বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
(এক)
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ নভেম্বর, ২০২১— একটা শব্দ আজকাল খুব বেশি ব্যবহার হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতিতে। "ফ্যাসিস্ট"। ভোটের আগে, ভোটের সময়ে, ভোটের পরে - সবসময়েই শব্দটা শোনা যাচ্ছে। বর্তমানে এই শব্দটার মূল লক্ষ্য কেন্দ্রীয় শাসক দল, বিজেপি। বিগত শতাব্দীতে সত্তরের দশকে যেমন চালু হয়েছিল একটা শব্দ, "আধা-ফ্যাসিস্ট"। তখন তার লক্ষ্য ছিলো কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কংগ্রেস দল। বিজেপি দলের পূর্বতন রূপ, অর্থাৎ চরম দক্ষিণপন্থী সংগঠন আরএসএস-এর শাখা 'জনসঙ্ঘ'-র সহযোগে গড়ে ওঠা 'জনতা পার্টি', তখন 'আধা-ফ্যাসিস্ট' শক্তিকে বিরোধিতার তাগিদে হঠাৎ হয়ে উঠেছিলো "গণতান্ত্রিক" শক্তি! এই 'জনতা পার্টি' ও 'বামপন্থী' শক্তির মধ্যেও তখন "কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম"-এর ভিত্তিতে ১৯৭৭ সালে গড়ে উঠেছিল রাজনৈতিক হাতধরাধরি। আরএসএস বাহিনী বেশ বড় সংখ্যায় গিয়ে ঢোকার সুযোগ পেয়ে গেলো পার্লামেন্টে। ১৯৮০ সালে আবার 'জনতা পার্টি' ভেঙে গড়ে ওঠলো জনসঙ্ঘর নতুন চেহারা ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’, সংক্ষেপে বিজেপি। তাদের সঙ্গে নিজেদের জন্মলগ্ন থেকেই (১৯৯৮) হৃদ্যতা ও বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো পশ্চিমবঙ্গের 'তৃণমূল কংগ্রেস' দলের। এই নব্যগঠিত দলের সুপ্রীমো বারবার বিজেপি দলের হাত জড়িয়ে ধরেছেন; তাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কেন্দ্রীয় সরকারে মন্ত্রী হয়েছেন; আরএসএস সংগঠনকে 'দেশপ্রেমিক' আখ্যা দিয়েছেন; তাঁর দলের অন্যদেরও বিজেপি সরকারে মন্ত্রী করেছেন; বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে ডেকে নিয়ে এসেছেন নিজের দলীয় স্বার্থে। কিন্তু বর্তমানে পাশার দান গেছে উল্টে! বিজেপি-র বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় ভোটের লড়াই করতে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস দল হয়ে উঠলো হঠাৎ 'বিজেপি-বিরোধী'! এবং "ফ্যাসিস্ট"-দের বিরুদ্ধে গড়ে উঠলো 'বাম' এবং এককালের "আধা-ফ্যাসিস্ট" কংগ্রেস দলের হাতধরাধরি! কারণ, রাজনীতি নাকি "সম্ভাবনার কারবার"!
