বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

দেউচা-পাচামি: আদিবাসী সমাজ বনাম আধুনিক সভ্যতার সংঘাত

দেউচা-পাচামি: আদিবাসী সমাজ বনাম আধুনিক সভ্যতার সংঘাত

দীপক পিপলাই

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জানুয়ারি, ২০২২— পশ্চিমবঙ্গে জনগণের উপর রাষ্ট্রযন্ত্রের শোষণ-অত্যাচার নতুন কিছু না। আবার, তার প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ইতিহাসও তেমনি উজ্জ্বল। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে বর্তমান শতাব্দীর বিগত দশক পর্যন্ত এই অত্যাচার ও প্রতিরোধের ধারাবাহিকতায় কোনও ছেদ নেই। নতুন দশকও ফুঁসতে শুরু করেছে। সাঁওতাল আদিবাসী বিদ্রোহের গর্বিত উত্তরাধিকারী, বীরভূম জেলায় বসবাসকারী সাঁওতাল শ্রমজীবী জনগণ এ'বারের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলনে একেবারে সামনের সারিতে। দেউচা-পাচামি অঞ্চলে প্রস্তাবিত কয়লা খনি তৈরির সর্বনাশা চেষ্টার বিরুদ্ধে তাঁরা আজ এককাট্টা।
জনগণের উপর রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের এই অসভ্যতা দুনিয়ার নানা প্রান্তে এবং নানা সময়েই দেখা গেছে। দুনিয়াজোড়া এই ধারাবাহিক অসভ্যতার সাম্প্রতিক ও স্থানীয় উদাহরণ দেউচা-পাচামি।। বীরভূমের এই সর্বনাশা সরকারি উদ্যোগের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, দুনিয়াব্যাপী এই চলমান বাস্তবতা সম্পর্কে দু'চারটে কথা বলা প্রয়োজন। 'সাধারণ' বাস্তবতার সাথে 'নির্দিষ্ট' ঘটনার সম্পর্ক বুঝতে তা সাহায্য করবে।


আদিবাসী সমাজ ধ্বংসকারী অসভ্য 'সভ্যতা'র বিকাশ!




১) আদিবাসী সমাজ বনাম আধুনিক সভ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত ও সংঘর্ষ, মানব-ইতিহাসের এক লক্ষণীয় অধ্যায়। শতশত বছর ধরেই এ'লড়াই চলে আসছে। শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই। ঘটনাবলীর চালচিত্র দেখে মনে হয়, এ'যেন 'অতীত'-এর সাথে 'বর্তমান'-এর এক অসম, অসীম ও অমানবিক লড়াইয়ের কাহিনী। যেখানে 'বস্তু'-র আগ্রাসন আছে, 'মন'-এর মর্যাদা নেই; 'হিংসা'-র দাপট আছে, 'অহিংসা' কার্যত অদৃশ্য; 'মানুষ'-এর প্রতাপ আছে, 'মানবিকতা'-র অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল!
২) আদিবাসী সমাজের জীবনধারা বয়ে চলে মূলত তাঁদের জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদকে কেন্দ্র ক'রে। জন্ম থেকে মৃত্যু, সবকিছুতেই যেখানে পরিবেশের ভৃমিকা অত্যন্ত গভীর ও অবিচ্ছেদ্য। আর আধুনিক সভ্যতা বিকশিত হয় জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদকে, এককথায় পরিবেশকে, অসীম লুন্ঠনের মাধ্যমে। বস্তুগত প্রয়োজনীয়তাই এখানে মুখ্য বিচার্য বিষয়; জীবনের মানবিক ও সাংস্কৃতিক দিকের গুরুত্ব গৌণ!
৩) জল-জমি-জঙ্গল-খনিজ, সবকিছুই আদিবাসী সমাজের কাছে সমষ্টিগত জীবনের রসদ এবং আরাধ্য দেবতা। আর আধুনিক সমাজের কাছে এগুলি যেন 'সভ্যতা' বিকাশ-এর স্বার্থে শুধুমাত্র সীমাহীন লুন্ঠন এবং অপূরণীয় ধ্বংসের জন্য! জলাভূমি বুজিয়ে, জঙ্গল সাফ ক'রে, পর্বত গুঁড়িয়ে দিয়ে, ভূগর্ভের খনিজ লুন্ঠনের মাধ্যমে যা এগিয়ে (!) চলে। সবকিছুই বর্তমান 'সভ্যতা' বিকাশ-এর তাগিদে; পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি বিন্দুমাত্র দায় ও দায়িত্ব যেখানে দেখা যায় না। আগামীদিনে সভ্যতা ধ্বংসের অনিবার্য সোপান রচিত হতে থাকে প্রতিমুহূর্তে!
