বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

কাঁকড়াতন্ত্র: পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়ন ও দুর্নীতি

কাঁকড়াতন্ত্র: পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়ন ও দুর্নীতি

স্বাতী ভট্টাচার্য

photo

বাকিবুর রহমান লোকটা কে, দু’মাস আগেও কেউ জানত না। অক্টোবরের মাঝামাঝি ইডি-র খাদ্য কেলেঙ্কারির তদন্তে তিনি গ্রেফতার হন। তার পর থেকে উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গার বাকিবুর হয়ে উঠেছেন বাংলার ‘মুখ’। মুখ দেখে যেমন মানুষ চেনা যায়, তেমনই বাকিবুরকে দেখে রাজ্যবাসী চিনছে নিজের রাজ্যকে। ইডির অভিযোগ যদি ভুল না হয়, তা হলে বলতে হয় যে, এই সেই রাজ্য, যেখানে মামার বাড়ির থেকে একখানা পুরনো চালকল পেয়ে, স্রেফ নেতা-আমলাদের ‘ম্যানেজ’ করে একের পর এক চালকল, আটাকল খোলা যায়, কলকাতা ও বেঙ্গালুরুতে হোটেল কেনা যায়, একাধিক দামী ফ্ল্যাট, বিদেশি গাড়ি-সহ বিপুল সম্পত্তি তৈরি করা যায়। এ সবই সফল ভাবে করেছেন বাকিবুর। তাঁর মতো রেশন ডিলার, চালকল মালিকদের নিয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করে সরকারের টাকা আত্মসাৎ করার দায়ে জেল হাজতে রয়েছেন প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী। চোখের জলে ভেসে “আমি মরে যাব” বলে তিনি দয়াভিক্ষা করছেন বিচারপতির কাছে। আর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, দুর্নীতির মামলা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ‘ব্যক্তিগত বিষয়।’ এই কাপুরুষতা, এই নির্লজ্জ মিথ্যাভাষণও এখন পশ্চিমবঙ্গের পরিচয়।

দুর্নীতি সব রাজ্যেই হয়, আরও আড়ম্বর করে হয় দুর্নীতির তদন্ত। বিরোধী রাজ্যের সরকারকে বিপর্যস্ত করতে সদাই তৎপর কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার। তদন্তের তর্জনীর ভয়ে অতীতের বহু বড় বড় নেতা এখন নিজের ছায়া হয়ে বেঁচে রয়েছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যে ভাবে পরপর নেতা-মন্ত্রী ধরা পড়ছে, তার জুড়ি খুব বেশি নেই। বিষয়টি সংবাদ মাধ্যম রোজ পরিবেশন করছে এক রুদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতার মোড়কে — কে ছক্কা মারল, কোন বোড়ে উলটে গেল, কার ঘুঁটি এগোল, তাই নিয়ে চর্চা চলছে। ‘এরপর কে?’ এই উত্তেজনা গ্রাস করছে পাঠক-দর্শকদের। তাঁরা উল্লসিতও বটে — দিনে ডাকাতি-করা বাহুবলীদের শায়েস্তা হতে দেখলে কার না আনন্দ হয়? সেই সঙ্গে, ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম’ বলেও একটা তৃপ্তি মেলে। টিভির পর্দায়, খবরের কাগজে কে না দেখেছে, আবাসনের প্রকল্পের টাকায় শাসক দলের নেতা-প্রধানের তিন-চার তলা, মার্বেল-মোড়া বাড়ির ছবি। জব কার্ড বাঁধা রেখে ‘কাট মানি’ আদায় করার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন গ্রামবাসীরা, সেই ভিডিও। গত বছর দুয়েক কত লেখালেখি হয়েছে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে ভুয়ো নির্মাণের তালিকা নিয়ে। কারও কথা কানে তোলেনি তৃণমূল সরকার। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে ছোট-বড় বাকিবুর, তাদের বাইকের গর্জনে গ্রামবাসীর কানে তালা ধরে যায়।