'নীতি', 'আদর্শ' এসব অবশ্য সংসদীয় রাজনীতির জগতে চিরকালই অচল। যেভাবেই হোক, নিজেদের আখের গোছানোই সেখানে মূল লক্ষ্য। তাই দেখা যায়, নগ্নভাবে কর্পোরেট-সেবী বিজেপি-র বিরুদ্ধে যখন বিরোধী দলগুলি সম্প্রতি দেশজুড়ে ধর্মঘট করলেন, তথাকথিত 'বিজেপি-বিরোধী' তৃণমূল সুপ্রীমো তখন সেই দাবিগুলোকে মৌখিকভাবে "নীতিগতভাবে সমর্থন" দিলেন; কিন্তু কার্যত বিজেপি-র দোসর হিসাবে সরাসরি ধর্মঘটের বিরোধিতা করতেও ভুললেন না।
কারা ও কখন যে 'ফ্যাসিস্ট', কেন তারা 'ফ্যাসিস্ট', এবং কারা ও কখন যে 'ফ্যাসিস্ট-বিরোধী', এ'সব বোঝা দুষ্কর! তার কোনও তাত্ত্বিক বা প্রায়োগিক ব্যাখ্যাও অবশ্য কখনোই নেতা-নেত্রীদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। মজার কথা, সব দলই কোনও না কোনও সময়ে অন্য কোনও দলের বিচারে "ফ্যাসিস্ট" হয়ে যাচ্ছে! বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিআই(এম)— কেউই বাদ নেই। কেউ "ফ্যাসিস্ট"; কেউ বা "আধা-ফ্যাসিস্ট"; কেউ আবার "সোশ্যাল-ফ্যাসিস্ট"। বিরোধী দল হলেই গায়ে কোনও-না-কোনও ধরনের 'ফ্যাসিস্ট' তকমা লাগবেই!
ভারতবর্ষে নাকি "বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র" অধিষ্ঠান করছে! ফলে, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদেরও সেই 'অধিকার' প্রবল। ভন্ডামি মিথ্যাচার মূর্খতা বিশ্বাসঘাতকতা, সবই তাঁদের 'গণতান্ত্রিক অধিকার'-এর মধ্যে পড়ে! আর ভারতবর্ষ তো 'গুরুভজা' দেশ হিসাবেও পরিচিত! সেই 'গুরু' ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা সামাজিক, যা-ই হোন না কেন! নেতা-নেত্রীরা যা-ই বলুন, ক্যাডার/ কর্মী/ সদস্যরা তাতেই উদ্বাহু হয়ে ওঠেন। কারণ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনোই তাঁদের কর্মীবাহিনীকে সচেতনভাবে যুক্তিবাদী, সাহসী, সৎ ও নীতিনিষ্ঠ হবার শিক্ষা দেন না; বরং নেতৃত্বের অন্ধ-স্তাবক হিসাবেই তাদের গড়ে তোলেন।
তাই আমরা দেখি, সর্বোচ্চ স্তরের কোনও 'কমিউনিস্ট' নেতা যখন একজন নির্লজ্জ পুঁজিবাদীর মতো শ্রমিকদের উপর "হায়ার অ্যান্ড ফায়ার" নীতির পক্ষে প্রকাশ্যই ওকালতি করেন কিম্বা শ্রমজীবীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ঠান্ডা করার চেষ্টা করেন, তখনও দলীয় ক্যাডারদের সমর্থন পেতে তাঁর কোনও অসুবিধা হয়না। বাঙালি নেতৃত্বের মুখ থেকে যখন ১৯৪১ সালে প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ ১৯৪৭ সালে এসে গান্ধীজিকে ফলের রস খাওয়ানোর, কিম্বা ১৮৩৩ সালে প্রয়াত রামমোহন রায় তাঁর মৃত্যুর ২৭ বছর পরে সৃষ্ট 'বেঙ্গল প্রভিন্স'-এর বিধানসভায় এসে সতীদাহ-বিরোধী বিল পেশ করার মতো অপরিসীম মূর্খতাপূর্ণ ও হাস্যকর ভাষণ শোনা যায়, তখনও তাঁর প্রতি গুণমুগ্ধ দলীয় কর্মীদের শ্রদ্ধা অটুটই থাকে। 