বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

বাজি বিস্ফোরণে নারী ও শিশু শ্রমিকের এই মৃত্যু উপত্যকা চাই না

বাজি বিস্ফোরণে নারী ও শিশু শ্রমিকের এই মৃত্যু উপত্যকা চাই না

নব দত্ত

photo

কিছুদিন আগে নদীয়ার কল্যাণীর স্কুল পাড়া লেনের বেআইনি বাজি কারখানায় বিষ্ফোরণে চারজন নারী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যুগুলি নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং প্রশাসনিক মদতে দিনের পর দিন ঘটে চলেছে। ২০১৫ থেকে ২০২৫ দশ বছরে ৩০টির মতো বিস্ফোরণ ঘটেছে। যাতে প্রাণহানি হয়েছে প্রায় আশি জনের। আহত প্রায় শতাধিক।
লক্ষ্যণীয় যে ২০১৭ সালে জাতীয় পরিবেশ আদালত বলেছেন, “বেআইনি বাজি কারখানা বন্ধের নির্দেশ পালনে রাজ্য সরকারের গা’ছাড়া মনোভাবে যারপরনাই হতাশার।” এরপর সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮এ বাজি নিয়ে এক নির্দেশে দেশের সর্বত্র বাজি উৎপাদন, বাজি মজুত, বাজি বহন, বাজি বিক্রয় নিষিদ্ধ করে। শুধু মাত্র সবুজ বাজি উৎপাদন ও বিক্রয় করা যাবে। সবুজ বাজির ফর্মুলা প্রত্যেকটির অনুমোদন দেবে ‘নিরি’ (ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট )। ১৫ কিলোর বেশি বাজির কাঁচামাল নিয়ে কাজ হলে উৎপাদনের ছাড়পত্র নিতে হবে ‘পেশো’ (PESHO) কাছ থেকে। এই ছাড়া রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও আগুন (Fire) দপ্তরের অনুমোদন নিতে হবে। এই আদেশেই বলা হল, বছরে নির্দিষ্ট দিনগুলোতেই কালীপুজোর দিন রাত ৮টা থেকে ১০টা, ছট পুজোয় দু’ঘন্টা এবং ৩১ ডিসেম্বর রাতে ১১-৫৫ থেকে ১২-৩০টা বাজি ফাটানো যাবে।
কোনও বাজিতেই বেরিয়াম জাতীয় কেমিক্যাল ব্যবহার করা যাবে না। এবং সবুজ বাজি সংক্রান্ত সবটাই দেখবেন, অনুমোদন, পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ করবেন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি। বলা দরকার যে, সবুজ বাজি হলেই যে দূষণ করবে না এমনটা নয়। নিরি’র মতে ৩০ শতাংশ দূষণ কম হবে সবুজ বাজিতে।
আমরা তাই বায়ু দূষণ এবং শব্দ দূষণের প্রেক্ষিতে সব ধরনের বাজি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছি।
মনে রাখতে হবে, মাত্রাতিরিক্ত দূষণের পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লিতে কোর্টের নির্দেশে সবুজ বাজি সহ সব ধরনের বাজি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
দিল্লিতে যে দূষণের মাত্রা দেখে কোর্ট বাজি নিষিদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে কলকাতা, হাওড়া, শিলিগুড়ি সহ অধিকাংশ বড় শহরগুলির দূষণ মাত্রা বছরের বেশির ভাগ দিন খারাপ, অতি খারাপ থাকে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার গত প্রায় ৬ বছর ধরে সবুজ বাজি তৈরি, প্রশিক্ষণ, বাজি ক্লাস্টার তৈরি নিয়ে নানান ঘোষণা করে চলেছেন। অন্যদিকে একটার পর একটা বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ এবং মৃত্যু ঘটে চলেছে।