৪) আদিবাসী সমাজের প্রথাগত কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কিত যাবতীয় বোধের কেন্দ্র 'প্রকৃতি'। কিন্তু আধুনিক সমাজের কাছে প্রকৃতি হ'লো শুধুই নিজেদের সদা-পরিবর্তনশীল এবং অনন্ত-চাহিদার জোগানদার। 'আদি'-র কাছে যা মানবিকতার শিক্ষক, 'নব্য'-র কাছে তা-ই সংকীর্ণ লোভের আকর্ষণ।
৫) আদিবাসী সমাজ প্রকৃতির প্রথম সভ্য মানবগোষ্ঠী। মানবিকতার যাকিছু সুগন্ধি নির্মাণ, তার স্রষ্টা এঁরাই। আর আধুনিক নব্য-সমাজের উদয় ও বিকাশ ঘটেছে আদিবাসীদের বীভৎসতম হত্যা, লুন্ঠন, অত্যাচার ও উচ্ছেদের মাধ্যমে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ইউরোপীয় পুঁজিবাদী দস্যুরা কোটি কোটি আদিবাসীকে তাঁদের আদি বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ ও নিকেশ ক'রে যেমন ভিত্তি গড়ে তুলেছে 'আধুনিক', 'সভ্য', 'শিল্পোন্নত' আমেরিকান ও অষ্ট্রেলিয়ান সমাজের। ভারতবর্ষেও 'সভ্যতা'-র দাপটে অসংখ্য আদিবাসী তাদের বংশপরম্পরায়ের জঙ্গল থেকে হয়েছে বিতারিত, আইনত সেইসব জঙ্গলের মালিক হয়েছে সরকার; আর আদিবাসীরা হয়ে গেছে সেইসব জঙ্গলে "বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী'!
৬) আদি ও নব্য, দুই ধরনের সমাজ যখন পাশাপাশি বাস করে, তাদের মধ্যে অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে পারস্পরিক সংঘাত এবং আদান-প্রদান। ভাষা সংস্কৃতি অর্থনীতি ধর্ম, 'এক'-এর কোনও কিছুই আর পুরোপুরি 'অপর'-এর প্রভাবমুক্ত থাকেনি। তবে 'আদি'-র উপর 'নব্য'-র প্রভাব হয়েছে প্রধানত বিষময়; তাদের জীবন-জীবিকা ছাড়াও প্রথাগত সবকিছু ভেঙ্গেচুরে তছনছ হয়ে গেছে। আর 'নব্য'-র কাছে 'আদি' হয়ে উঠেছে সর্বার্থে অমৃতের যোগানদার; মানবিকতার ও জ্ঞানভাণ্ডারের প্রাথমিক উৎস।
৭) 'উন্নতি'-র হাস্যকর দেমাক আধুনিক সমাজের মোড়লদেরছ করে তুলেছে ভীষণ আত্মম্ভরি এবং ভয়ঙ্কর আগ্রাসী। খনি, ড্যাম, জলাধার, পার্ক, কারখানা, নগর ইত্যাদি নানা কিছু 'উন্নয়ন'-এর জন্য ভারতবর্ষ তথা পৃথিবী জুড়ে কতো কোটি আদিবাসী এবং অন্যান্য মানুষ তাঁদের বাসভূমি থেকে বারবার ছিন্নমূল হয়েছেন, তার সঠিক হিসেব আধুনিক সময়ও জানেনা! কতো কোটি পরিবার দু'বার, তিনবার, এমনকি চারবারও উচ্ছেদ হয়েছেন তাঁদের বাসস্থান থেকে, তার সঠিক হদিসও পাওয়া যাবেনা কোনওদিনই! এঁরা 'সভ্যতা'-র বলি! পাশাপাশি, আদিবাসী সমাজের কাছে ঐতিহ্যমন্ডিত গর্ব তাঁদের শত-সহস্র বছরের প্রথাগত মানবহিতৈষী পরম্পরা। এঁদের আচার-অনুষ্ঠানে মন্ত্রোচ্চারিত হয় সমগ্র মানবসমাজের সুস্থ ও আনন্দময় জীবনের জন্য। সংকীর্ণ স্বার্থপরতাকে বিসর্জন দিয়ে, বৃহত্তর মানবকল্যাণের লক্ষ্যে। এঁদের সঙ্গীতে প্রকৃতি-বন্দনার ভাষা। অপরদিকে 'আধুনিক', 'শিক্ষিত' ও 'সভ্য' মানুষ আজও নিজেদের দেবতার কাছে প্রার্থনা করে - "রূপং দেহি, ধনং দেহি, যশো দেহি, জয়ং দেহি, রাজ্যং দেহি"! শুধুই 'দাও', 'দাও', দাও'! কেবল সংকীর্ণ ও ব্যক্তিগত কামনার আর্তি।
৮) আধুনিক সমাজের মাতব্বরগণ মনে করে, কিছু 'পুনর্বাসন' ও 'ক্ষতিপূরণ' দিলেই, জল-জমি-জঙ্গল-খনিজের অধিকার থেকে মর্জিমাফিক আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা যায়। 'টাকা'-র অঙ্কেই তারা সবসময়ে এবং সববিষয়ে লাভ-ক্ষতির হিসেব কষতে অভ্যস্ত! আধুনিক অর্থনৈতিক জীবনের চরিত্রগত কারণেই, স্থানীয় পরিবেশের (জল-জমি-জঙ্গল-খনিজের) সাথে 'সভ্য' মানুষের কোনও আত্মিক সম্পর্ক গড়েই ওঠেনা। ফলে, স্থানীয় পরিবেশের সাথে ওতপ্রোতভাবে সংপৃক্ত আদিবাসী জীবন সম্পর্কে তথাকথিত 'সভ্য ও উন্নত' সমাজের কোনও গভীর উপলব্ধি-ই থাকেনা। পরিবেশের সাথে নিজেদের শিকড়হীন জীবনযাপনের কারণেই, তারা আদিবাসী সমাজের আবেগমথিত ও ঐতিহ্যসিক্ত মনোজগতকে উপলব্ধি করতে সম্পূর্ণ অক্ষম। অর্থের প্রাবল্য, অস্ত্রের দাপট, প্রচারের কৌশল এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, সবকিছুর জোটবদ্ধ আগ্রাসন আদিবাসী সমাজকে শেষপর্যন্ত দাবিয়ে রাখতেই সক্ষম হয়। মানবিক চেতনাকে পরাভূত ক'রে বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠে অমানবিক আগ্রাসনের শক্তি!
