বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

নির্বাচনী জালিয়াতির উত্তরাধিকার!

নির্বাচনী জালিয়াতির উত্তরাধিকার!

দীপক পিপলাই

photo

শ্রমজীবী ভাষা ১ জানুয়ারি, ২০২২— সংসদীয় রাজনীতির অঙ্গ 'গণতান্ত্রিক নির্বাচন'-এ জাল-জালিয়াতি-জোচ্চুরি নতুন কিছু না। সারা পৃথিবী জুড়েই কমবেশি এই একই অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ হয়ে চলেছে দীর্ঘদিন যাবৎ। একদিকে 'গণতন্ত্র'-র সুগন্ধি স্বপ্ন ফেরি, পাশাপাশি জালিয়াতি-জোচ্চু্রির কটু গন্ধ। খোদ আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়েও অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের ঝড় উঠেছে বারবার। ভারতবর্ষেও এ'সবের ইতিহাস বহু পুরানো। ব্রিটিশ আমল থেকেই চলে আসছে। প্রধান প্রধান সব রাজনৈতিক দলই এ'ব্যাপারে কমবেশি অপরাধী হ'লেও, কংগ্রেস নেতাদের এ'বিষয়ে ঐতিহ্যমন্ডিত পারদর্শিতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সংসদীয় কাঠামোর অধীনে এমন কোনও নির্বাচন এখানে হয় না, যা "ফ্রী অ্যান্ড ফেয়ার।" দুর্নীতি থাকেই। কম বা বেশি। প্রকাশ্য কিম্বা অপ্রকাশ্য। লোকসভা, বিধানসভা, পৌরসভা, পঞ্চায়েত - কোনওদিন কোনও ভোট-ই ১০০% "গণতান্ত্রিক" হয়না। 'জাল ভোট'; 'রিগিং'; 'সাইন্টিফিক রিগিং'; 'বুথ জ্যাম'; টাকা/মদ বিলি ক'রে ভোটারদের প্রভাবিত করা; বলপ্রয়োগে- গুলি চালিয়ে অথবা কব্জি কেটে নিয়ে কিম্বা বোমা মেরে বা ডান্ডাপেটা ক'রে অথবা ভয় দেখিয়ে কিম্বা আটকে রেখে ভোটদানে বাধা দেওয়া ইত্যাদি, সবকিছুই হয়। সবই 'পার্ট অব্ দ্য গেম', খেলার অঙ্গ। এই "খেলা"-য় যারা যতো বেশি দক্ষতা অর্জন করতে পারে, "খেলা"-র ফলাফল ততো ভালো হয় তাদের! 'জনমত' এখানে অর্থহীন এক আনুষ্ঠানিক শব্দবন্ধ মাত্র! ভোটের ফলাফলে কতটা দুধ আর কতটা জল, তা কেউ কোনদিনই বলে পারেনা!
কিন্তু তার মধ্যেও ফারাক থেকেই যায়। কিছু জালভোট পড়া নির্বাচন আর কিছু ঠিক ভোট হওয়া নির্বাচন, এই দু'য়ের তফাৎটা বড়োই বেমানান! ১৯৭২ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে যে অভূতপূর্ব নজির তৈরি হয়েছিল কংগ্রসী আমলে, তার তুলনা মেলা ভার। সকাল ৭-টায় যখন বুথ খুললো, দেখা গেলো ব্যালট বাক্স ভর্তি, সব ভোট হয়ে গেছে! একটা বুথে নয়, বুথের পর বুথে, দিকে দিকে এই নির্বাচনী প্রহসন সংগঠিত হয়েছিল। এবং সেই "গণতান্ত্রিক ফলাফল"-এর ভিত্তিতেই ক্ষমতায় বসেছিল মহামহিম সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে গঠিত কংগ্রেসী সরকার।
সেই নাটকীয় 'ভোট'-এর অনেকটাই যেন পুনরাভিনয় আবার আমরা দেখতে পেলাম কলকাতা পৌরসভার সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে। যুগ পাল্টেছে। পরিস্থিতি বদলেছে। অতীত ঘটনাবলীর হুবহু কার্বনকপি আর হয়তো সম্ভব না। তাই ভড়ংয়ের বদল বাধ্যতামূলক। "সব আসন" দখলের লক্ষ্যে নতুন নতুন 'কৌশল' উদ্ভাবনও অনিবার্য।
আসলে, যে স্তরেই হোক, কংগ্রেসী ঘরানায় "ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার" নির্বাচন ব্যাপারটাই সম্ভবত তাদের কল্পনারও বাইরে! ইতিহাস সে'কথাই বলে।