আজ নেতাদের আদালতে চোখের জল ফেলতে দেখলে মনে হতে পারে, ওই তো ন্যায় হচ্ছে। এখানেই একটু সাবধান হতে হবে। এই দুর্নীতি কেবল মেছো ভূতের মাছ ছিনতাই নয়। ভূত ঢুকে রয়েছে সর্ষের ভিতরেই। তৃণমূল কংগ্রেস রাজনীতির মণ্ডপে উন্নয়নের প্রতিমা গড়ে তার এক এক হাতে এক একটি সরকারি প্রকল্প ধরিয়েছে। উন্নয়নের মুখ যিনি, সেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতারও মুখ। তাঁর হাতেই রাজকোষ। ফলে নৈবেদ্যর থালাতে টাকার পাহাড় কেবলই উঁচু হয়েছে — অন্নকূটের মতো, অর্থকূট। প্রচার হয়েছে, উন্নয়নই অনাথের নাথ, অবলের বল, অগতির গতি। গরিবের দুয়ারে এই বুঝি এসে গেল উন্নয়ন, ডিজে বক্স বাজিয়ে।
কাজের বেলা দেখা গেল, উন্নয়ন নুনের পুতুল। যেই সে দুর্নীতি মাপতে নেমেছে, অমনি নিজেই মিশে গেছে দুর্নীতিতে। কোনটা উন্নয়ন, আর কোনটা দুর্নীতি, আলাদা করে চিনতে পারার জো নেই। রেশন কেলেঙ্কারির তদন্ত করে ইডি বলছে, অন্তত ৩০ শতাংশ সরকারি ধান-গম রেশন দোকান থেকে বিক্রি না হয়ে, চলে এসেছে খোলা বাজারে। ধান কেনাতেও যে বিপুল দুর্নীতি হয়েছে, রাজ্য সরকারের অভ্যন্তরীণ সূত্রে এখন তা জেনেছেন সাংবাদিকরা। বহু নথিভুক্ত চাষির নামের সঙ্গে রয়েছে একটাই অ্যাকাউন্ট, বা একটাই মোবাইল নম্বর। বহু নথিভুক্ত চাষির জমির দলিল ভুয়ো। এ সব বাদ দিয়ে, যথাবিধি নাম নথিভুক্ত করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, যথেষ্ট চাষিই মিলছে না। চালকলগুলি উদ্যোগ নিয়ে চাষিদের নামের তালিকা পাঠাত, এ বার তারা পাঠায়নি। ফলে নভেম্বরের মাঝামাঝি অবধি দশ লক্ষ চাষিও নথিভুক্ত হয়নি, যেখানে এ বছরের লক্ষ্য পঁচিশ লক্ষ।

তেমনই, চালকলগুলিও সরকারের থেকে ধান নিয়ে ভাঙিয়ে চাল করে দিতে রাজি নয়। গত বছর (২২-২৩) পাঁচশোরও বেশি চালকল চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল সরকারের সঙ্গে, এ বছর নভেম্বরের গোড়ায় মাত্র ১৬৬টি চালকল স্বেচ্ছায় চুক্তিতে রাজি হয়। আন্দাজ হয়, তাদের লাভে টান পড়েছে। সরকারি কমিশনটুকু কবেই বা চালকল মালিক, রেশন ডিলারদের কাজের প্রধান আকর্ষণ ছিল? খাদ্য দফতরের তরফে চালকলগুলোকে বিশেষ সুবিধার লোভ দেখিয়ে, এবং ‘বুঝিয়ে’ (চুক্তি না করলে চালকলে পুলিশি অভিযান হবে, এই হুঁশিয়ারি দিয়ে) অধিকাংশকে চুক্তিবদ্ধ করা হয়েছে। এর পরেও রাজ্য সরকারের ধান সংগ্রহের লক্ষ্য — ৬৫ লক্ষ কুইন্টাল — পূরণ করা যাবে কিনা, সে প্রশ্ন উঠেছে। ভয় হয়, তবে কি ‘সিন্ডিকেট’ অচল হতে পুরো ব্যবস্থাটাই অচল হয়ে গেল? তবে কি সিন্ডিকেটই ব্যবস্থা, আর ব্যবস্থাই সিন্ডিকেট?