৯) 'গাছ' মানে আদিবাসীদের কাছে দেবতা; ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জঙ্গল তাঁদের বাসস্থান, খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি, অলঙ্কার, পোষাক, খেলাধূলা, আত্মরক্ষার এবং সাংস্কৃতিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর যোগানদার। জঙ্গলের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া আদিবাসী সমাজের কাছে, গভীরতম অর্থে, মৃত্যুর নামান্তর। আধুনিক সমাজের মাতব্বরগণ কখনোই তা উপলব্ধি করতে পারেনি, আজও পারেনা। বহির্জগতের বাস্তবতাই তাদের কাছে প্রধান। 'জীবন'-কে যথার্থ মর্যাদা দিতে তারা ব্যর্থ। জঙ্গল কেটে সাফ করে এবং বংশপরম্পরায়ের বাসভূমি থেকে হাজার হাজার আদিবাসীদের উচ্ছেদ ঘটিয়ে, 'উন্নত' সমাজের স্বার্থে নানা ধরণের 'আধুনিক' কর্মকাণ্ড এবং পাথর খাদান তৈরি কিম্বা কয়লা খনির আয়োজন, আদিবাসী সমাজের উপর ভয়ঙ্কর অভিশাপের মতো।
১০) বিশ্বজুড়ে এই অমানবিকতার পথেই এগিয়েছে আধুনিক 'সত্যতা'। ভূমিসন্তানদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন কখনোই ক্ষমতাশালী শাসকের কাছে প্রধান গুরুত্ব পায়নি, এবং আজও পায়না। কোটি কোটি মানুষের এই দুনিয়াজোড়া উচ্ছেদের কারণেই সমাজ-গবেষণায় জায়গা ক'রে নিয়েছে "উন্নয়ন-উদ্বাস্তু" (Development Refugee) শব্দবন্ধটি। কোনও মহাদেশের জনসমাজই এই অভিশাপ থেকে মুক্ত থাকেনি। বলা যায়, আধুনিক 'সভ্যতা'-র অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই অ-সভ্যতা!
বর্তমান শতাব্দীর শুরুতেই প্লকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, শুধুমাত্র বড়ো ড্যাম তৈরির জন্যই চার থেকে আট কোটি মানুষ ছিন্নমূল হয়েছেন বিশ্বজুড়ে। ('ড্যামস্ অ্যান্ড ডিভেলপমেন্ট'; ওয়ার্লড কমিশন অন ড্যাম - রিপোর্ট, আর্থস্ক্যান, ইউকে অ্যান্ড ইউএসএ, নভেম্বর ২০০০ দ্রষ্টব্য।) আর গবেষকদের মতে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৯৭, এই পঞ্চাশ বছরেই বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে ভারতবর্ষ জুড়ে উচ্ছেদ হয়েছেন অন্তত আড়াই কোটি মানুষ। এইসব উচ্ছেদ হওয়া মানুষের জমি হারানো, কাজ হারানো, রোগ এবং মৃত্যুহার বৃদ্ধি, নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষার ক্ষতি, ইত্যাদি - তথাকথিত 'সভ্যতা'-র অভিশাপ। ('টেস্টিং দ্য রিস্কস অ্যান্ড রিকনস্ট্রাকশন মডেল অন ইন্ডিয়াজ্ রিসেটেলমেন্ট এক্সপিরিয়েন্সেজ', লক্ষ্মণ কে মহাপাত্র; 'দ্য ইকনমিকস্ অব ইনভলান্টারি রিসেটেলমেন্ট - কোয়েশ্চেনস্ অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেজ্', দ্য ওয়ার্লড ব্যাঙ্ক, ওয়াশিংটন ডিসি, ১৯৯৯থেকে।)
এই দুনিয়াজোড়া চালচিত্রকে মাথায় রেখেই বুঝতে হবে দেউচি-পাচামির ঘটনাবলিকে।


দেউচা-পাচামি