'দেশভক্ত' বঙ্গ নেতা যখন শান্তিনিকেতনকে রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান বলেন, দলের বাঙালি সদস্যদের মুখে তখনও রা ফোটে না! এই সীমাহীন স্তাবকতাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে, যত্রতত্র এবং খেয়ালখুশি মতো "ফ্যাসিস্ট" শব্দের নির্বিচার ব্যবহার মোটেই অস্বাভাবিক নয়। 'শ্রদ্ধেয় বিদ্বজ্জন' যখন রাজ্যে তেরো জনকে হত্যার ঘটনাকে, ব্রিটিশ আমলে চারশো'র বেশি মানুষকে জালিয়ানওয়ালাবাগে গণহত্যার চেয়েও "ভয়ঙ্কর" বলতে দ্বিধা করেন না এবং এজন্য তিনি সামাজিকভাবে ধিকৃতও হন না, তখন সমাজে এই বোধহীন সমর্থনের মানসিকতার প্রাবল্যই প্রকট হয়ে ওঠে।
ঠিক এইরকম অন্ধ-সমর্থনের পরিবেশই অত্যন্ত প্রয়োজন ফ্যাসিস্ট শক্তির। ইটালীয় সমাজে অসংখ্য 'মুসোলিনি'-র সহযোগিতা ছিল বলেই একজন ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি আমরা দেখতে পাই। জার্মান সমাজের মধ্যে বিপুল সংখ্যক 'হিটলার' তৈরি না হলে তাদের নেতা হিসাবে একজন ফ্যাসিস্ট হিটলার গড়ে উঠতে পারতো না।
(দুই)
কেন্দ্রে অথবা পশ্চিমবঙ্গে, আজ পর্যন্ত এমন কোনও শাসক দলই ক্ষমতায় আসেনি যারা প্রতিবাদী মানুষের উপর দমন-পীড়ন চালায়নি। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষই শাসকের অত্যাচারের আস্বাদ পেয়েছে। দমন, অত্যাচার, জেলে বা লকআপে কিম্বা পুলিশ-হেপাজতে হত্যা, তফাৎ শুধুমাত্র ভুক্তভোগীদের সংখ্যায়। কোনও আমলে তাঁদের সংখ্যা চার অঙ্কের হিসাবে, কোনও আমলে হয়তো তিন বা দুই অঙ্কের কোঠায়। কিন্তু তার মানেই কী এই, শাসকরা সকলেই 'ফ্যাসিস্ট'?
কংগ্রেসী আমলে লাঠি-গুলি-জেল-বন্দীহত্যা ছাড়াও, পুলিশ ও দলীয় কর্মীদের হাতে কয়েক হাজার মানুষের বীভৎস হত্যালীলা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি বিরোধীদের অসংখ্য মিটিং, মিছিল, সমাবেশ, বিক্ষোভ, প্রকাশ্য ইস্তাহার - গণবিক্ষোভের নানা প্রকাশও ঘটেছে। এসব কী ফ্যাসিবাদী শাসনে সম্ভব?
'বামফ্রন্ট' শাসনে যতই আক্রমণ, অত্যাচার, হত্যা, লকআপে মৃত্যু ঘটুক না কেন, "চলমান কৃষিবিপ্লব"-এর সমর্থনে কলকাতার সিধু-কানু ডহরে কয়েকশো মানুষের প্রকাশ্য ও আইনী সমাবেশ কী শাসকদের ফ্যাসিস্ট চরিত্রের নজির?
তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে যতই হিংসা হামলা গ্রেপ্তার ও হত্যার ঘটনা ঘটুক, কংগ্রেসী আমলের গণহত্যা ও অত্যাচারের কুশীলবদের প্রতি তারা যতই শ্রদ্ধাশীল হোক না কেন, শাসককূলের শীর্ষনেতৃত্ব সম্পর্কে প্রকাশ্যে অবিরাম ও ভুরিভুরি তীব্র গালমন্দ, বিরোধিতা, শ্লেষ, সমাবেশ ইত্যাদি কী পশ্চিমবঙ্গে ফ্যাসিবাদের তত্ত্বকে সমর্থন করে?