১৯২৬ সালের ১৩ জুন বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটির নিজস্ব সাংগঠনিক সাধারণ সভায় "হিন্দু-মুসলিম প্যাক্ট"-এর পক্ষে-বিপক্ষে যে ভোটাভুটি হয়, তাতে ভোট পড়ে ৩৪৬-টি। অথচ, সেদিন পর্যন্ত কংগ্রেসের তালিকাভুক্ত সদস্য ছিলেন ৩৩০ জন। অর্থাৎ, ১৬-টি জালভোট সহ, মোট ভোটের ভিত্তিতে, "হিন্দু-মুসলিম প্যাক্ট"-এর বিপক্ষে 'সংখ্যাগরিষ্ঠ' ভোট পড়েছিল। সেদিনের সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন ব্যারিস্টার যোগেশ চৌধুরী; উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সরোজিনী নাইডু এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। স্বয়ং সরোজিনী নাইডু এই ভেজাল ভোটসম্পন্ন সভার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বলেছিলেন, "এই হিন্দু-মুসলিম চুক্তির বিরোধিতা করে আপনারা দ্বিতীয় বঙ্গ বিভাগের সূচনা করেছেন।" (বই: 'স্বাধীনতার ফাঁকি'; বিমলানন্দ শাসমল, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৯১, পরিবেশনা - হিন্দুস্তান বুক সার্ভিস, ১৮৩ লেনিন সরণী, কলকাতা ৭০০ ০১৩, পৃ: ১২৫-১২৬ দ্রষ্টব্য।)
আমরা এখন বীভৎসতায় জালিওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের চেয়েও ভয়ঙ্কর, ১৯৭১ সালের ১২-১৩ অগাস্ট বরাহনগর-কাশীপুর অঞ্চলে সংগঠিত অন্তত ২৫০ জনের গণহত্যার নায়ক সিদ্ধার্থ রায়ের রাজনৈতিক মন্ত্রশিষ্যার রাজত্বেই আছি। যিনি ছিলেন কংগ্রসী ঘরানার মধ্যেও চরমতম প্রতিক্রিয়াশীল এবং রিগিং সম্রাট, সেই সিদ্ধার্থশঙ্করের প্রতি বর্তমান প্রশাসনিক প্রধান ঘোষিতভাবেই শ্রদ্ধাশীল। তাই একদিকে দেখতে পেলাম নেতৃত্বের তরফ থেকে অবিরাম অভয়বাণী বর্ষণ, অপরদিকে বুথের পর বুথে লাগাতার সুপরিকল্পিত ভোটলুঠ! রাজ্যবাসী তথা ভারতবাসী জনগণ এই নির্বাচনী প্রহসন সরাসরি দেখতেও পেলেন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে।
২৫ জুন ১৯৭১, পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি ক'রে, কংগ্রেসী শাসন কায়েমের উদ্দেশ্যে রাজ্যের দপ্তরবিহীন তদারকি মন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছিল সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে। তার প্রত্যক্ষ তদারকিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালের উপরোল্লিখিত সেই অভূতপূর্ব 'নির্বাচন'। সদ্যসমাপ্ত কর্পোরেশন নির্বাচনেও, পুলিশ নামক বিপুল ক্ষমতাশালী শক্তিটি, কার্যত ১৯৭২ সালের মতোই, ভোট-লুঠেরাদের মদতদাতার ভূমিকা পালন করে গেলো। এবং হুবহু সিদ্ধার্থ জমানার মতোই পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা ক'রে স্বয়ং পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী বললেন, "কলকাতা পুলিশ খুব ভালো কাজ করেছে।"
ফলাফল, ৯৩% আসনেই শাসকদলের 'জয়।' কথায় আছে, "জো জিতা ওহি সিকান্দার"!
এই গণতান্ত্রিক নির্বাচন(!)কে ঘিরেই সংবাদমাধ্যমে চললো নানা সমীক্ষা; "প্রাপ্ত ভোট"-এর শতকরা হারের হিসেবনিকেশ; কাদের ক'টা আসন বাড়লো/কমলো তাই নিয়ে গভীর 'নিরপেক্ষ' চর্চা; নির্বাচন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা; এবং, স্বাভাবিকভাবেই, ক্ষমতাসীন প্রশাসনের তরফে উচ্ছাসের বন্যা!