রাজ্য সরকার ও মুখ্যমন্ত্রী সদলে বলতে থাকেন বাজি ক্লাস্টার গঠনের কথা। এভাবেই বছর যায়, মাস যায়। মুখ্যমন্ত্রীর আবেদনে সাড়া দিয়ে মানুষ উৎসবে ফেরেন। বেআইনি বাজি উৎপাদন চলতেই থাকে। সস্তা শ্রম কিনতে এই সব বেআইনি কাজের যুক্ত কারখানার মালিকরা অধিকাংশই হয়ে ওঠে শাসক ঘনিষ্ঠ বা শাসক দলের অনুগামী। তারা বেপরোয়াভাবে নিজেদের বেআইনি কাজে যুক্ত করে চলেছেন গ্রামের নারী, শিশুসহ বেকার, অর্ধ বেকার গরীব মানুষদের। এই সব বাজি গ্রাম, বাজি তৈরি এলাকাগুলি পুলিশ তথা ব্লক, জেলা প্রশাসনের নজরে চলতে থাকে। খাগরাগড় ঘটনার পর পরিবেশ আদালতের বক্তব্য ছিল, এজেন্সির পর্যবেক্ষণ আছে বেআইনি বাজি কারখানাগুলো কার্যত সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদীদের হাতিয়ার যোগান দেয়।
আদালতের নির্দেশ ও রাজ্য সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী বাজি ক্লাস্টার তৈরি হবে এবং সেখানেই একমাত্র বৈধ বাজি ‘পেশো’ এবং ‘নিরি’ অনুমোদিত ও পরীক্ষিত সবুজ বাজি (যা ৩০ শতাংশ কম দূষণ করবে) উৎপাদন এবং মজুত করতে হবে। এই নিয়ে ৫ আগস্ট ২০২৩ প্রাক্তন মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে নবান্নে অনুষ্ঠিত মিটিংয়ে ক্ষুদ্র শিল্প, বাণিজ্য দপ্তর সহ একাধিক দপ্তরের সচিব, জেলা শাসক, পুলিশ কমিশনার সহ আধিকারিকরা উপস্থিত থাকেন। সবুজ বাজি তৈরি, মজুত, বিক্রয় নিয়ে রাজ্যের ১১টি জেলায় ক্লাস্টার তৈরির কথা হয়। জমি দেখা, জায়গা নির্বাচন করার জন্য রাজ্যের সব জেলাশাসক, এসপি, অন্যান্য আধিকারিকদের সমীক্ষায় করার জন্য বলা হয়। এবং এই কাজে মিটিং উপস্থিত বাজি সমিতির একজনের সঙ্গে নির্দিষ্টভাবে প্রশাসনিক আধিকারিকদের আলোচনা করতে বলা হয়। সেই ব্যক্তি যিনি নিজেকে সমাজসেবী পরিচয় দেন।
কি এক অদৃশ্য কারণে এই ব্যক্তি এবং বড়বাজারের এক অবাঙালি ব্যবসায়ী নির্ধারক হয়ে উঠলেন। উৎসাহিত এই লোকটি পূর্ব কলকাতার জলাভূমি অঞ্চলে ক্লাস্টার করার ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। বাজি ব্যবসায় ক্ষুদ্র শিল্পের মাধ্যমে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে বলে গাঁজাখুরি গল্প বলে সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তর সচিব, প্রাক্তন মুখ্য সচিবের উদ্যোগে জেলায় জেলায় মিটিং ও প্রচার শুরু হল। আর শুরু হল শাসক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির বাজি নিয়ে তোলাবাজি। পর্ষদ নিজের তৈরি বিশেষজ্ঞ কমিটির সিদ্ধান্ত আদালতের অনুমোদন নিয়ে চলছিল তার থেকে সরে যায় — ১৯৯৭ থেকে চলে আসা বাজির সর্বোচ্চ শব্দ মাত্রা ৯০ ডেসিবেল উঠিয়ে দিয়ে ১২৫ ডেসিবেল করে নির্দেশিকা জারি করে। যাতে বেআইনি বাজি ব্যবসায়ীদের