কেন্দ্রের শাসক বিজেপি-র আমলে এসে বিনায়ক দামোদর সাভারকর, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ইত্যাদিকে কেন্দ্র ক'রে রাতকে দিন এবং কালোকে সাদা দেখিয়ে উলঙ্গ মিথ্যার 'ইতিহাস' রচিত হচ্ছে। সামাজিক বৈষম্য, জাত-ভিত্তিক বিদ্বেষ, ধর্মীয় ঘৃণা, সাম্প্রদায়িক হিংসা, এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য এক ভয়াবহ স্তরে পৌঁছেছে। যুগ যুগ ধরে জনগণের টাকায় গড়ে ওঠা সকল রাষ্ট্রীয় সম্পদ একে একে কর্পোরেটদের কাছে জলের দরে বেচে দেবার বিশ্বাসঘাতক কর্মকান্ড চলছে। এসব কিছু নিঃসন্দেহেই ভয়ঙ্কর ও অভূতপূর্ব। তার মানেই কী এরা 'ফ্যাসিস্ট'? পাঞ্জাব থেকে শুরু হওয়া কৃষক আন্দোলনে প্রায় একবছর যাবৎ দিল্লির সীমানায় অবস্থান করছে হাজার হাজার কৃষক। বারবার তাদের উপর ন্যক্কারজনক পুলিশী এবং নানাবিধ হামলা চলছে। নিহত ও আহত হচ্ছেন অসংখ্য কৃষক। আন্দোলনকারীদের হিসাবে, এপর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৬০০-র বেশি কৃষকের। সবই ঠিক। আন্দোলনকে ভেঙে দেবার জন্য নানা ধরনের মিথ্যা প্রচার এবং কুটিল রাজনৈতিক চক্রান্ত ও কারবার চলছে। তা-ও সত্য। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী এখনও পর্যন্ত স্টেনগান চালিয়ে কয়েকশো মানুষকে খুন করেনি; অথবা বিমান হামলা হয়নি আন্দোলনকারীদের উপর; আতঙ্ক সৃষ্টি করে প্রতিটি প্রতিবাদী মানুষকে ঘরে ঢুকিয়েও দেওয়া যায়নি; আন্দোলনকে প্রকাশ্যে সমর্থন করলেই খুন হ'তে হচ্ছে না। বরং আন্দোলনের তীব্রতা এবং শাসকের বিড়ম্বনা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। তা'ছাড়া, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্পর্কে তীব্রতম কষাঘাতের মতো অভিযোগ ও গালাগালি অবিরাম চলছে প্রকাশ্যে। এসব কী ফ্যাসিস্ট শাসনে আদৌ সম্ভব?
মুসোলিনির ইটালি এবং হিটলারের জার্মানি, এই দুই দেশের হত্যা পীড়ন দমন অত্যাচার আগ্রাসনের ইতিহাস কী শিক্ষা দেয়?
(তিন)
এই প্রসঙ্গ আলোচনায় একটা বিষয়ের উল্লেখ করা একান্ত জরুরি। যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লীগের সভাপতি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কেও ফ্যাসিবাদের জনক মুসোলিনির সমর্থক, এবং শান্তিনিকেতনকে ফ্যাসিবাদের "দালাল সংগ্রহ করার গুপ্ত ঘাঁটি" তকমাও দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক প্রবীণ বিপ্লবী নেতা, গত শতাব্দীর '৭০-এর দশকে!
বিপথগামী প্রগতিশীলতার কী বেদনাদায়ক পরিণতি!
