বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

স্বাধীনতার ৭৫ বছরে বাংলার কৃষকের অবস্থা

স্বাধীনতার ৭৫ বছরে বাংলার কৃষকের অবস্থা

সঞ্জয় পুততুণ্ড

photo

১৯৪৭ সনে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৭৫টি বছর পার হয়েছে। আমাদের রাজ্যও দেশের অন্যতম অঙ্গরাজ্য হিসেবে ৭৫ বছর পার করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা যেমন অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল, তেমনই কৃষক আন্দোলনেও বাংলার গৌরবগাথা ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। স্বাধীনতার প্রাক্কালে অবিভক্ত বাংলায় শুরু হয়েছিল ‘তেভাগা’ আদায়ের জন্য কৃষকদের আন্দোলন। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮-৫০ সনে সংগঠিত হয়েছে তেভাগা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব। যথেষ্ট প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই সেই সময়ে পশ্চিমবাংলার কৃষক লড়াই করেছেন।
সেই সময় লুঠেরা ব্রিটিশ রাজশক্তি বিতাড়িত। তাদের বশংবদ জমিদারকূল অভিভাবক হীন। মানুষের মনে নানা প্রত্যাশা। পশ্চিমবাংলায় ১৯৫৩ সনে জমিদারি অধিগ্রহণ আইন এবং ১৯৫৫ সনে ভূমি সংস্কার আইন প্রণিত হলেও কৃষক জীবনের শোষণ-বঞ্চনার অবসান হয় না।
রাজত্ব বা রাজধানীর টাটকা খবর তখন কৃষকদের কাছে থাকার কথা নয়। দেশের কর্তাদের মধ্যে রফা হয়েছে, ব্রিটিশ রাজশক্তি চলে গেলেও জমিদারকূল অনাথ হবে না। দেশের পুঁজিপতি শ্রেণী তাদের সঙ্গ দেবে। দ্বিখন্ডিত ভারত রাষ্ট্রে জমিদারকূল হল ছোট শরিক। তাই জমিদারি ব্যবস্থার গায়ে মূলত আঘাত আসে না। নতুন আইনে অনেক ফাঁক রাখা হল, থাকল অনেক ছাড়ের ব্যবস্থা। আর থেকে গেল রাষ্ট্র ব্যবস্থার নানা স্তরে জমিদারদের শক্তিশালী প্রভাব। বড় জমিদার কোথাও হাইকোর্টের বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। শাসক দলের নেতা, মন্ত্রী, বিধায়কদের তালিকায় জোতদার পরিবারের সদস্যদের সংখ্যা ছিল বিপুল। সেই কারণে তেভাগা আন্দোলনের দীর্ঘ সময় জুড়ে লড়াইয়ের এলাকাগুলিতে চলেছে প্রবল সন্ত্রাস।
১৯৫২ সনের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পরবর্তী কালে পরিকল্পিত উদ্যোগে কৃষক আন্দোলন আবার শক্তি অর্জন করে। লড়াইয়ের এলাকাগুলিতে প্রবল আক্রমণ চললেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষক আন্দোলন ছোট-বড় জয়লাভ করে। তেভাগার দাবির সঙ্গে কৃষক জীবনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে— হাটে জমিদারদের তোলা আদায়ের বিরুদ্ধে, জমি থেকে বর্গাদারদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে, সেচের দাবিতে আন্দোলন কখনো থেমে থাকেনি।
সেই সময় গভীর খাদ্য সংকটে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হন কৃষক ও ক্ষেতমজুররা। খাদ্যের দাবিতে ও মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই আন্দোলনে স্বভাবতই কৃষক ও ক্ষেতমজুররা ছিলেন সামনের সারিতে। ৩১ অগাস্ট, ১৯৫৯-এ গ্রাম গ্রামান্তর থেকে কৃষকরা কলকাতায় আসেন খাদ্যের দাবিতে, মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের বাড়ি থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিলে পুলিশ বর্বরভাবে লাঠি চালিয়ে ৮০ জনকে খুন করে। সেই দিন পুলিশ একটি গুলিও ব্যবহার করেনি। স্বাধীন রাষ্ট্র ও নির্বাচিত সরকার সম্পর্কে মোহভঙ্গ হতে থাকে। ষাটের দশকের প্রথম ভাগে নানা প্রতিকূলতার কারণে আন্দোলন ততোটা জোরালো হয়নি। ১৯৬৫ থেকে আবার আন্দোলন তীব্র হতে থাকে।
১৯৬৬ সনের শুরুতেই প্রবল গণআন্দোলন রাজ্যকে তোলপাড় করে দেয়। ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও সমগ্র গ্রামাঞ্চলে উত্তাল পরিস্থিতি তৈরি হয়। রাজ্যে রাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটে। ১৯৬৭ সনের সাধারণ নির্বাচনে শাসক কংগ্রেস দল পরাস্ত হয়।