অতি সম্প্রতি যে-অঞ্চলের আদিবাসী সমাজ সহ শ্রমজীবী মানুষেরা আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছেন, তা হ'লো পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় মহম্মদবাজার ব্লকের অন্তর্গত দেউচা-পাচামি এবং দেওয়ানগঞ্জ-হরিনসিঙ্ঘা। অন্তত এগারো বছর আগে থেকেই এই অঞ্চলের কয়লা ব্লক নিয়ে আলোচনা ও লেখাপত্তর দেখা যায় সংবাদমাধ্যমে।
পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো কয়লা ব্লক নাকি আবিষ্কৃত হয়েছে এখানে। প্রাথমিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় দু'শো দশ কোটি কুড়ি লক্ষ টন কয়লা মজুত রয়েছে দেউচা-পাচামি অঞ্চলের ভূগর্ভে। রাষ্ট্রযন্ত্রের জিভ দিয়ে লালা ঝরতে শুরু করেছে এই কালো সোনার লোভে; বারো হাজার কোটি টাকা খরচের কেন্দ্রীয় বরাদ্দও নাকি হয়ে গেছে এখানকার প্রস্তাবিত খনির জন্য। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য, উভয় সরকারও অত্যন্ত আগ্রহী আদিবাসী সমাজ সহ বহু মানুষের এবং পরিবেশের সর্বনাশকারী এই খোলামুখ কয়লা খনি যাতে তাড়াতাড়ি শুরু করা যায়, সেই ব্যাপারে।
মহম্মদবাজার অঞ্চল নানারকম খনিজ সম্পদে ভরপুর। যেমন লোহা, চুনাপাথর (খড়িমাটি), পাথর, কয়লা। শতশত বছর ধরেই চলছে নানা খনিজের উত্তোলন এবং নানাসময়ে তা নিয়ে রমরমা ব্যবসা। রাজনৈতিক দলের কেষ্টবিষ্টুদেরও কেউ কেউ সরাসরি মালিক হিসাবে যুক্ত রয়েছে এইসব ব্যবসায়। পাশাপাশি একই সঙ্গে, অনিবার্যভাবেই চলছে জঙ্গল সহ প্রকৃতি ধ্বংসের পর্ব!
বীরভূম অঞ্চলের আদিবাসী সমাজ কাঁচা লোহার আবিষ্কার ও ব্যবহার শুরু করে আজ থেকে প্রায় দুই হাজার তিনশো হাজার বছর আগে। দেউচা-পাচামি অঞ্চলে এই কাঁচালোহার নমুনা এখনও পাওয়া যায়। চুনাপাথর ও পাথর খাদানের যে লাভজনক কারবার এখন সেখানে চলে, তা-ও প্রধানত আদিবাসীদের (সাঁওতাল, লোহার, অসুর, কোরা ইত্যাদিদের) নিবিড় শ্রম-নির্ভর। এই শ্রমজীবী মানুষগুলির ভয়ঙ্কর কষ্টকর জীবনযাপনের এবং তাঁদের উপর শোষণ-পীড়ণ-অত্যাচারের অমানবিক চিত্র আধুনিক 'সভ্যতা'-কে শুধুই বিদ্রুপ করে।
এই এলাকার যে তিনহাজার একর জুড়ে রয়েছে কয়লার ভান্ডার, তার মধ্যে একহাজার একর জমির মালিক এখন খোদ সরকার; বাকি দু'হাজার একর সরকারকে অধিগ্রহণ করতে হবে। অঞ্চলে নয় হাজারেরও বেশি তফসিলি আদিবাসী এবং সাড়ে তিন হাজারের বেশি তফসিলি জাতের মানুষ বাস করেন। বিস্ময়কর ভারতবর্ষীয় সরকারি নিয়মকানুনের দৌলতে, এঁদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে যাঁরা হয়তো 'তফসিলি জাত' হিসাবে নথিভুক্ত (যেমন লোহার), তাঁরাই আবার বিহারে ও ঝাড়খন্ডে 'তফসিলি আদিবাসী'! এঁদের কীভাবে এবং কীসের লোভ দেখিয়ে উচ্ছেদ করা যাবে, তাই এখন সরকারি মাতব্বরদের পরিকল্পনার বিষয়। আর বংশপরম্পরায়ের বাসভূমি থেকে উৎপাটিত হবার মুখে আদিবাসী সমাজের দুশ্চিন্তা, তাঁদের প্রথাগত ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনযাপনের কী হবে!