কলকাতায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা যুদ্ধ ও ফ্যাসিস্ট-বিরোধী সঙ্ঘের একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেন। কিছুদিন পরে তাঁদের উদ্যোগে গঠিত হয় 'লীগ এগেইনস্ট ফ্যাসিজম অ্যান্ড ওয়ার'। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "যে মুহূর্তে আমি জেনেছি সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদের প্রতি অন্ধ আসক্তিই ফ্যাসিবাদের লক্ষ্যস্থল সেই মুহূর্তেই তার প্রতি আমার সমস্ত সহানুভূতি আমি প্রত্যাহার করে নিয়েছি।" ('দ্য স্টার', লন্ডন, ৫ অগাস্ট ১৯২৫-এ প্রকাশিত; 'বাংলার ফ্যাশিস্ট-বিরোধী ঐতিহ্য', মনীষা গ্রন্থালয় প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা, ১৯৭৫, পৃ: ৯ দ্রষ্টব্য।) ১৯২৬ সালের ২৫ জুন, জগদ্বিখ্যাত ফরাসি বুদ্ধিজীবী রমাঁ রোলাঁ এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ফ্যাসিবাদ ও মুসোলিনি সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা হয়। এবিষয়ে রোলাঁ তাঁর প্রখ্যাত রচনা 'শিল্পীর নবজন্ম' (I Will Not Rest) বইটিতে লিখেছেন -
"আমি রবীন্দ্রনাথের চোখ খুলিবার চেষ্টা করিলাম। এ চেষ্টা আমার পক্ষে খুব সহজ হয় নাই। ফ্যাশিজমের আসল রূপ আমি তাহার নিকট খুলিয়া ধরিলাম। ইহার হিংস্রনীতির কবলে যাহারা পড়িয়াছে তাহাদের সহিত তাহার সংযোগ সাধন ঘটাইলাম। রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে বিচলিত হইলেন।
"যে ফ্যাশিজম তখন তাহার নাম ভাঙাইতেছিল তাহার সহিত তিনি খোলাখুলিভাবে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করিলেন। ইতালীয় বন্ধুগণের এবং সি এফ এন্ড্রুজের নিকট লিখিত চিঠিতে তিনি তাঁহার মত পরিবর্তনের কথা ব্যক্ত করিলেন।" (অনুবাদ- সরোজকুমার দত্ত)
পরের মাসেই রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, "ফ্যাসিবাদের ইতিহাস ও চরিত্র অধ্যয়ন করার কোনও সুযোগ আমার হয়নি।"
"সন্ত্রাসের দ্বারা নির্যাতিত হওয়াটা সহনীয়, কিন্তু মিথ্যা আদর্শের পূজায় প্রবঞ্চিত হওয়াটা সমগ্র যুগের পক্ষে অবমাননাকর।" ('ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান', ৫ অগাস্ট ১৯২৬; 'বাংলার ফ্যাশিস্ট-বিরোধী ঐতিহ্য', পৃ: ৬ দ্রষ্টব্য।)
রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, চিঠি, বিবৃতি, আবেদন ইত্যাদি হয়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের এক একটি শানিত হাতিয়ার। ১৯৩৭ সালে এক আবেদনে রবীন্দ্রনাথ লেখেন –
"আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদের এই প্রলয়ঙ্কর বন্যাকে রোধ করতেই হবে। স্পেনে যে তামসিকতা, যে জাতিগত কুসংস্কার, যে লুন্ঠন ও যুদ্ধের গৌরব প্রতিষ্ঠার অমানুষিক পুনঃপ্রচেষ্টা চলেছে তাকে চূড়ান্ত প্রত্যাঘাতে স্তব্ধ করতেই হবে।
"স্পেনের জনগণের চূড়ান্ত পরীক্ষা ও দঃখভোগের মুহূর্তে মানবতার বিবেকের কাছে আমি আবেদন করছি।
