বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

তিলোত্তমার ন্যায়বিচারের দাবি মোছা যাবে না

তিলোত্তমার ন্যায়বিচারের দাবি মোছা যাবে না

রতন গায়েন

photo

আগস্টের ৯ তারিখে আর জি করের কর্মরত পিজিটি চিকিৎসকের উপর সংঘটিত নৃশংস যৌন লাঞ্ছনা ও হত্যায় হতবাক ও শোকস্তব্ধ সারা বাংলা। বাংলার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশ ও বিশ্ব যেভাবে তিলোত্তমার ন্যায় বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন এবং সেই দাবি দিন দিন জোরদার হয়ে উঠছে, তা স্মরণকালের মধ্যে কখনও দেখা যায়নি। বিচারের দাবি ১০ আগস্ট থেকেই তিলোত্তমার সহকর্মী ডাক্তার ও জুনিয়র ডাক্তাররা তুলেছেন। নাগরিক সমাজ, বিশেষকরে মহিলারা, রাতে রাস্তার দখল নিয়ে রাতে কাজের স্বাধীনতার বার্তা জোরালো ভাবে ঘোষণা করেছেন। এতদসত্ত্বেও ২-৩ সেপ্টেম্বরের ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর’স ফ্রন্ট’-এর লালবাজার অভিযানের দৃঢ়তা ও সংকল্পে অবিচলতাকে কুর্নিশ জানিয়ে এই নিবন্ধের সূচনা করব। ডাক্তারবন্ধুরা যথার্থভাবে অভিযোগ করেছেন যে, তিলোত্তমার হত্যা ও লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার প্রমাণ লোপাট ও তদন্তকে বিভ্রান্ত করার ঘটনাক্রমের সঙ্গে কলকাতা পুলিশের নগরপাল যুক্ত। তাই তাঁদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল, নগরপালের পদত্যাগ ও মেরুদণ্ডহীন নগরপালকে প্রতিকী মেরুদণ্ড প্রদান করা। ডাক্তারদের শান্তিপূর্ণ মিছিল প্রতিহত করার জন্য দ্বিস্তরীয় ব্যারিকেড ও ৯ ফুট উঁচু ‘দুরভিগম্য লৌহইস্পাত’‘পাঁচিল তোলা হয়েছিল, তা গণতন্ত্র, সংবিধান এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই লৌহকপাট ডাক্তারদের অনমনীয়, ন্যায্য জেদে ২২ ঘন্টা শান্তিপূর্ণ অবস্থানের পর পুলিশকেই খুলে দিতে হয়। আর দাবিমত মিছিল এগিয়ে যায় এবং ডাক্তারদের প্রতিনিধিদল লালবাজারে নগরপালের হাতে তাঁর পদত্যাগসহ দাবি পত্র তুলে দেন। শিরদাঁড়াটিও উপহার দিয়ে আসেন।

তিলোত্তমার ন্যায় বিচারের দাবিতে দলীয় পতাকা ছাড়া রাত দখলের ডাকে লক্ষ লক্ষ মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া দেওয়ার অনেক কারণের মধ্যে দুটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি।

এক, রাজ্য ও দেশে অনেক হত্যা ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ও তিলোত্তমার ঘটনাকে সমার্থক করে দেখা এক বড় ভুল। আর জি করের তিলোত্তমা এক নামকরা সরকারি হাসপাতালের পিজিটি ডাক্তার। টানা ৩৬ ঘন্টা রোগীদের পরিষেবা দিয়ে একটুখানি বিশ্রাম নেওয়ার সময়েই তাঁর উপর নেমে আসে পাশবিক যৌন নির্যাতন। এখানেই না থেমে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সরকারি ব্যবস্থাপনার মধ্যে থেকেও হত্যার তথ্যপ্রমাণ যথাযথভাবে সংরক্ষিত না হওয়া নিয়ে আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে। যে তাড়াহুড়ো করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে তিলোত্তমার পোস্টমর্টেম করা হয় ও শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। তিলোত্তমার মা-বাবা দু’জনই পুলিশের তদন্তে তথ্য গোপনের ও তাঁদের হেনস্থার অভিযোগ তুলেছেন। যে অপরাধীকে পুলিশ গ্রেফতার করে, তাকেই একমাত্র অপরাধী বলে চিহ্নিত করা হল এবং সেই অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ারকে স্বয়ং কলকাতা পুলিশ কমিশনার যেভাবে আড়াল করলেন, তা রাজ্যবাসী ভালভাবে নেয়নি। ঘটনা পরম্পরায় মানুষের স্থির বিশ্বাস হয়েছে যে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ না হলে তিলোত্তমা বিচার পাবে না।