পেটের ভাত আর মাথার ছাদটুকু নিয়েই যে মানুষের 'জীবন' না, তা আদিবাসী সমাজের চেয়ে ভালো কে বুঝবে? একটুকরো জমি, এক আঁজলা টাকা, আর একজনের যেমনতেমন চাকরগিরিতে যদি সভ্যতার স্রষ্টা আদিবাসী সমাজ খুশি না হয়, তাঁরা যদি নিজেদের প্রথাগত জীবন, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে মর্যাদা দিয়েই বাঁচতে চায়, কোনও প্রশাসনিক মোড়লের নৈতিক অধিকার নেই সেই সমষ্টিগত ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করার। 'সভ্যতা'-র দোহাই পেড়ে কোনও রকম অ-সভ্যতাই নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য না।
দশবছর আগের সরকারি হিসাবেই, ভারতবর্ষ ছিল অন্তত ১০,৪২,৮১,০৩৪ জন আদিবাসীর বাসভূমি; যা মোট জনসংখ্যার ৮.৩৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৩৭ কোটি থেকে ৫০ কোটি মানুষই আদিবাসী সমাজের। অর্থাৎ, লক্ষলক্ষ কোটি টাকা ব্যয় ক'রে অভূতপূর্ব ও বিপুল মারণাস্ত্র সৃষ্টিকারী প্রযুক্তির মালিকরা আদিম-সভ্যতার জনক এই মানুষগুলোর প্রতি নিজেদের মানবিক কর্তব্য পালন সম্পর্কে সবসময়েই মুখর থাকে বটে, কিন্তু কখনোই তৎপর হয়নি।
প্রশাসনিক আগ্রাসনের প্রথম স্তর মিথ্যা প্রচার; দ্বিতীয় স্তর ভয় দেখানো। এই দুইয়ে কাজ না হ'লে, তৃতীয় স্তরে লাঠি-গুলি-গ্রেপ্তারের দাওয়াই শুরু হয়। ভারতবর্ষে এটাই সাধারণ দস্তুর। দেউচা-পাচামিতেও তথাকথিত 'উন্নয়ন'-এর মিথ্যা প্রচার অনেকদিন শুরু হয়ে গেছে, এবং চলছে। নানাভাবে ভয় দেখানোও শুরু হয়েছে, এবং চলছে। এই দুইয়ে আশানুরূপ ফল না মেলায়, এবার শুরু হয়েছে লাঠির দাওয়াই। প্নিরস্ত্র নারীদের উপর পুলিশ বাহিনী যথেচ্ছ লাঠিপেটা ক'রে ইতিমধ্যেই তাদের বীরপুঙ্গব ভূমিকা পালন করেছে।
রাষ্ট্র-সেবার চক্করে পড়ে যে কমিউনিস্টরা/ বামপন্থীরা অনেক সময়েই জনবিরোধী কাজ করেছেন, তাঁদের তো আদিবাসীদের পাশে থাকাই স্বাভাবিক। আর 'বাম' আমলে যে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব হকার উচ্ছেদের প্রতিবাদে রাস্তায় বসে মাল বিক্রির নাটক করেছিলেন, তারাই ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার পর থেকে একের পর এক অমানবিক উচ্ছেদের কাজে তৎপর হয়ে উঠেছেন। "যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ।" এরাই এখন বীরভূমে কালো সোনার লোভে আদিবাসী সহ সকল শ্রমজীবী মানুষকে উচ্ছেদের পরিকল্পক ও নায়ক।
দেউচা-পাচামি অঞ্চলে আদিবাসী সমাজের কেউ কেউ হুমকি-ধমকিতে অসহায় হয়ে সরকারি ফর্ম জমা দিতে বাধ্য হলেও, সেখানে মহিলা জমায়েতে আওয়াজ উঠেছে, "ফরম চাই না। ফরম নিয়ে এলে ছিঁড়ে ফেলে দেবো।" শোনা যাচ্ছে, "জান চলে যাবে। জমি নিতে দেবো না। এক কোদালও মাটি চটাতে দেবো না।" পুলিশী অত্যাচারের পরেও মহিলারা বারবার সভা করছেন, মিছিল করছেন। পরিস্কার ভাষায় তাঁরা জানাচ্ছেন, "কয়লা খনি নিয়ে যারাই দালালি করতে আসবে, তাদের আলাদা ব্যবস্থা হবে।" তীর-ধনুক, টাঙ্গি, কাস্তে, ডান্ডা, ঝাঁটা হাতে মহিলারা বারবার বলিষ্ঠ শ্লোগান তুলছেন, "কোয়লা খুনি চাই না/ খুনি কোরতে দিবো না।" তাঁদের স্পষ্ট উচ্চারণ, "একজনও দেখাতে পারবেন না, যে খনি চায়। যাদের দিয়ে খনির কথা বলানো হচ্ছে তাদের ভাড়া করে আনা হয়েছে।"
এখানে গড়ে উঠেছে "ভূমিরক্ষা কমিটি"। ব্যক্তি কমিউনিস্ট, কমিউনিস্ট সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, কৃষক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, মহিলা সংগঠন, আদিবাসী সংগঠন ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছে বৃহত্তর মোর্চা। খনির বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে গণ-আন্দোলন। মিছিল, সভা, সরকারি দপ্তরে বিক্ষোভ, সবই চলছে। খবরে প্রকাশ, পুলিশী অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাবধানবাণীর পোস্টারও পড়েছে। এবং সরকারি নির্দেশ এসেছে, "সমস্ত জমির রেজিস্ট্রেশন বন্ধ।" মনে হয় রাষ্ট্রযন্ত্র ও সমাজ, ক্রমশই সম্মুখসমরে জড়িয়ে পড়ছে।
 আদিবাসী জনতার মেজাজ দেখে সরকারি অফিসাররা ভীত, মন্ত্রীমহল দুশ্চিন্তিত। আন্দোলনের দাপটে স্থানীয় অফিসের বদলে ফর্ম বিলির কাজ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দূরে, সিউড়িতে। আন্দোলনে ক্রমশই জড়ো হচ্ছেন আশপাশের নানা অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের দল। ক্রমবর্ধমান সমর্থনের এবং গণকন্ঠে উচ্চারিত ঝাঁঝালো মানসিকতার ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে 'উন্নয়ন'-এর কান্ডারিদের। আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে সেই বস্তাপচা "বহিরাগত" তত্ত্বের প্রচারও শুরু করেছে সরকারপক্ষ। যেন, সুদূর কলকাতায় বসে 'উন্নয়ন'-এর নির্দেশ জারি করা সরকারি মাতব্বররা সকলেই 'স্থানীয়'! এখানকার বাস্তবিক মা-মাটি-মানুষ যেভাবে রুখে দাঁড়াচ্ছেন, তাতে শাসকূলের ঘুম ছুটে যাবার হাল হয়েছে।
বীরভূমে সভ্যতা-অসভ্যতার এই সাম্প্রতিক অসম লড়াইয়ে পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। সমাজের 'প্রগতিশীল' বিদ্বজ্জনেরা আদিবাসী সভ্যতা কিম্বা আধুনিক অ-সভ্যতা, কোন পক্ষে দাঁড়ান সেটাও এখন দেখার।


রাজনৈতিক দুর্বুদ্ধিকে আটকানো যাবে কীভাবে!