"স্পেনের গণ-ফ্রন্টের পাশে দাঁড়ান, জনগণের সরকারকে সাহায্য করুন, লক্ষ কন্ঠে ধ্বনি তুলুন – 'প্রতিক্রিয়া দূর হও।' লাখে লাখে এগিয়ে আসুন গণতন্ত্রের সাহায্যে, সভ্যতা ও সংস্কৃতি রক্ষায়।" ('স্টেটসম্যান', কলকাতা, ৩ মার্চ ১৯৩৭; 'বাংলার ফ্যাশিস্ট-বিরোধী ঐতিহ্য', পৃ: ১৫ দ্রষ্টব্য।)
চীনের উপর যখন সাম্রাজ্যবাদী জাপান অমানুষিক বর্রবতা চালিয়ে ব্যাপক হত্যালীলা ও ধ্বংসের তান্ডব চালাচ্ছিলো, রবীন্দ্রনাথ তখন "দেশবাসীর কাছে আবেদন" জানিয়েছিলেন: "ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে চীনকে অবিলম্বে যে-কোনো প্রকার বৈষয়িক সাহায্য দিন- যে যন্ত্রণা চীনকে গ্রাস করেছে তা দূর করার জন্য।" এবং 'চীন তহবিল'-এ ব্যক্তিগতভাবে ৫০০ টাকা দান করেন ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি মাসে (বর্তমান হিসাবে যা ৮,৫০,০০০ টাকার সমতুল - লেখক)।
(চার)
পরিবেশ, পরিস্থিতি, জনমানস ইত্যাদি সবকিছু অনুকূল না হ'লে ফ্যাসিবাদের উদয় সম্ভব না। ''নেতৃত্ব চাহিলেন এবং ফ্যাসিবাদ লাগু হইল'', ব্যাপারটা এতো সহজ সমীকরণ না। ১০০ বছর আগে ৫ কোটি মানুষের দেশে মুসোলিনির পক্ষে কিম্বা ৮৭ বছর আগে ৮ কোটি মানুষের দেশে হিটলারের পক্ষে যা সম্ভব হয়েছিলো, একবিংশ শতাব্দীতে এসে ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারতবর্ষে তা কারও পক্ষেই সম্ভব না। ৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের ইটালিতে অথবা ৬ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের জার্মানিতে যা কায়েম করা সম্ভব হয়েছিল, ৩৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে অধিষ্ঠিত বিশাল ভারতবর্ষে তা কায়েম করা অসম্ভব। এখানকার বিপুলসংখ্যক জনগণের বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা, অর্থনীতি, ধর্ম, ঐতিহ্য, ইত্যাদিও সর্বগ্রাসী ফ্যাসিবাদ কায়েমের পক্ষে ভয়ঙ্কর প্রতিকূল। যেখানে "হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন --/ শক-হুন-দল পাঠান-মোগল একদেহে হলো লীন", সেখানে 'ফ্যাসিবাদ' কায়েম! মুসোলিনি বা হিটলারের ভক্তবৃন্দের মনে যতই ফ্যাসিবাদ কায়েমের সুপ্ত বাসনা থাক, হামলা অত্যাচার খুন দাঙ্গা গণহত্যা ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেদের শাসন বজায় রাখতে যতই তারা আগ্রহী হোক না কেন, 'ফ্যাসিবাদ' প্রতিষ্ঠা তাদের দুরাশাই রয়ে যাবে। তাছাড়া, মুসোলিনি ও হিটলারের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্পন্ন সহিংস ফ্যাসিবাদের যারা ভক্ত, সোভিয়েত লালফৌজের দাপটে ফ্যাসিস্ট নেতাদের শেষ পরিণতির ইতিহাসও তাদের অবশ্যই জানা আছে।
ফ্যাসিবাদের দর্শন হল: ১) যুক্তিহীনতা; ২) উৎকট স্বাদেশিকতা (Chauvinism); ৩) জাতিবাদ (Racism); ৪) জ্ঞানের প্রসারে বাধাদান; এবং ৫) অমানবিকতা। বলাবাহুল্য, প্রায় সব বৈশিষ্ট্যই আমরা কমবেশি সকল শাসকের মধ্যেই দেখেছি। অর্থাৎ, অনেকের মধ্যেই ফ্যাসিস্ট হবার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষীয় সমাজে বিপুল বৈচিত্রের কারণে 'বিধি বাম', তাই রক্ষা। সমাজের উপর যে সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক আধিপত্য ফ্যাসিবাদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, তা-ও আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যেই দেখতে পাই: ১) সবাই 'আমাদের' রিলিজিয়নকেই মেনে চলবে; ২) সবাইকে 'আমাদের' ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব মানতে হবে; ৩) সব ইস্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি 'আমাদের' নেতৃত্বেই চলবে; ৪) পঞ্চায়েত-বিধানসভা-লোকসভার সব আসনই 'আমাদের' চাই; ৫) সবাই 'আমাদের' ইচ্ছা মেনেই চলবে সর্বদা; - এসবই ফ্যাসিস্ট মানসিকতার এক একটি বহিঃপ্রকাশ।
ফ্যাসিবাদের একটি চমৎকার, সংক্ষিপ্ত ও পরিপূর্ণ সংজ্ঞা দিয়েছিল কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের (Communist International) বর্ধিত এক্সিকিউটিভের ১৩-তম কংগ্রেস (১৯৩৩)। সকল প্রতিনিধির সর্বসম্মতিক্রমে। এতে বলা হয়েছিল, "ফ্যাসিবাদ হল লগ্নী-পুঁজির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে উৎকট রকমের স্বাদেশিক, সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী অংশের প্রকাশ্য ও সন্ত্রাসী একনায়কত্ব।" ("Fascism is the open terrorist dictatorship of the most reactionary, most chauvinistic, most imperialist elements of finance capital.") অর্থাৎ, এই সবকটি চরিত্র থাকলে তবেই তাদের 'ফ্যাসিস্ট' বলা যায়।
মুসোলিনি কর্তৃক আলবেনিয়া, সোমালিল্যান্ড, সিসিলী, ইথিওপিয়া, ইজিপ্ট, টিউনিসিয়া ইত্যাদি গ্রাস; এবং হিটলার কর্তৃক পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবার্গ, ফ্রান্স, যুগোস্লাভিয়া, ইত্যাদি দেশ দখল; - "সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী অংশের প্রকাশ্য ও সন্ত্রাসী একনায়কত্ব"র আদর্শ উদাহরণ। বিভিন্ন দেশের মোট কতো লক্ষ (বা কোটি) মানুষ বীভৎসভাবে খুন অথবা অত্যাচারিত হয়েছেন এই দুই ফ্যাসিস্ট শক্তির হাতে, তার সঠিক হিসেবই বা কে/ কারা দেবে!
বর্তমান পৃথিবীর খেটে খাওয়া জনগণ আদৌ ভাল নেই! নানা দেশেই আমরা দেখছি অনাহারে মৃত্যুর ভয়াবহতা; সামরিক অভ্যুত্থানের আর সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের দাপট; সহিংস জনবিরোধী সন্ত্রাসের ঝড়। ১৮৪৮ সালে এক মহত্তম আহ্বান ধ্বনিত হয়েছিল, "সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষ, ঐক্যবদ্ধ হও।" ("Working Men of All Countries, Unite.") শ্রমচোর মালিক আর শ্রমজীবী জনগণের সংঘাত ও সংঘর্ষ সর্বদাই অনিবার্য। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের সেই ঐক্য ১৮৩ বছরেও গড়ে ওঠেনি! শাসকের হামলা ছাড়াও, জনগণের পারস্পরিক হানাহানি ও সংঘর্ষের পরিণামে অগণিত মানুষের মৃত্যু এবং অবিরাম রক্তের প্লাবন বেড়েই চলেছে! প্রাণ বাঁচানোর জন্য নিজেদের 'দেশ' ছেড়ে পালাতে গিয়েও প্রাণ হারাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ! শোষক শ্রেণীর উল্লাস এখনও থামেনি। আজও "নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,/ শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।" (রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতন, ২৫ ডিসেম্বর ১৯৩৭ সাল।) কিন্তু তাই বলে সর্বত্রই 'ফ্যাসিবাদ' কায়েম হয়নি।
