বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
ক’দিন আগে এক প্রকাশকের অফিসে গিয়েছিলাম একটা কাজে। অফিসে ঢুকতেই একজন বললেন, বাইরে প্রচন্ড গরম, তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ, তা একটু আছে বটে, তবে এই গরমটা তবু মানিয়ে নিতে পারব। যুদ্ধের গরমটা গেছে, বাঁচা গেছে। চেয়ারে বসতে বসতে কথাগুলো ভাসিয়ে দিলাম।
- ঠিক বলেছেন। তবে যুদ্ধ বন্ধ হওয়াতে তো অনেকে অখুশি।
টেবিল থেকে মুখটা তুলে আমার দিকে একটু ঘুরে মৃদু স্বরে কথাগুলো বললেন ভদ্রলোক।
- হ্যাঁ, যারা এসিতে বসে আইপিএল দেখতে দেখতে অনলাইনে বিরিয়ানির অর্ডার করছে আর যুদ্ধের উন্মাদনা উপভোগ করছে, তাদের একটু অসুবিধে হয়ে গেল। ওদের তো আর সাইরেন শুনতে শুনতে ঘুমোতে যেতে হচ্ছে না। বোমার আঘাতে প্রতিবেশীর ক্ষত বিক্ষত শরীরও দেখতে হচ্ছে না।
- ফেসবুকে একটা রিল দেখছিলাম, এক যুদ্ধ-প্রেমিকের বাড়িতে মিলিটারি সেজে দু’জন গেছেন। তাকে তুলে নিয়ে যেতে। সীমান্তে যুদ্ধ করার জন্য। এই শুনে যুদ্ধের পক্ষে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া ব্যক্তির কি কান্না!
- সীমান্তের মানুষ যুদ্ধের ভয়াবহ রূপ দেখতে পাচ্ছে। সাধারণ মানুষও এই কদিনেই টের পেয়েছে।
সাধারণ মানুষ কি সত্যি বুঝতে পারছে? এইতো গতকাল এক মুদি দোকানে জিনিস কিনতে গিয়েছিলাম। বয়স্ক দোকানদার বললেন, মোদি যুদ্ধটা বন্ধ করে ভুল করল। ওরা সব জঙ্গি। ওদের বিশ্বাস নেই। আমি বললাম, যুদ্ধ হলে তো আমাদের ক্ষতি। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। দেশের মানুষ মারা যাবে। সম্পত্তির ক্ষতি হবে।
বৃদ্ধ বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন, তা হোক। ওরা তো শায়েস্তা হবে। মুসলিম মানেই বিশ্বাসঘাতক। মিরজাফরের জাত। ওদের সব খতম করা উচিত। আমি যে মুসলিম এটা জানলে বোধহয় ওখানেই মারধোর শুরু করে দিত। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ কেটে পড়লাম।
- মানুষের মনে এতোটা ঘৃণা ছড়িয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ কেন, অনেক উচ্চ শিক্ষিত ভদ্রলোক, সম্মানীয় ব্যক্তি ঘোরতর সাম্প্রদায়িক। চারপাশে আমি প্রতিদিন দেখছি। কথাগুলো বলে, ভদ্রলোক চারপাশটা একটু দেখে নিলেন। চোখে মুখে দ্বিধা, সংশয়। ভদ্রলোকের সঙ্গে এর আগে বার দুই কথা হয়েছে। এই অফিসেই। কোন্নগরে থাকেন, এখানে প্রুফ দেখার কাজ করেন, এইটুকুই জানতাম। মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ, তা জানার কোনও সুযোগ হয়নি।
- হ্যাঁ, আমার বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতদের মধ্যে অনেকেই হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে তারা মুসলিমদের দ্বারা কোনওদিন উৎপীড়িত হননি। দেশত্যাগের যন্ত্রণাও তাদের ভোগ করতে হয়নি। তবু মুসলিমদের প্রতি একটা ঘৃণা গোপনে গোপনে। পহেলগাম হামলার পরে বিদ্বেষ আরো বেড়েছে। আমি বললাম।
- জঙ্গিরা সীমানা পেরিয়ে এদেশে এল। ট্যুরিস্টদের খুন করল। আর দেশের মুসলিমরা টার্গেট হয়ে গেল। তাদেরকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সারা পৃথিবীতে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীরা সবচেয়ে বেশি মুসলিমদের মেরেছে। আপনি আফগানিস্তান, পাকিস্তানের মুসলিম মৌলবাদীদের দেখুন। তারা সাধারণ মুসলিম নারী শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। আবার দেখুন, সেনা অভিযানের নাম দেওয়া হল ‘অপারেশন সিঁদুর’। দুটো বিষয়কে একসঙ্গে মিলিয়ে দেখুন। মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো ছাড়া আর কি হতে পারে?
কিন্তু এ প্রশ্ন আমরা করতে পারব না। বললেই বলবে দেশদ্রোহী। ভদ্রলোক একটু উত্তেজিত।
আমি বললাম, হ্যাঁ, দেশে সন্ত্রাসবাদী হামলা হলেই আপনাদের দেশপ্রেম প্রমাণ করতে হয়। তখন ধর্মীয় পরিচয়টাই আপনাদের একমাত্র পরিচয় হয়ে ওঠে।
আমার কথাগুলো শোনার পর ভদ্রলোক বেশ খানিকটা আশ্বস্ত হলেন। কাজ রেখে পুরোপুরি আমার দিকে ঘুরে, একটু এগিয়ে এসে বসে বললেন, জানেন, পহেলগামের ঘটনার পর অচেনা মানুষের সঙ্গে কথা বলতেই ভয় করে। চেনা মানুষের সঙ্গে দ্বিধা নিয়ে কথা বলি। নিজের ধর্মীয় পরিচয়কে লুকিয়ে রাখি। এদেশে মুসলিম হয়ে জন্মানোটাই যেন মস্ত অপরাধ। অথচ এ দেশটা তো আমাদেরও। আমরাও তো এদেশের নাগরিক।
একদম ঠিক কথা। এ দেশটা আমাদের যতটা, আপনাদেরও ঠিক ততটা। আমি বললাম।
এরপর দু’জনে এক সঙ্গে চা খেলাম। ফোন নম্বর বিনিয়োগ করলাম। পরে কথা হবে জানিয়ে নিজের কাজে গেলাম।