বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জুন, ২০২২— পশ্চিমবঙ্গে স্কুলশিক্ষার সর্বস্তরে নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি রাজ্য সরকারের ঘুণধরা চেহারাটা একেবারে প্রকাশ্যে এনে ফেলেছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই স্কুলে চাকরিপ্রার্থীরা অভিযোগ করে আসছিলেন যে, এসএসসি’র নিয়োগে চরম দুর্নীতি হয়েছে। পাশ করাদের তালিকায় থাকা প্রার্থীদের চাকরি হয়নি, অথচ অকৃতকার্যরা নিয়োগপত্র পেয়ে দিব্যি চাকরি করছেন। এই দুর্নীতির প্রতিবাদে লাগাতার আন্দোলনে চালিয়ে যাচ্ছিলেন মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা। কিন্তু তাতে কান দেয়নি রাজ্য সরকার। শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ কর আদালত। এবং কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়ে নিয়োগ দুর্নীতির এই চেহারাটা জনসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মন্ত্রী হওয়ার পরেই পরেশ মাইতির মেয়েকে যেভাবে সব নিয়ম ভেঙে স্কুলে নিয়োগ করা হয়েছিল তা দলবাজি, স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির চরম নিদর্শন। দুর্নীতির অভিযোগে সিবিআই জেরার মুখোমুখি হয়েও মন্ত্রী পদত্যাগ করেননি এবং বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। অন্তত চক্ষুলজ্জার খাতিরেও পদত্যাগ করলে জনসমক্ষে তাঁর না হোক, তাঁর দলের ভাবমূর্তি কিছুটা রক্ষা পেত। এই দুর্নীতিকাণ্ডে সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন স্বয়ং মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। অভিযোগ, তাঁর আমলেই এসব কাণ্ড–কারখানা ঘটেছে। ফলে তাঁকেও সিবিআইয়ের জেরার মুখে পড়তে হয়েছে। শুধু মন্ত্রীরাই নন, দু্র্নীতিতে শিক্ষা দপ্তরের উচ্চকর্তাদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ, এই সব কর্তাদের সহযোগিতাতেই নিয়োগের ফাইলে ব্যাপক দুর্নীতি সংগঠিত হয়েছিল এবং তার বিনিময়ে লক্ষ লক্ষ টাকার হাতবদল হয়েছে। অর্থের হাতবদল নাকি হয়েছে সর্বস্তরেই।
শুধু মাধ্যমিক স্তরে নয়, প্রাথমিকেও শিক্ষক নিয়োগে বিরাট দুর্নীতির হদিশ মিলেছে। ১৩ জুন টেটে নিয়োগ নিয়েও সিবিআই তদন্তের আদেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। আদালত বরখাস্ত করেছে ২৬৯ জন প্রাথমিক শিক্ষককে। আদালতের নির্দেশে এই ২৬৯ জন স্কুলে ঢুকতে পারবেন না এবং তাঁদের বেতন বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আদালত জানিয়েছে, এঁরা টেট ফেল করেও চাকরি করছিলেন। এই মামলায় প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য এবং সচিব রত্না চক্রবর্তীকে সিবিআই দপ্তরে হাজিরার নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। আদালতের নির্দেশ, এঁরা তদন্তে সহযোগিতা না করলে সিবিআইএঁদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে।
রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে যে পরিব্যাপ্ত দুর্নীতির খবর সামনে আসছে তাতে রাজ্য সরকারের স্কুলশিক্ষা পরিচালন ব্যবস্থার সঙ্কটই প্রকট করে তুলছে। এর একদিকে রয়েছে টাকার বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীকে নিয়োগ এবং অন্যদিকে ফেল করাদের পাশ করানোর দাবিতে অভিভাবকদের বিক্ষোভ। শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতির যে সব খবরাখবর সামনে এসেছে বা আসছে, সেগুলিই রাজ্যের শিক্ষাপ্রশাসনকে জনমানসে হেয় করে তুলেছে। কোনও প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা যখন প্রশ্নের মুখে পড়ে এবং তাদের নৈতিক কর্তৃত্বই যখন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তখন দুর্বল প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সুবিধা আদায়ের পথে নামে অন্যায় সুবিধাপ্রত্যাশী লোকেরা। সেখানে মেধা ও শিক্ষার মানের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় নিজেদের ছেলেমেয়েদের পাশ–ফেল এবং চাপ দিয়ে পাশ করানোর সুবিধায় পথে নামেন একাংশ যারা নৈতিকভাবে অধঃপতিত।
