বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

পণ্য সংস্কৃতি ভাতের চিন্তা ভুলিয়েছে

পণ্য সংস্কৃতি ভাতের চিন্তা ভুলিয়েছে

অপরূপ চক্রবর্তী

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ এপ্রিল, ২০২২— এ এক সর্বগ্রাসী ঢেউ। যে ঢেউয়ে উথাল পাথাল শ্রমজীবী মানুষের জীবন। দেশটা বিদেশ হয়ে থাক - তেলের দাম বাড়লো কি কমলো, মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যবৃদ্ধি কোনও কিছুরই আঁচ পড়ে না ওদের জীবনে। ওরা কারা? যারা ঘরে ঘরে বাসন মাজেন, দর্জির জোগাড়ের কাজ করেন, ছিলা মেশিনের লেবার, চাষের জমিতে মুনিষ খাটেন, পোটোর সহকারি, কামারশালের হাতুড়ি পেটান, এরকম অযুত কাজের নিযুত শ্রমিকের দল। আমরা যারা বুঝি, বুঝতে চাই, মাথা ঘামাই, মূল্যবৃদ্ধির আঁচে শ্রমজীবী পরিবারগুলো কীভাবে পুড়ছে, আর সে কথা ভেবে উৎকন্ঠিত হয়ে পড়ি, তারা কিন্তু এই ঢেউয়ের অমিত ক্ষমতার পরাক্রম টের পায় কিনা সে বিষয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে। যদিও কোনও পরিসংখ্যানের গোলকধাঁধায় না গিয়ে চোখ কান খুলে চারপাশে দেখলে এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়, যে মোবাইলে রিচার্জ না করলে, ইন্টারনেটে আন্তর্জালে ডুবে থাকতে না পারলে এইসব শ্রমজীবী মানুষ কতটা বিপন্ন বোধ করেন! দিনে-রাতে টিভি না দেখতে পারলে নিজেদের কতটা দীনহীন মনে করেন ওরা! কীরকম?
 
আমার বাড়ির কাজের মেয়েটি সম্প্রতি বেতনের কিছুটা আগাম চাইতে প্রশ্ন করে জানলাম, সে তার দাদার বাড়িতে বাড়তি হয়ে থাকা টিভি সেট আনতে যাচ্ছে। ফিরে এসে একটা টেবিলের জন্য টিভি রাখতে পারছে না বলে তার খেদপর্ব চলছে এখন। কেবল লাইন নেওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। তার ভাড়াবাড়ির বাকি বাসিন্দাদের সকলেরই টিভি ও কেবল লাইন যথারীতি বিদ্যমান। সকলেরই মাসিক আয় ৩/৪ থেকে ৭/৮ হাজার। এই মেয়েটি আবার স্বামী বিচ্ছিন্ন, সঙ্গে দুটি ছোট ছেলে মেয়ে। বাজার যে আগুন কিনিস কী, খাস কী? "আগে হত্যায় ৩ কেজি আলু নিতাম, এখন এক কেজি। সরষের তেল আগে এক লিটার এখন ৩০০/ ৪০০ গ্রাম। মাছ সপ্তায় দু’দিন, সেদ্ধই বেশি খাই।" সে বলে চলেছে আর আমি হাঁ করে শুনছি। বাজারে যারা খুচরো আনাজ মাছ বিক্রি করে, ১০০ দিনের লেবার, রাজমিস্ত্রি, জোগাড়ে, সেলাই করে, বোতাম লাগায়, গেঞ্জির কারখানায় ১২ ঘন্টা কাজ করে ১৮০ টাকা রোজ পায়, যতো জনের সঙ্গে মিশি, কথা বলি সবারই যাপনের রোজনামচা ওই একইরকম। অতিমারিতে কাজ হারিয়ে অনেকেই অন্য পেশায় চলে এসেছে। ভিড় করেছে ১০০ দিনের কাজেও। কিন্তু লিপস্টিক, পাউডার, নেলপালিশ, গন্ধতেল ইত্যাদি প্রসাধনীর পেছনে মেয়েদের খরচ কমেনি। ছেলেরা ফেসবুকে মশগুল। সন্ধ্যেবেলার সিরিয়ালগুলো জীবনদর্শনে ঘা মেরে চলেছে সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালিরও। সেখানে অর্ধ শিক্ষিত প্রায় নিরক্ষর এই শ্রমজীবী সমাজ সেটা রোজ চেটেপুটে খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকে।

শ্রমিকদের মধ্যেও সমান্তরাল দুটি শ্রেণী। হোয়াইট কালার ও ব্ল্যাক কালার। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য অতিমাত্রায় প্রকট। যে শ্রমিক টাটা, বাটা, গোদরেজ প্রভৃতিতে কাজ করেন তাদের সঙ্গে বেলিলিয়াস রোড, জালাল কমপ্লেক্সের শ্রমিকদে মেলবার নয়। কিন্তু পণ্য সংস্কৃতির ঢেউয়ে ওরাও ভেসে চলেছেন। মিল শুধু ওইটুকুই। রাষ্ট্র জানে, শাসকেরা জানে যারা সচেতন তাদের ভোট কম, কারণ সংখ্যায় তারা অগুনতি নন। ভোট বেশি ব্ল্যাক কালার অতিদরিদ্র শ্রমিকশ্রেণীর। কিন্তু না পেয়ে পেয়ে এরা চাইতে ভুলে গেছেন। বিনোদনে ভোলেন এরাই দেশি। এদের সামনে একটা ঝাঁ চকচকে ইউটোপীয় জগৎ তৈরি করে রাখা হয়েছে অতি চতুর পরিকল্পনায়। বাজারে আগুন লাগুক কি কেউ জল ঢালুন তাতে ওদের হুশ ফিরে না। ওরা যে ওই বানানো রমনীয় জগতে মশগুল থেকে পেটের চিন্তা ভুলেছেন। দেখে শুনে মনে হয় "ওরা চাহিতে জানে না দয়াময়"। শাসক ও তো তাই চায়।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.