পরাধীন ও স্বাধীন, দুই অবস্থাতেই যুগের পর যুগ ভারতবর্ষের শাসকরা বিভিন্ন রকম 'উন্নয়ন'-এর স্বার্থে আদিবাসী সহ অগণীত মানুষকে তাঁদের ভিটেমাটি ছাড়া করেছে রাজনৈতিক দুর্বুদ্ধি এবং সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি চালিত হয়ে। কিন্তু উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলির মর্যাদাপূর্ণ পুনর্বাসন নিয়ে কখনোই তারা মাথা ঘামাননি। গত দশক পর্যন্ত, সমস্ত উচ্ছেদ হয়েছে কোনও জাতীয় পুনর্বাসন নীতি ছাড়াই! ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের তৈরি, ১৮৯৪ সালের আইনই ছিল ভারতীয় শাসকদের হাতিয়ার। পশ্চিমবঙ্গেও আমরা দেখেছি, কলকাতাকে কেন্দ্র ক'রে কোনওরকম পুনর্বাসন পরিকল্পনা ছাড়াই ১) মেট্রোরেলের সম্প্রসারণ, ২) গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান, ৩) খালের সংস্কার, ৪) 'অপারেশন সানশাইন'-এর নামে হকার উচ্ছেদ, ৫) পূর্ব কলকাতার আঞ্চলিক উন্নতি, এবং ৬) রাজারহাট-নিউ টাউনশিপ, এই ছয়টি সরকারি 'উন্নয়ন' উদ্যোগের ফলে অন্তত একলক্ষ ছয় হাজার আটশো আশি জনের অমানবিক উচ্ছেদের করুণ বাস্তবতা। ('সাম্প্রতিক কলকাতা: পরিকল্পনা, উন্নয়ন, উচ্ছেদ'; কেয়া দাশগুপ্ত, নাগরিক মঞ্চ, ২০০৪ দ্রষ্টব্য।) এরপরও, রবীন্দ্র সরোবর অঞ্চল থেকে দুই প্রজন্ম ধরে বসবাসকারী কয়েকশো মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে। আর বর্তমান সময়ে আমরা দেখতে শুরু করেছি বীরভূমের দেউচা-পাচামির অমানবিক উচ্ছেদ পর্ব।
প্রশাসনিক যেকোনও সিদ্ধান্তেরই পক্ষে-বিপক্ষে নানারকম মতামত থাকে। এটাই স্বাভাবিক। হাল আমলে এসে, দেউচা-পাচামি কয়লা ব্লকে খনি তৈরির বিপক্ষেও প্রচুর সুনির্দিষ্ট, বিজ্ঞানসম্মত ও তথ্যভিত্তিক মতামত প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু সরকারি পক্ষ থেকে শুধুমাত্র "উন্নয়ন" এবং "কর্মসংস্থান"-এর ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া, কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছেনা!
সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয় হ'লো, কেন্দ্রীয় সরকার দেউচা-পাচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিনসিঙ্ঘা কয়লা ব্লকের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলেও কখনোই তা নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। এগারো বছর আগেই (মার্চ ২০১১) কয়লা মন্ত্রকের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন, কোল ইন্ডিয়া এ'ব্যাপারে মাথা গলাবে না। ঘাড় থেকে বোঝা নামানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ু সরকারকে কয়লা উত্তোলনের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু এই খনি লাভজনক হবেনা ব'লে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ু সরকারও রাজি হয়নি। একমাত্র পশ্চিমবঙ্গ সরকারই তখন, ১৯১৮ সালে, "পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়ন"-এর স্বার্থে রাজি হয় এই কয়লা খনি তৈরির দায়িত্ব নিতে!