দুই, রাজ্যে ঘটে যাওয়া নৃশংস যৌন নির্যাতন ও হত্যার জঘন্য অপরাধগুলিকে রাজ্য সরকার ও তার প্রধান যেভাবে সাজানো, ছোট্ট ঘটনা বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েনের পরিণতি বলে চিহ্নিত করেন, তা রাজ্যবাসীকে ক্ষুব্ধ করেছে। প্রতিবাদীদের কোনও না কোনও গোষ্ঠীর বা রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা দেখতে দেখতে বর্তমান শাসক যে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে অক্ষম, সেই ধারণা জনমানসের ক্রমশ গভীরে প্রোথিত হয়েছে। কামদুনির ঘটনা প্রমাণ করেছে যে, এই জমানায় তদন্তে অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায় না। এর আগের জমানার রেকর্ডও খুব সন্তোষজনক ছিল না। ভিন রাজ্যগুলিতে নৃশংস যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলি (হাথরাস, উন্নাও বা বিলকিস বানোর কন্যার হত্যাকারীদের খালাস ও তাদের সম্বর্ধনা ইত্যাদি ঘটনা) চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, কোনও শাসক এইসব ঘৃণ্য বর্বরোচিত ঘটনার প্রকৃত বিচার করতে অপারগ। তাই দল-মত ভুলে মানুষ সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রতের দখল নেওয়ার ডাকে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছেন। জুনিয়র ডাক্তার সংগঠনের মুখপাত্রও বিপুল সংখ্যক মানুষের এই আন্দোলনে সম্পৃক্তির কারণ হিসেবে উপরোক্ত বিষয়গুলিকে চিহ্নিত করেছেন।

প্রসঙ্গত এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে তিলোত্তমা উঠে এসেছে এক সাধারণ পরিবার থেকে। আপন মেধা ও পরিশ্রমে নিজেকে সেরা ডাক্তার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার আগে এবং নতুন জীবনসঙ্গী নিয়ে ঘর বাঁধার কিছুদিন আগে তাঁকে নৃশংসতার শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হল। তাতে তাঁর বাবা-মার ও ভাবী জীবনসঙ্গীর বুকে শুধু বেদনার পাথর জমেছে তাই নয়। সহকর্মী ডাক্তার, শিক্ষক, ক্রিড়ামোদী, গায়ক, নাট্যকার, অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ার, দোকানদার, রিকশাচালক সবাই শোকস্তব্ধ। সবাই যেন হারিয়েছে তার দিদি, বোন অথবা মেয়েকে। তাই তাঁরা এমন নারকীয় অত্যাচার ও হত্যার প্রতিবাদে রাত দখলের ডাকে সাড়া দিয়ে এই নৃশংসতার বিচারের দাবি জানিয়েছেন।

লক্ষ লক্ষ মানুষের তিলোত্তমার ন্যায় বিচারের দাবি কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকাতলে গড়ে ওঠেনি। বস্তুত আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররাও তাদের মঞ্চে কোনও রাজনৈতিক দলের নেতাকে দলীয় পতাকা নিয়ে তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনে সম্মতি দেননি। রাজনৈতিক দল ও তাঁদের গণসংগঠনগুলি আলাদাভাবে নানান কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে চলেছে বলেই শাসক খুবই ভীতসন্ত্রস্ত। তাদের মরিয়া চেষ্টা হল, আন্দোলনকে রাজনীতির চেনা ছকে বেঁধে ফেলা। আর এই দুষ্কর্মে প্রথম উদ্যোগ নেন কলকাতা পুলিশের নগরপাল। ১৪ আগস্ট সারা বাংলার মহিলারা যখন সমাজ মাধ্যমে ’তিলোত্তমার বিচার চাই’দাবিতে সাড়া দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তার দখল নিয়ে শাসককে জোরালো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে, তখন একদল লুম্পেন (নগরপালের হিসেবে সাত হাজার) আর জি করের ভেতরে ঢুকে বেপরোয়া তাণ্ডব চালিয়ে হাসপাতালের কোটি টাকার উপর ওষুধ ও ডাক্তারি যন্ত্রপাতি চুরমার করে ডাক্তারদের প্রতিবাদী মঞ্চে যথেচ্ছ ভাঙচুর চালায়। লক্ষ্য ছিল সেমিনার হলে ঢুকে হত্যার প্রমাণ লোপ করা। বিস্ময়কর হলেও সত্যি হল পুলিশ এই তাণ্ডবে শুধু দর্শকের ভূমিকায় ছিল তাই নয়, বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ না করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে লুকিয়ে পড়েছিল। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলও এই সুযোগে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে যথারীতি বিভাজনের রাজনীতি করার চেষ্টা শুরু করে। রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক এই তালে তদন্তের অভিমুখ বদলে দিতে নিজেই ১৬ আগস্ট দলীয় মিছিল করে অপরাধীর ফাঁসি দাবি করে জানিয়ে দিলেন যে, ১৪ আগস্টের আর জি করের ভাঙচুরের ঘটনায় রাম-বাম জড়িত। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা এই সুযোগে ছাত্র সমাজ নামে এক ভূঁইফোড় সংগঠনের নামে নবান্ন অভিযানে নামেন। পুলিশের সঙ্গে ‘আন্দোলনকারীদের’লড়াই লড়াই খেলা ও প্রধান বিরোধী দলের ১২ ঘন্টা বাংলা বনধে ভাঙচুর তাদের স্বরূপ প্রকাশ করে দিয়েছে।