যারা নিজেরাই টাকা নিয়ে চাকরি দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত, তাদের কোনও নৈতিক উপদেশই মানতে চাইবে না অন্যায় সুবিধাপ্রত্যাশীরা। এটাই দস্তুর। কারণ একটা দুর্নীতি আরো দুর্নীতিকে টেনে আনে, একটা অন্যায় সুবিধা প্রশ্রয় পেলে আরও অনেক অন্যায় সুবিধা আদায়ের প্রত্যাশা জেগে ওঠে এবং জনমনের একাংশে এই ধরনের দাবির ন্যায্যতা তৈরি হলে মানুষ সেই অন্যায় দাবির সমর্থনেই পথে নামে। নাটকের আরও বাকি আছে। যাঁরা লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে অবৈধ উপায়ে চাকরি পেয়েছিলেন এবং এখন বরখাস্ত, সম্ভবত তারাও এবার পথে নেমে দাবি করবেন হয় চাকরি নয় টাকা ফেরতের। এভাবে একটার পর একটা সমস্যার দুষ্টচক্রে জড়িয়ে পড়তে হবে রাজ্যের শিক্ষা বিভাগকে।
অথচ বিধানসভা ভোটে যে বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল সরকার, তাতে শক্তহাতে যে কোনও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো কর্তৃত্বের অভাব হওয়ার কথা ছিল না। যদি সেই জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে একটা সুষ্ঠু প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ সরকারের সামনে ছিল। সেটা না করে শাসক দল তৃণমূল হাঁটল রাজ্যের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরগুলি পুরোপুরি দখল করার দিকে। অথচ অর্থনীতির ক্ষেত্রে যেটা ছিল সবচেয়ে জরুরি দাবি, সেই কর্মসংস্থান তৈরির পথে হাঁটল না রাজ্য। এর জেরে একদিকে যেখানে যতটুকু নিয়োগের সুযোগ ছিল সেখানে দেখা দিল সীমাহীন দুর্নীতি, যার অন্যতম প্রকাশ টাকার বিনিময়ে অকৃতকার্যদের চাকরি দিয়ে সফলদের বঞ্চিত করা। অন্যদিকে, সমাজের সর্বত্র কোনও না কোনও ভাবে শাসকদলের ঘনিষ্ঠদের নিয়োগ করা যাতে বিরোধী পরিসর বলে কিছু না থাকে। এভাবেই বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েতের জমি থেকে উঠে আসছে বগটুইয়ের মতো ঘটনা কিংবা প্রায় প্রতিটি পঞ্চায়েত বা পুরসভা এলাকায় দেখা যাচ্ছে একদা নিঃস্বদের কোটি টাকার প্রাসাদ। এসবই সমাজের সর্বস্তরে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের ফল। এখন আদালত যদি ক্রমাগত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেই চলে তাহলে গণতন্ত্রের অন্যতম এই স্তম্ভকেও আড়াল থেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে পারে এরাজ্যের শাসকদল, এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। এখনও পর্যন্ত বিচার ব্যবস্থাই এদেশে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের কাঠামোকে রক্ষা করে চলেছে। মোদি সরকার প্রাণপণে আদালতের পরিসরকে সংকুচিত করার চেষ্টা করছে। কেন্দ্রে মোদি সরকারের এই প্রয়াসের বিরোধিতা করে এরাজ্যের শাসকদল যদি এখানে সেই আদালতের ক্ষমতাকেই কৌশলে সঙ্কুচিত করার চেষ্টা করে, তাহলে সেই স্ববিরোধিতা সরকারের নৈতিক কর্তৃত্বকেই আরও বেশি করে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেবে। ক্রমাগত স্ববিরোধী অবস্থান শাসকের দুর্বলতাকেই প্রকট করে তোলে।
এর একমাত্র প্রতিবিধান জনসাধারণের সক্রিয়তা। সাধারণ মানুষই তাঁদের বহুমুখী প্রয়াসের মধ্যে দিয়ে যদি সরকারের কাছে এই সতর্কবার্তা পৌঁছে দেন যে, তাঁরা এই সীমাহীন দুর্নীতিকে মেনে নেবেন না, তাহলেই একমাত্র শাসকেরা সতর্ক হতে পারেন। আর জনমতকে উপেক্ষা করে শাসকদল যদি আরও কঠোর শাসন ও নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দিতে চায়, তাহলেও নিঃশব্দে ক্ষয় হতে থাকবে সমর্থনের ভিত। মিত্ররাও চলে যাবেন শত্রুদের দলে। সে বড় সুখের সময় নয়। হিংস্র বিভাজনের শক্তি এই পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সক্রিয়।