তাই উন্নয়ন আর দুর্নীতির সম্পর্কটা নতুন করে ভাবতে হবে। উন্নয়নের গালে দু’চারটে আঁচিলের মতো ফুটে উঠেছে দুর্নীতি, এমন আর ভাবা যাচ্ছে না। দুর্নীতির বাসা সরকারি ব্যবস্থার ভিতরে, ক্যান্সারের মতো। সুস্থ দেহকোষকে বঞ্চিত করে যেমন ক্যান্সার কোষগুলি পুষ্ট হয়, তেমনই দরিদ্রকে দরিদ্র, অপুষ্টকে অপুষ্ট, কর্মহীনকে কর্মহীন রেখে দিয়ে, এমনকি আরও শীর্ণ করে, উন্নয়নের টাকা রোয়াব বাড়াচ্ছে কিছু কাঁকড়ার। উন্নয়নের পুজোয় ভোগ চড়ানো আসলে হয়ে দাঁড়িয়েছে কাঁকড়াদের পেটপুজোর আয়োজন। চাল-গম, আবাস, জল, আলো, মায় ইস্কুলের ইউনিফর্ম, রোগীর স্যালাইন, সবই শিশু-নারী-বৃদ্ধের হাতে আসে কাঁকড়ার উচ্ছিষ্ট হয়ে।

তা হলে উন্নয়নের প্রকল্পে আরও, আরও টাকা ঢালার ঘোষণা হলে মানুষ কি খুশি হবে, নাকি আঁতকে উঠবে? রক্তপাত না হয়ে একটা নির্বাচনও যে হতে পারে না, ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে গুলি খেয়ে লোকে মরে যায়, খেলতে গিয়ে বোমায় উড়ে যায় শিশু, সেই গুলি-বোমা আসে কোত্থেকে? নিজের ক্রুশ নিজে বয়ে নিয়ে চলার মতো, নিজের উপর বর্ষণের জন্য গুলি-বোমার খরচ, আর সেগুলো ছুঁড়ে মারার মজুরি, সব জোগানোর ভার বয়ে চলেছে গরিবই। তারই উন্নয়নের টাকা সব হচ্ছে। ঠিকাদার, আড়তদার, চালকল মালিকের হাত ঘুরে ফিরে আসছে গরিবের বরাদ্দ, যাতে ক্ষমতাসীন দলটির হাতেই উন্নয়নের ঠিকা (অর্থাৎ সরকারি মসনদ) থেকে যায়, এবং তা আরও, আরও বরাদ্দ বাড়ায় উন্নয়নের প্রকল্পে। কী নাম এই প্রকল্পের? ‘মাছের তেলে মাছ ভাজা’? নাকি, ‘নিজ শ্রমে নিজ কবর’?

পিঁপড়ের পেট টিপে মধু বার করতে কাঁকড়ারা ওস্তাদ। সম্প্রতি একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা দুঃখ করছিলেন, তাঁরা স্কুল ইউনিফর্ম তৈরি করে আগে প্রতি সেট (জামা-স্কার্ট, বা জামা-প্যান্ট) পিছু পেতেন ছ’শো টাকা। দরদস্তুর করে কাপড় কিনে, সদস্যদের মজুরি দিয়েও, গোষ্ঠীগুলির কিছু আয় থাকত। এখন কাপড় কিনে দিচ্ছে সরকারের বরাত-পাওয়া এক সংস্থা, মেয়েরা কেবল সেলাই কর্মী। অর্থাৎ মুখে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েদের ‘উদ্যোগপতি’ তৈরি করার কথা বললেও, কাজে সরকার নিয়েছে মহাজনের ভূমিকা — কাঁচামাল নাও, তৈরি জিনিস দাও। ইউনিফর্ম থেকে মেয়েদের রোজগার কমেছে, গোষ্ঠীর রোজগার শূন্য। অথচ, ইউনিফর্ম সেলাইয়ের বরাত পেতে গেলেও কাটমানি দিতে হয় গরিব মেয়েদের।