(পাঁচ)
ভারতবর্ষের বুকে "ফ্যাসিবাদ" কায়েমের পথে যে বাস্তব সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা, সেটাই বৈচিত্র্যপূর্ণ বৃহত্তর সমাজের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ। গত ১০০ বছরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটও বিপুলভাবে গেছে পাল্টে। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা যতো তাড়াতাড়ি 'সস্তায় কিস্তিমাত' করার মানসিকতা ত্যাগ করেন, ততই ভাল। শাসকগোষ্ঠীর তরফ থেকে অত্যাচার নেমে এলেই এবং সেই অত্যাচার প্রতিরোধ করতে নিজেরা অক্ষম হলেই 'ফ্যাসিবাদ'-এর ধূয়া তোলা, একধরনের রাজনৈতিক বিভ্রান্তি।
"বিকাশমান ভারত"-এ সবকিছুর উৎপাদন হচ্ছে সামাজিক, কিন্তু তা থেকে আসা মুনাফা লুটছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। একদিকে ক্ষেতে-খামারের, কলে-কারখানার কোটিকোটি উৎপাদক মানুষের মৃত্যু ; অনাহার অপুষ্টি কর্মহীনতা গৃহহীনতা চিকিৎসাহীনতা শিক্ষাহীনতা; অপরদিকে, সেই উৎপাদনের মুনাফা থেকে কয়েকটি মাত্র কর্পোরেট হাঙরের পকেটে জমা হয়েই চলেছে লক্ষলক্ষ কোটি টাকার সম্পদ। এটাই নাকি "গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা"! এই অন্যায় ও অসভ্য ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েই চলবে যে সরকার বা দল, তারা আসলে লুটেরাদেরই পাহারাদার। লুটেরাদের সম্পদ রক্ষা এবং জনগণের উপর দমন-পীড়ন-অত্যাচার, দুই-ই চলবে। অবশ্যম্ভাবি। তাই, শাসক ভেদে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের পথকে শিকেয় তুলে রাখার বাসনাকে চিরতরে বিদায় দিতে হবে মগজ থেকে। শোষিত মানুষকে সর্বদাই অত্যাচারী শাসকের টক্কর নিয়েই বাঁচতে হবে। উপায় নেই। এবং একমাত্র ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমেই তা সম্ভব।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "স্বাধীনতা এমনই একটি বিশেষ অধিকার যা প্রতিটি মানুষকে নিজের জন্যই প্রতিনিয়ত রক্ষা করতে হয়-- কেননা, সবচেয়ে গণতান্ত্রিক গভর্ণমেন্টও অত্যাচারী হয়ে উঠতে পারে যদি তার সন্ত্রাস প্রজাদের ঔদাসীন্য ও ভীরুতায় প্রশ্রয় পায়।" (অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৭ অক্টোবর ১৯৩৭; 'বাংলার ফ্যাশিস্ট-বিরোধী ঐতিহ্য', পৃ: ১৬ থেকে।)
জীবনসায়াহ্নে রচিত তাঁর একটি পথপ্রদর্শক রচনা দিয়েই বর্তমান আলোচনা শেষ করা যাক -
"রক্তে-রাঙা ভাঙন-ধরা পথে
দুর্গমেরে পেরোতে হবে বিঘ্নজয়ী রথে,
পরান দিয়ে বাঁধিতে হবে সেতু।
ত্রাসের পদাঘাতের তাড়নায়,
অসম্মান নিয়ো না শিরে, ভুলো না আপনায়।
মিথ্যা দিয়ে, চাতুরী দিয়ে, রচিয়া গুহাবাস
পৌরুষেরে কোরো না পরিহাস।
বাঁচাতে নিজ প্রাণ
বলীর পদে দুর্বলেরে কোরো না বলিদান।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(জোড়াসাঁকো, কলিকাতা, ১ এপ্রিল ১৯৩৯)