সুবিধা হয়। ১৮ নভেম্বর ২০২৩ গেজেট বিজ্ঞপ্তি দিয়ে West Bengal green Firecracker manufacturing, storage and selling scheme ঘোষণা করা হল। এই স্কিমের উদ্দেশ্য বলা হল, পরিবেশ বান্ধব বাজি উৎপাদন, মজুত এবং বিক্রয়। স্থায়ী সুস্থ জীবনধারণের জন্য সম্পদ তৈরি। পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষা, উন্নত জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে স্থায়ী কর্মসংস্থানের জন্য এই স্কিম।
২০২৩ নভেম্বর সরকার আলোচনায় আমাদের জানিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ সাতটি কারখানা সবুজ বাজি উৎপাদনের অনুমতি পেয়েছে। ছয়টি দক্ষিণ ২৪ পরগণায়, একটি দার্জিলিং জেলায়।
তাহলে এত বিপুল পরিমাণ বাজি উৎপাদন, মজুত বিক্রয় হচ্ছে কিভাবে? সবটাই বেআইনি?
আইন সম্মত করার কোনও চেষ্টা আদতে হবে না কেননা যারা এই কাজে যুক্ত তারা আইন মেনে কিছু করবে না। তাহলে উপযুক্ত মজুরি, সুরক্ষা, উৎপদনের শৃঙ্খলা ইত্যাদি মানতে হবে।
এই গোটা চক্র বেআইনি থাকলেই তোলা, চাঁদা, বেআইনি অস্ত্রের যোগানদার ইত্যাদি বজায় থাকবে।
৫ আগস্টের মিটিং মুখ্যসচিব জানালেন প্রাথমিক সমীক্ষায় ৫৫৫৬টি বেআইনি বাজি ইউনিট আছে। এর মধ্যে ৩৭৬৬টি বিক্রয় ইউনিট, ১৩৪৭টি উৎপাদন ইউনিট, মজুত ইউনিট ২২৯টি, অন্যান্য ২০৪টি। একই মিটিং নির্দেশ ছিল ১৫ দিনের মধ্যে সমীক্ষা শেষে আরো বেআইনি ইউনিট গুলির খোঁজ লাগানো এবং রিপোর্ট দেওয়ার। কোথায় কি?
তারপরেও রাজ্যে বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছে। গরীব মানুষ নারী, শিশুসহ শ্রমজীবী মানুষের প্রাণহানির ঘটনা হয়েছে। ঘটনার পরই সরকার, মুখ্যমন্ত্রী বিবৃতি দেন ক্লাস্টারের কথা বলেন। এই তো সেদিন বিজিবিএস হয়ে গেল। কোনও শিল্পপতি বাজি উৎপাদন করবেন? সরকারকে এমন আজগুবি প্রতিশ্রুতি দিলেন? না কারণ এই ব্যবসা বেআইনি ব্যবসা হিসাবে থাকতে পারে আইনসম্মত ভাবে নয়।
অনেকেই শিবকাশির কথা বলেন। তাঁরা জানেন কি, সুপ্রিম কোর্ট শিবকাশির একাধিক সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ তারা সবুজ বাজির নামে বেআইনি বেরিয়াম যুক্ত বাজি বানাচ্ছে। এছাড়া প্রতিবছর ওখানকার বাজি কারখানাগুলোয় বিস্ফোরণে শয়ে শয়ে মানুষ মারা যান।
আমরা কি এমন একটা মৃত্যু উপত্যকা চাই? বিষয়টা শুধু পরিবেশের নয়। স্বাস্থ্যের নয়, প্রশ্নটি মানবতার। প্রশ্নটা ন্যায্যতার।
গুচ্ছ গুচ্ছ উদাহরণ মানব সভ্যতায় আছে, আজ যা আইন নির্দেশ কালক্রমে সমাজের বাস্তবতায় আইনের সংশোধন এবং বিচারের মান্যতা পেয়েছে। আমরা যারা বিজ্ঞান ভিত্তিক ভাবনায় বিশ্বাস করি তারা মনে করি, যে কোনও বাজিই দূষণ সৃষ্টি করে।
এখন মিলিত ভাবে বলবার সময়, বাজি কেন্দ্রিক দূষণ মুক্ত পরিবেশ চাই। নারী, শিশুসহ গরীব শ্রমজীবীদের মৃত্যু উপত্যকা চাই না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.