যুক্তফ্রন্ট সরকারের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী হলেন কৃষক নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙার। রাজ্যব্যাপী উদ্বৃত্ত-বেনাম-পতিত জমি দখল এবং বর্গাদারদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিক্রিয়ার শক্তি ষড়যন্ত্রে সরকার ভেঙে যায় এবং রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়। কিন্তু ১৯৬৯ সনের মধ্যবর্তী নির্বাচনে আরও বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয় দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। রাজ্যে কৃষক-ক্ষেতমজুর জাগরণে সন্ত্রস্ত জমিদার সহ প্রতিক্রিয়ার শক্তির সঙ্গে যুক্ত হয় কেন্দ্রীয় সরকার। ফ্রন্টে ফাটল ধরে। আবারও রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হয়। শুরু হয় নির্মম সন্ত্রাস। শেষ পর্যন্ত ১৯৭২ সালের নির্বাচনে রিগিং ও জালিয়াতি করে সরকার দখল করা হল।
কেবল মানুষের ভোটের অধিকার নয়, কেড়ে নেওয়া হল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বলি হলেন হাজার হাজার কৃষক-ক্ষেতমজুর ও সাধারণ মানুষ। বিপুল সংখ্যক মানুষ শহীদ হলেন যাঁদের একটা বড় অংশ কৃষক-ক্ষেতমজুর। গ্রামীণ প্রতিক্রিয়ার শক্তি আবার মাথাচাড়া দিয়ে দাপট দেখাতে শুরু করলো। তারই মধ্যে এই রাজ্যে জমির অধিকার রক্ষার জন্য কৃষকরা লড়াই চালিয়ে যান। ১৯৭৪ সালে ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের সমসাময়িক সময়ে রাজ্যের অধিকাংশ জেলায় ক্ষেতমজুররা ধর্মঘট করেন।
স্বৈরশাসন রাজ্যের সীমানা ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। জারি করা হল জরুরি অবস্থা। সারা দেশে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম ব্যাপক বিস্তৃত হতে থাকে। অবশেষে সারা দেশে স্বৈরশাসনের পরাজয় ঘটে।
১৯৭৭ সন থেকে অনুকূল পরিবেশে রাজ্যে বৃহত্তর পরিসরে কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের শক্তির জোরেই উদ্বৃত্ত-বেনাম-পতিত জমির উপর গ্রামীণ গরিবদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ভূমি সংস্কার আন্দোলন বিস্তৃত হয়। নির্বাচিত সরকার জমির উপর কৃষকের অধিকারের আইনি স্বীকৃতি দিয়ে পাট্টা দেয়। জমির উপর বর্গাদারদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় অভিনব কায়দায়— প্রশাসনিক ভবন থেকে নয়, মাঠে মাঠে গিয়ে বর্গাদারদের নাম রেকর্ড করা হয় ‘অপারেশন বর্গা’র মাধ্যমে। গরিব কৃষক মহাজনের ঋণের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার কিছুটা সুযোগ পান। পাট্টা বা বর্গা রেকর্ডের ভিত্তিতে গরিব কৃষকদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের কিছুটা সুযোগ তৈরি হয়। গড়ে ওঠে সরকারি ধান ক্রয়ের বিস্তৃত ব্যবস্থা। বিপুল সংখ্যক স্ব-নিযুক্ত গোষ্ঠি ও নির্বাচিত সমবায়গুলির মাধ্যমে ধান ক্রয়ের ব্যবস্থায় উপকৃত হলেন কৃষকরা। কৃষি উৎপাদনে পশ্চিমবাংলা দেশের সামনের সারিতে উঠে আসে। গ্রামীণ বাজার সম্প্রসারিত হয়। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকট ক্রমে এই রাজ্যকেও গ্রাস করতে থাকে।
সরকার পরিবর্তনে গত এক দশকে রাজ্যের রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। গত এক দশকে কৃষক-বর্গাদারদের অর্জিত অধিকারের উপর নেমে এসেছে আক্রমণ। কোথাও বর্গাদার উচ্ছেদ হচ্ছেন, কোথাও পাট্টাদাররা। বহু জায়গায় শাসক দলের অনুগতরা কৃষকের জমির দখল নিচ্ছে, ভাগ চাষ করছে। আর সব কিছুই হচ্ছে শাসক দলের মাতব্বরদের অঙুলি হেলনে এবং চড়া উৎকোচের বিনিময়ে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে লুঠের ব্যবস্থা।