ব্যাপারটা কী? মাটির নিচে এতো কালো সোনা থাকলেও, কেউই কেনো আগ্রহ দেখালো না! আসলে লাভ-ক্ষতির হিসেব কষতে বসলে দেখা যাচ্ছে 'লাভ' কিছুই নেই, সবটাই 'ক্ষতি'।
১) এখানের কয়লা 'সি' এবং 'জি' মানের। অর্থাৎ অতি নিম্নমানের। তবে এই কয়লার গঠনশৈলী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, যা ভারতবর্ষের আর কোথাও নেই।
২) কয়লা আছে প্রায় ২২৫ থেকে ২৪৫ মিটার (৭৩৮ থেকে ৮০৪ ফুট) পুরু আগ্নেয়শিলার অত্যন্ত কঠিন এক স্তরের নিচে। যা ভেদ করার মতো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ভারতবর্ষে নেই। বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং বিশেষজ্ঞ এনে কয়লা তুলতে গেলে 'ঢাকের দায়ে মনসা বিকানো'-র অবস্থা হবে। আর পুরো দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে তুলে দিলে পুরো সম্পদই হবে লুঠ।
৩) এখনও পর্যন্ত প্রচন্ড শক্ত আগ্নেয়শীলার মধ্য দিয়ে কয়েকটি গর্ত খুঁড়ে পরীক্ষা চালিয়ে কয়লা সংক্রান্ত প্রাথমিক কিছু তথ্য পাওয়া গেছে মাত্র। এর উপর নির্ভর ক'রে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প রূপায়িত করতে যাওয়া জুয়াখেলার নামান্তর। সঠিক চিত্র বুঝতে গেলে, প্রচুর অর্থব্যয় ক'রে আরও অনেক 'বোরহোল' পদ্ধতিতে খোঁজখবর চালাতে হবে। তবেই মজুত কয়লার পরিমাণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে।
৪) খনি তৈরি করতে গেলে আগ্নেয়শিলার পুরু ও শক্ত স্তর ভাঙার জন্য বিস্ফোরণের কাজে যে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকের ও অন্যান্য রাসায়নিকের ব্যবহার অনিবার্য হবে, একের পর এক ভয়ঙ্কর আওয়াজের যে ঢেউ সৃষ্টি হবে, ভূগর্ভে সঞ্চিত যে মিথেন গ্যাস বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়বে, এবং অন্যান্য বিবিধ কারণেও পরিবেশের যা ভয়ঙ্কর ক্ষতি হবে, তা এখন খনিপন্থীরা বুঝতেও পারছেন না। আদৌ বুঝতে চাইছেন কিনা, তা-ও বোঝা মুশকিল!
৫) অত্যাধুনিক এবং বিশাল খোলামুখ কয়লা খনি তৈরির ফলে বহুদূর পর্যন্ত কূয়া, পুকুর, জলাশয় ইত্যাদি শুকিয়ে গিয়ে সৃষ্টি হবে এক বিশাল শুকনো অঞ্চল। এর অনিবার্য ও ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে স্থানীয় জীব-বৈচিত্র্যের উপর; প্রাকৃতিক ভারসাম্য তছনছ হয়ে যাবে।
৬) বিভিন্ন কারণে অনিচ্ছাকৃত ও বাধ্যতামূলকভাবে মানুষের ছিন্নমূল হওয়া, আধুনিক 'উন্নয়ন'-অভিযানের ভয়াবহ ফলাফল। ছিন্নমূল মানুষগুলির জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট পুনর্বাসন পরিকল্পনা ছাড়াই চলে প্রশাসনিক কর্তাদের মর্জিনির্ভর এই 'উন্নয়ন'!
৭) সাম্প্রতিককালে, গোটা বিশ্বজুড়ে কয়লা ব্যবহারের বিরুদ্ধে গণকন্ঠ তীব্রতর হয়ে উঠছে। পরিবেশ-রক্ষাকারী কর্মীগণ এবং বিজ্ঞানীরা অপ্রচলিত শক্তি ব্যবহারের জন্য নিবিড় প্রচার আর গভীর গবেষণায় ব্যস্ত রয়েছেন বছরের পর বছর। সে'দিকে নজর না দিয়ে, আত্মনাশা কয়লা খনি সৃষ্টির জন্য নতুন তৎপরতা যে নেহাতই রাজনৈতিক দুর্বুদ্ধির পরিচয়, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
ইতিমধ্যেই সরকারি পক্ষ থেকে "কর্মসংস্থান" সংক্রান্ত যাকিছু বলা হচ্ছে, তা কেবলই সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কথার ফানুস। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, আগ্নেয়শিলার স্তর ভেদ ক'রে শেষপর্যন্ত খনি শুরু হ'লো। তখন, এই বিশাল ও গভীর খোলামুখ কয়লা খনি অত্যন্ত আধুনিক যন্ত্রনির্ভর হ'তে বাধ্য। মোট 'মানুষ' কতজন লাগবে, সেটাই প্রশ্ন। 'কর্মসংস্থান' এক্ষেত্রে নেহাতই মিথ্যার ঢাক এবং রূপকথার গল্পমাত্র।
