গিয়ে ভুল হতে পারে। নিয়ম না-মানার ‘ভুল’ করার অধিকার কারও নেই। নিয়ম মানার দায় এড়াতে নিয়মকেই এড়ানোর পরিণাম কী, তা দেখা যাচ্ছে চাকরিহারা শিক্ষকদের মুখে। যে লাল ফিতে চিরকাল এত বিরক্তি, তাচ্ছিল্যের কারণ হয়েছিল, আজ বোঝা যাচ্ছে তার উপযোগিতা। লাল ফিতের ফাঁস প্রতিষ্ঠানকে স্থানচ্যুত হতে দেয়নি। আইনের শাসন বজায় রেখেছে।
লাল ফিতের ফাঁস আলগা হলে কী হয়? মনে হয়, থানা-আদালত, বিডিও অফিস-ডিএম অফিস, শ্রম কমিশনারের অফিস, পঞ্চায়েত-পুরসভা, স্কুল-কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল, সমবায়, এ সবই যেন নানা নায়েব মশাইয়ের দফতর। জমিদারবাবুর ইশারা বুঝে হয় দাঁত খিঁচোবেন, নইলে দেঁতো হাসি হাসবেন। তাই মেয়েদের জন্য রাজ্যের ‘অপরাজিতা আইন’ কিংবা শ্রমিকদের জন্য কেন্দ্রের চারটি শ্রম বিধি, কোনওটাই সাধারণ মানুষের মনে তেমন কোনও কৌতূহল জাগায়নি। তাঁরা জানেন, আইনের শাসন যেখানে নেই, সেখানে আইন তৈরি একটা ভাঁওতা। ক্ষমতাসীনের কথাই শেষ কথা। গণতন্ত্রের ঘোমটার আড়ালে ফ্যাসিবাদের নাচ।
সম্প্রতি শ্রম কোড নিয়ে নাগরিক মঞ্চ-আয়োজিত একটি আলোচনায় দেখা গেল, নতুন আইনের কী কী দোষ, সে প্রশ্নের চাইতেও বড় হয়ে উঠল আর একটি প্রশ্ন, শ্রমিকরা কেন এত নীরব? কেউ বললেন, শ্রমিকদের কাছে এখনও শ্রম কোডের আলোচনা পৌঁছনো যায়নি। কেউ বললেন, শ্রমিক অধিকার ক্ষয়ে ক্ষয়ে এমন অবস্থা, যে বাড়তি নগদ ছাড়া আর কিছুতে আগ্রহী নন শ্রমিকরা। কাজের নিরাপত্তা যেখানে নেই, কাটা পিএফ ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই, সেখানে শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বিমা-পেনশন, আট ঘণ্টার কর্মদিবস, হ্যান পাওনা ত্যান অধিকার নিয়ে রাস্তায় নামবে, এমন আশা করা কঠিন। কথাটা ঠিক, কিন্তু এ প্রশ্নও করা দরকার যে অধিকারের এমন অবক্ষয় হল কী করে? তার পিছিনে কি নেই ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠানটির অবক্ষয়? শ্রমিক কি দেখছেন না যে, ট্রেড ইউনিয়ন লিডাররা মিডিয়ার সামনে গর্জন করেন, আর মালিকদের সামনে মিউ মিউ করেন? পাশাপাশি রয়েছে শ্রম দফতরের বিমুখতা — যা শ্রমিকের অধিকারকে প্রহসনে পরিণত করেছে। রয়েছে শ্রম আদালতের ‘কুমড়ো-কাটা দা’ঠাকুর’ হয়ে ওঠা। ইউনিয়ন নেতা, শ্রম আধিকারিক, লেবার ট্রাইবুনালের অফিসার, সবাই যেন নায়েবতন্ত্রের অংশ।
প্রতিষ্ঠানকে তিল তিল করে মারার অনেক উপায় আছে — বরাদ্দে কার্পণ্য করা, প্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্র্য খর্ব করে সরকারি কর্তাদের শাসন জারি করা, কিংবা ছাত্র সংগঠন, শিক্ষক সংগঠন বা কর্মী সংগঠনের নেতাকে প্রতিষ্ঠানের পদাধিকারীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া। বাম আমলে এই চাপিয়ে দেওয়ার কাজটা হয়েছে কৌশলে, প্রতিষ্ঠানের নিয়মরক্ষা করে সবলের স্বার্থরক্ষা হয়েছে। আর একটি কৌশল সরকারি বিজ্ঞপ্তি — সংবিধান যে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ বা পঞ্চায়েতের মতো প্রতিষ্ঠানকে, একটি সরকারি সার্কুলারে তাকে নাকচ করে
দিয়েছে বহু রাজ্য। তৃণমূল আমলে ‘ফোন কালচার’-এর জোর বেশি। একটি ফোন সরাসরি নস্যাৎ করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের বিধিনিয়মকে। কোনও লিখিত নির্দেশ জারি করার বালাইও নেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রশাসনিক জনসভায় অনেক সময়ে সর্বসমক্ষে পঞ্চায়েতের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাত থেকে কাজের দায়িত্বভার কেড়ে নিয়ে তুলে দিয়েছেন জেলাশাসক বা অপর কোনও সরকারি আধিকারিকের হাতে।
এক বিডিও একবার বলেছিলেন, কী ভাবে মৌখিক নির্দেশে তাঁদের মিড ডে মিল-এর টাকা দিয়ে দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণের মতো খাতে ব্যয় করতে হয়, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। এমন ফোন কত আধিকারিকের কাছে রোজ আসে, জানা কঠিন। এ ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম বানচাল করার ফলে যার জবাবদিহি করার কথা, তার হাত থেকে দায়িত্ব সরে যায়। যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তার জবাবদিহির দায় থাকে না। শিক্ষক নিয়োগ মামলায় স্কুল শিক্ষা কমিশনের কাজের কোনও মাথামুন্ডু পাওয়া যাচ্ছে না, প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিয়মের ধার ধারা হয়নি বলেই। কেবল একটা হতবাক প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে — চেয়ারে-বসা নায়েবরা শিক্ষা দফতরের সব বিধিনিয়ম নস্যাৎ করে এত দিন চালাচ্ছিলেন কী করে? কার নির্দেশে? জনগণের কাছে সেই নির্দেশ অদৃশ্য, দৃশ্যমান শুধু তার ফল। ডানা-কাটা চিল মুখ থুবড়ে পড়লে যেমন বোঝা যায়, চিনে মাঞ্জা লাগানো সুতোর ঘুড়ি কেউ উড়িয়েছিল।
প্রতিষ্ঠান দুর্বল হওয়ার ঝুঁকি নাগরিকও বোঝে। এ রাজ্যে নাগরিকদের আন্দোলনগুলি যদি দেখা যায়, মিড ডে মিল কর্মী, আশা কর্মীদের আন্দোলন, চা বাগানের আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন, সর্বোপরি অভয়া আন্দোলন, তবে দেখা যাবে, এ সব আন্দোলনেরই দাবি, সরকার আইন মানুক। ন্যূনতম মজুরি, পরিবেশ সুরক্ষা, নারী নিরাপত্তার আইন মানা, মানানোর দায় স্বীকার করুক সরকার, সরকারি দফতর, স্কুল-হাসপাতাল। ফাইলের ফিতে যেন না কাটতে পারে ক্ষমতাসীন-আশ্রিত দুর্বৃত্তের কাঁচি। মুশকিল এই যে, নাগরিকের শেষ ভরসা আদালত, আর আদালতেও কোন ঘরে কার ফোন বাজে, তা নিয়ে ধন্দ গাঢ় হচ্ছে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.