সরকারি ধান ক্রয়ের ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। সরকারি ধান ক্রয়ের ব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি ফড়ে-দালাল ও চালকল মালিকদের কব্জায়। কুইন্টাল পিছু ৬০০-৭০০ টাকা যাচ্ছে ফড়ে-দালালদের পকেটে। বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা। ঋণগ্রস্থ হয়ে কৃষক-ক্ষেতমজুরদের আত্মহত্যা ঘটলেও সরকার আত্মহত্যার প্রতিটি ঘটনাকে অস্বীকার করছে। কৃষি ক্ষেত্রে সরকারি ভূমিকা প্রায় অনুপস্থিত। কৃষকদের সহায়তার জন্য প্রতি ব্লকে কৃষি সহায়ক ও উদ্যান সম্প্রসারণ আধিকারিক থাকার কথা, যার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পদ শূণ্য। ফলে প্রায় ৭৫ লক্ষ কৃষক পরিবারের কৃষি সহায়তা কার্যত বন্ধ।
কেন্দ্রীয় সরকার ১০০ দিনের কাজে সারা দেশেই অর্থ বরাদ্দ কমিয়েছে। এক মাত্র রাজ্য পশ্চিমবাংলা ১০০ দিনের কাজের ব্যয়ের হিসাব দেয়নি। সেই কারণ দেখিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এই বছর এই খাতে রাজ্যের বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে।
পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এখন গ্রাম পঞ্চায়েত পিছু এক কোটি টাকা থেকে দেড় কোটি টাকা দেওয়া হয়। এই অর্থের ৬০ শতাংশ দেয় কেন্দ্র এবং ৪০ শতাংশ দেয় রাজ্য। ঠিকাদারদের মাধ্যমেই এই বিপুল পরিমাণ অর্থের কাজ করা হয়। এখন রাজ্য জুড়ে ওই খাতের টাকা এবং অন্যান্য ভাতার টাকা বেপরোয়া লুঠ চলছে। শাসক তৃণমূল দলের নিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তরে বন্টিত হয় এই বেআইনি অর্থের ভাগ। বাহিনি পোষা থেকে নানা স্তরের নেতাদের বৈভব বাড়ানো কাজে লাগে এই বেআইনি অর্থ। লুঠের অর্থের ভাগ নিয়ে দুর্বৃত্তদের মধ্যে হানাহানি ক্রমেই বাড়ছে। ঘটছে বগটুইয়ের মতো গণহত্যার ঘটনা।
পরিস্থিতির সুযোগ নিতে আসরে অতি মাত্রায় সক্রিয় কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি। বেআইনি অর্থের বৈভব ও ক্ষমতার আসন রক্ষা করতে তৃণমূল থেকে বিজেপি এবং বিজেপি থেকে তৃণমূলে গমন এখন আর বিস্মিত হওয়ার বিষয় নয় এই রাজ্যে।
সন্ত্রাস ও দুর্নীতিকে হাতিয়ার করে এক অতি স্থূল স্বৈরশাসন কায়েম করা হয়েছে রাজ্য জুড়ে। কৃষক জনতা ও সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের ঘটনা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৩ সনের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে সন্ত্রাসের মাধ্যমে ভোট লুঠ ক্রমশ ব্যাপক বিস্তৃত হয়েছে। সমবায়গুলিকেও সন্ত্রাস চালিয়ে কব্জা করা হয়েছে। মানুষের মতামত দেওয়ার সুযোগ ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে। প্রতিবাদীরা সর্বত্র আক্রান্ত হচ্ছে। তবে দিন যত যাচ্ছে শাসক তৃণমূল দল সম্পর্কে ক্রমশ মানুষ মোহমুক্ত হচ্ছেন।
এই পরিস্থিতিতে উত্তর-পশ্চিম ভারতে লাগাতার কৃষক আন্দোলনের জয়ে এই রাজ্যের কৃষক-ক্ষেতমজুরদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি হয়। কিন্তু সংহতিমূলক কর্মসূচির বাইরে ব্যাপক কৃষক জাগরণ এখানে ঘটেনি। লুঠের রাজের বিরুদ্ধে গ্রামীণ জনতা ক্রমশ ক্ষুব্ধ হচ্ছেন, কোথাও কোথাও বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। অনেক জায়গায় ক্ষেতমজুররা আন্দোলন করে মজুরি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। কোথাও পাট্টার জমি বেদখল চেষ্টা কৃষকরা প্রতিহত করতে পেরেছেন। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন কৃষক-ক্ষেতমজুররা। পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠনগুলিকে লাগাতার উদ্যোগ নিতে হবে। — শ্রমজীবী ভাষা, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.