বংশগত বাসভূমি থেকে, প্রথাগত সংস্কৃতি চর্চার আবহ থেকে, জীব-বৈচিত্র্যগত প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে, ঐতিহ্যগত অর্থনৈতিক জীবন থেকে, - বাধ্যতামূলকভাবে উচ্ছেদ ক'রে আদিবাসীদের তথাকথিত "ক্ষতিপূরণ"-এর লোভ দেখানো অমার্জনীয় সামাজিক অপরাধ। প্রশাসনিক অ-সভ্যতার কদর্য নজির।
দেউচা-পাচামি কয়লাখনি প্রকল্প রূপায়ণ করতে গেলে আদিবাসী সমাজ সহ সকলেরই সর্বনাশ, পরিবেশের ভয়ঙ্কর ক্ষতি, এবং সরকারেরও অর্থনাশ। তা সত্বেও, নিজেদের 'উন্নয়নের কান্ডারি' হিসাবে মিথ্যা প্রচারের তাগিদে এমন বে-আক্কেলে দুর্বুদ্ধিকে আটকানোর 'গণতান্ত্রিক' পথ কিছু আছে কী? না যদি থাকে? সকলেরই ভেবে দেখা দরকার।


শাসকের বোধগম্য ভাষায় কথা বলাই দরকার।




সমাজের কোনও অংশ তাঁদের ন্যায্য দাবি উত্থাপন করলে, বর্তমান প্রশাসন তাকে অমার্জনীয় ঔদ্ধত্যের সাথে কুকুরের "ঘেউ ঘেউ" ব'লে অপমান করতে দ্বিধা করে না। ছাত্রছাত্রী, নারীকর্মী, নার্স, ডাক্তার থেকে শুরু ক'রে সকল আন্দোলনকারীদের কেবলমাত্র পিটিয়ে ঠান্ডা করার রাস্তাই বর্তমান রাজ্য-প্রশাসন জানে। প্রতিবাদী কষ্ঠস্বর ধ্বনিত হতে পারে, এমন সভার অনুমতিই দেওয়া হয়না। দেউচা-পাচামির কয়লা খনি নিয়ে এই আগ্রাসী প্রশাসনের হঠাৎ শুভবুদ্ধির উদয় ঘটবে, এমনটা আশা করা, মনে হয়, দিবাস্বপ্ন দেখারই নামান্তর। গত ৬ জানুয়ারি জেলাশাসক বিধান রায় গিয়েছিলেন স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে "আলোচনা" করতে। যে গ্রামগুলো উচ্ছেদ হবে এবং এতদিন যাঁদের প্রতি ফিরেও তাকায়নি প্রশাসন, সেখানে গিয়ে পাথুরে জায়গার উপযোগী রাস্তা, বাড়ি বাড়ি পানীয় জল, চাষের জন্য নদী-নালার জল, টোলায় টোলায় গিয়ে শিশুদের পড়ানোর ব্যবস্থা, ইত্যাদি চমৎকার চমৎকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন তিনি! বলেছেন, "অধিক উন্নয়ন করতে হবে। তাই এখন কয়লার চর্চা সরিয়ে রাখি। উন্নয়নের কথা বলি।" জনবিরোধী আধুনিক 'সভ্যতা'-র ধুরন্ধর প্রতিনিধি একেই বলে!
কথায় বলে "কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।" দেউচা-পাচামির কয়লা খনি হ'লে দেশি-বিদেশি যন্ত্র বেচা কোম্পানিগুলো, আগামীদিনের কয়লা মাফিয়া চক্র, 'উন্নয়ন'-এর স্বপ্ন ফেরি করা স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক শক্তি ইত্যাদি, এদের অবশ্যই পৌষমাস। আর আদিবাসী সমাজ সহ যাঁরাই উচ্ছেদ হবেন, জমিজমা এবং জীবিকা হারিয়ে মনুষ্যেতর জীবনযাপনে বাধ্য হবেন, তাঁদের সকলেরই সর্বনাশ। এই দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব, বিরোধ, সংঘাত, সংঘর্ষ এড়ানোর কোনও 'গণতান্রিক' পথ আছে কী!
সরকারের এই দুর্বুদ্ধির বিরুদ্ধে, বিশেষভাবে বিভিন্ন কমিউনিস্ট / বামপন্থী শক্তি জড়ো হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক। রাষ্ট্রীয় স্বার্থে বহু বিচ্যুতি ও অপরাধ করা সত্ত্বেও, এঁদের অনেকেই বাংলা তথা ভারতবর্ষের বুকে আদিবাসী সহ সকল দমিত-নিপীড়িত জনগণের স্বার্থে লড়াই-সংগ্রাম-আত্মবলিদানের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের উত্তরসূরি। আগ্রাসী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে, দেউচা-পাচামির ভূমিসন্তানদের লড়াইয়ে এঁদের সম্মিলিত ও ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা নিঃসন্দেহেই কাম্য। প্রশাসনিক পেশীশক্তির অবাঞ্ছিত ও আধিপত্যবাদী ভাষার জবাব জোটবদ্ধ গণরাজনৈতিক সংগ্রামের কাঙ্ক্ষিত ভাষাতেই হওয়া প্রয়োজন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.