শোনা গেল আরও এক গল্প। যত দিন মেয়েরা নিজেরা কাপড় কিনেছে, তার নমুনা জমা দিতে হয়েছে তাদের — সুতি নইলে চলবে না। এখন সরকার যে কাপড় দিচ্ছে, তার কিন্তু অনেকখানি পলিয়েস্টার, যা সহজদাহ্য, গরমে কষ্টকর, পরিবেশেরও প্রতিকূল। এ ভাবেই পেট ভরায় কাঁকড়ারা। শিশুর প্রাণের নিরাপত্তা থেকে মেয়েদের দারিদ্র, কিছুই তাদের অতল খিদের কাছে কিছু নয়। শ্বাস নিতে দেওয়ার জন্য, চোখের পাতা ফেলতে দেওয়ার জন্যও আজ নেতা হাত পাততে চায়।

এই কাটমানি কালচার-এর যে মূল্য চোকাতে হচ্ছে রাজ্যবাসীকে, তা পাচার-করা ধানের মূল্য, পাচার হওয়া গরু বা কয়লার মূল্য, নাচার নাগরিকের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া কাটমানি বা ঘুষের অঙ্কের চাইতে অনেক বেশি। দুর্নীতির জেরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে একের পর এক কেন্দ্রীয় প্রকল্প। এগারো লক্ষ ঘর তৈরি হওয়ার কথা ছিল গত আর্থিক বছরে, তার একটাও হয়নি। একশো দিনের কাজের প্রকল্প স্থগিত হওয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। বহির্মুখী পরিযায়ীদের সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের স্থান আগে ছিল ভারতে পঞ্চম, এখন হয়েছে তৃতীয় — উত্তরপ্রদেশ আর বিহারের পরেই পশ্চিমবঙ্গ।

তারপরে ধরতে হবে সেই চাষিদের কথা, যাঁরা হয়রানি, অপমান এড়াতে ধান কেনার শিবিরের দিকেই যান না। সেই সব কারিগরের কথা, যাঁরা দালালকে কাটমানি দিতে অপারগ বলে হস্তশিল্পীদের জন্য বিশেষ ঋণের আবেদনই করেন না। মেয়েরা নানা সংস্থার থেকে ক্ষুদ্র ঋণ নেয় বাড়ি তৈরি করতে, বাড়ি সারাতে। আবাস প্রকল্প পাওয়ার আশায় কত দিন বসে থাকবে তারা? চড়া সুদে টাকা ধার করে, আর হাত-পা কালি করে খেটে শোধ দেয়। এই সব শ্রম-বিধ্বস্ত, দারিদ্র-পিষ্ট জীবনের মূল্য হিসাবে না ধরলে দুর্নীতির ঠিক অঙ্কটি ধরা পড়বে না।

তাই শ্রমজীবী মানুষের দিক থেকে দেখলে, এ কেবল চোরেদের জেলে ভরার প্রশ্ন নয়। গরিবের জীবনে কী কী পরিবর্তন আসতে পারত, কেবল দুর্নীতির জন্য আসতে পারল না, সে প্রশ্নটাও করতে হবে। কোথাকার টাকা কোথায় যাচ্ছে, তার উত্তর যদি না মেলে, তা হলে ‘উন্নয়ন’-এর প্রকল্পে কত টাকা বরাদ্দ হল, সে ঘোষণার মানে নেই।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.