তিলোত্তমার ন্যায় বিচারের দাবিতে গণ আন্দোলন থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জনমানসের সামনে উঠে এসেছে।

এক, কঠোর ফৌজদারি আইন না থাকাই কি ন্যায়বিচারের পথে অন্তরায়? দুই, ধর্ষককে বা ধর্ষণকাণ্ডে সন্দেহভাজনকে এনকাউন্টারে নিধন করার হায়দ্রাবাদী মডেল যা রাজ্যের শাসক প্রয়োগ করার জন্য জোরালো সওয়াল করেছেন, তা অনুসরণ করলেই কি তিলোত্তমার সুবিচার নিশ্চিত হবে? তিন, রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক ধর্ষকদের ফাঁসি ও দ্রুত বিচারের জন্য যে আইন বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে পাস করিয়েছেন তা আইনে পরিণতি পেলেই কি তিলোত্তমার ধর্ষকরা সাজা পেয়ে যাবে? চার, রাজ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে গভীর দুর্নীতি ও অব্যবস্থা জনসমক্ষে এসেছে তার সঙ্গে কি তিলোত্তমার উপর ঘটে যাওয়া নৃশংসতার কোনও যোগসূত্র আছে?

প্রথমে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা জরুরি যে, দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়ার জন্য ফৌজদারি আইনের কোনও অপ্রতুলতা নেই। বিশেষ করে নির্ভয়া ঘটনার পরে নারী নির্যাতন ও কর্মস্থলে হেনস্থার অপরাধে ও সুরক্ষার বিষয়ে অনেক আইন ও সরকারি নির্দেশিকা আছে। নয়া ফৌজদারি আইনে কড়া শাস্তি বিধানের সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডেরও বিধান আছে। কাজেই চলতি আইনেই তিলোত্তমার অপরাধীদের শাস্তি হতে পারে। শুধুমাত্র রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলে আরও দ্রুততার সঙ্গে বিচারের সংস্থান আছে। তাছাড়া, আইন প্রণীত হলেও তা সংবিধান সম্মত হবে কিনা তা সুপ্রিম কোর্টের বিচার্য। রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দেবেন কিনা, সেটাও প্রশ্ন। কিন্তু এসব বিতর্ক উত্থাপন করে তিলোত্তমার বিচার ত্বরান্বিত করা যে যাবে না তা রাস্তায় থাকা মানুষের বুঝতে ভুল হবে না। মূল লক্ষ্যের অভিমুখ বদলে আসলে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী রাজনীতি বাংলায় কায়েম করার এটি একটি চেষ্টা।

তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে মানুষের আন্দোলন এক মাসের বেশি হয়ে গেলেও সর্বস্তরে সেই দাবি এখনও সমানভাবে জোরালো। কিন্ত একটা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টাও জারি আছে। লক্ষ্য হল, আন্দোলনকে গতিপথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। ইতিমধ্যে কোচবিহারের মাথাভাঙা থেকে মেদিনীপুর, সর্বত্র আন্দোলনকারীদের উপর হামলা এবং হুমকি শুরু হয়েছে। আন্দোলনরত ডাক্তারাও এই হুমকি থেকে বাদ পড়ছেন না। রাস্তায় ন্যায়বিচারের দাবিতে যাঁরা প্রথম থেকে সামিল ও মাসাধিককাল বিচারের দাবিতে প্রত্যয়ী আছেন, তাঁরা সামাজিক দায়বদ্ধতার বোধে উজ্জীবিত। তাঁদের বিশ্বাসের ভিত দিন দিন দৃঢ়তর হয়ে উঠছে। এই দৃঢ়তা ও সংকল্প থেকে তাঁদের বিচ্যুত করা সহজ হবে না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.