নির্বাচনে জালিয়াতি ছাড়াও, কলকাতা কর্পোরেশনের ইতিহাসে কংগ্রেসী মাতব্বরদের কলঙ্কিত কীর্তিকলাপও মনে রাখার মতো! পরবর্তীকালে অনেকের কাছে 'শ্রদ্ধেয়' বিধানচন্দ্র রায় একসময়ে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন। অবিভক্ত বাংলা সহ সারা ভারতবর্ষ তার বহুদিন আগে থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে উত্তাল। ক্ষুদিরাম বসু, যতীন মুখার্জী ('বাঘা যতীন') প্রমুখ শহীদের আত্মবলিদানে বাংলা তখন প্রাণ বিসর্জনের মহোৎসবে মাতাল। ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুখদেব প্রমুখের আত্মবলিদানে রক্তস্নাত হয়ে উঠছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। তখন (১৯৩২), ইংরেজ পুলিশ কমিশনারের হুকুম মেনে, মেরুদন্ডহীনের মতো, কর্পোরেশন ভবনের উপর থেকে বিধানচন্দ্র জাতীয় পতাকা টেনে নামিয়েছিলেন। বিধান রায়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন, কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরুও এই ঘটনা সম্পর্কে তাঁর আত্মজীবনী (Autobiography)-তে লিখেছিলেন, "যারা এইভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল তারা সমগ্র জাতির নৈতিক শক্তিকে অধংপতিত করেছিল এবং জাতির আত্মসম্মানকে আহত করেছিল।"
গবেষকের এ'রকম মন্তব্যও পাওয়া যায়, ১) "কর্পোরেশনে ঘুষের রাজত্ব চিত্তরঞ্জন দাশের আমল থেকেই শুরু হয়। কিন্তু চিত্তরঞ্জনের খ্যাতির জ্যোতিতে এ-ব্যাপারটা ঢাকা পড়ে যায়।" ২) "চরিত্র-হননের আদর্শকে রূপায়িত করেছিলেন আমাদের দেশের প্রিয় নেতা চিত্তরঞ্জন দাশ, বিধানচন্দ্র রায় ও তাঁদের অনুচরবর্গ।" ('স্বাধীনতার ফাঁকি', পৃ: ১০২, ১০৬ দ্রষ্টব্য।)
১৯২৬ থেকে ১৯৩২ হয়ে ১৯৭২ পার ক'রে এখন ২০২১ খ্রিস্টাব্দ। ৯৫ বছর অতিক্রান্ত। কংগ্রেসী ঐতিহ্য অনুযায়ী জালভোটের এবং দুর্নীতির "সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।" এবং যতো দিন যাচ্ছে, এই প্রবণতা বেড়েই চলেছে। পশ্চিমবঙ্গে 'গণতন্ত্র'-র এমনই বিকাশ ঘটেছে যে, বর্তমানে লোকসভা, বিধানসভা, পৌরসভা, পঞ্চায়েত, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, ইস্কুল - মারদাঙ্গা রক্তারক্তি ছাড়া কোনও 'নির্বাচন'-এর সম্ভাবনা কারও কল্পনাতেও আসে না! লাশ গোণাও বহুক্ষেত্রে নির্বাচনী "খেলা"-র স্বাভাবিক অঙ্গ হয়ে উঠেছে!
২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর, মগরাহাট থানার নৈনান গ্রামে পুলিশের গুলিতে দু'জন মহিলার মৃত্যু; বাসিন্দাদের সাথে কোনওরকম আলোচনা কিম্বা তাঁদের পুনর্বাসনের কোনও ব্যবস্থা না করেই, ২৯ মার্চ ২০১২ সালে সরকারি উদ্যোগে নোনাডাঙার বস্তি গুঁড়িয়ে ও পুড়িয়ে দেওয়া; ২০১৩ সালের ৭ জুন, কামদুনির কলেজছাত্রী অপরাজিতাকে ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা স্থানীয় গণআন্দোলনকে "মাওবাদী প্রভাবিত" তকমা দেওয়া এবং এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে আন্দোলনরত স্থানীয় জনগণকে মুখ্যমন্ত্রীর "শাট্ আপ" হুমকি; ২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, রাণীনগর থানা লকআপে শারীরিক নির্যাতনে রাজীব মোল্লার মৃত্যু; ২২ নভেম্বর ২০১৫, নৈহাটির হুকুমচাঁদ জুটমিলে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থানরত শ্রমিকদের উপর পুলিশের হামলা ও গ্রেপ্তার; - সিদ্ধার্থশঙ্করের অনুগামী এবং কংগ্রেসের ঐতিহ্যবাহী সরকারের অজস্র 'গণতান্ত্রিক' কীর্তির কয়েকটি নমুনা মাত্র!
যোগেশ চৌধুরী থেকে বিধান রায় হয়ে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ঘুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রজন্ম নির্বিশেষে জালিয়াতির উত্তরাধিকার! সামনের দিনগুলোতে, ভোট-জালিয়াতির আর কী কী নতুন গণতান্ত্রিক(!) অভিজ্ঞতা বাংলার জনগণের জন্য অপেক্ষা করে আছে, দেখা যাক!

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.