বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ নভেম্বর, ২০২১— পাটকলের কারিগরদের পেশার রোগ নিয়ে ভাবার আগে এই পেশার ইতিহাস নিয়েও দু- চার কথা বলার দরকার।
ডান্ডি থেকে শ্রীরামপুর
আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগের কথা- উত্তর সাগরের ধারে স্কটল্যান্ডের সুন্দর শহর ডান্ডি; টাই-নদীর ধারে চাষ হওয়া পাটের আঁশে তিমি মাছের তেল মাখিয়ে মোলায়েম সুতো তৈরি করে পাটের দড়ি, বস্তা, কার্পেট, এইসব পরিবেশবান্ধব দরকারি জিনিস বানিয়ে পাটশিল্পের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল সেই শহর । ১৮৫৫ সালে, হুগলি জেলার ধনী জমিদার বিশ্বম্ভরবাবু ডান্ডি থেকে আধুনিক পাটের সুতো বোনার তাঁত যন্ত্র আমদানি করে শ্রীরামপুরে ভারতের প্রথম জুটমিলটি স্থাপন করে হৈচৈ ফেলে দিয়ে ছিলেন বলে জানা যায়।
ভারতের পাটকলের সোনালী সময়
শ্রীরামপুর জুট মিল এর সাফল্য দেখে মাড়োয়ারী উদ্যোগপতি জি ডি বিড়লা উৎসাহ পান। সারা ভারতেই বিশেষ করে বাংলাতে গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা নদীর সুজলা সুফলা জমিতে উন্নত মানের পাটের আঁশ ব্যবহার করে রেল লাইনের ধারে ধারে গড়ে তুললেন অনেক পাটকল। এদেশে কম মজুরিতে শ্রমিক আর সস্তায় পাট চাষীদের কাছ থেকে পাটের বান্ডিল কিনে তৈরি উচ্চ মানের পাটের সামগ্রী অনেক কম দামে ডান্ডির পাটশিল্পকে পরাস্ত করল।
১৮৯৬ সাল থেকে শুরু করে মাত্র কয়েক দশকের ভেতর ভারতে প্রায় নব্বইটিরও বেশি চটকল চালু হয়ে গেল। একদিকে প্রায় ৮০০ হাজার হেক্টর জমিতে চল্লিশ লক্ষ চাষি পাটের চাষে যুক্ত হলেন; পাটের মরসুমে প্রায় সারাদিন জমা জলে কাজ করে নানারকম চর্মরোগে ভুগতে লাগলেন তেমনি প্রায় চার লাখ শ্রমিক প্রায় ১০০ টির মতো পাটকলে ঘন অস্বাস্থ্যকর বস্তিতে থেকে নানারকম পেশার অসুখে ভুগতে দেখা গেলো।
প্লাস্টিকের দানা - পাটের যম
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সুপারিশে সরকারি নিয়ম হলেও শস্য, সার এসবে পাটের বস্তা ব্যবহারের নিয়ম প্লাস্টিক ব্যবসায়ীদের চাপে শিথিল হতে থাকলো।
১৯৯০ সালের পর থেকেই গত তিরিশ বছরে চট কল গুলো একটার পর একটা বন্ধ হতে হতে আজ খাতায় কলমে ৫০টি মতো এসে দাঁড়িয়েছে। চটকলে অবসর নেওয়া কর্মীদের কম পয়সায় পুনঃবহাল, নতুন কর্মী নিয়োগ না করে ঠিকে শ্রমিক নিয়োগ - এসবে পাটকলের স্থায়ী কর্মচারী সংখ্যাটা অনেক কমেছে। চাহিদা কমায় পাটচাষ করেও চাষিদের আয় তলানিতে ঠেকেছে।
পাট শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্য
অস্বাস্থ্যকর বস্তিতে একসঙ্গে অনেকে মিলে থাকা, আয় কমে গিয়ে পুষ্টিকর খাবার না পাওয়ার সঙ্গে নেশার সম্পর্ক সর্বত্রই দেখা যায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে এঁদের প্রায় ১০০ শতাংশ শ্রমিক দেশি মদ পান করেন। বিড়ি, খৈনি গুটখার কবলে আজ প্রায় ৯৮ শতাংশ শ্রমিক। অনেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, অবসাদ, দুশ্চিন্তা, নিদ্রাহীনতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হিংসাত্মক ঘটনায় জড়িয়ে পড়া।
শারীরিক রোগ ও স্বাস্থ্য
ক) দুর্ঘটনা – পাটকলে যারা কাজ করেন তাদের প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অঙ্গহানি ঘটতে দেখা যায়। কম আলোতে কাজ করা, বিশ্রাম ও পুষ্টির অভাব, মানসিক দুশ্চিন্তা -অমনোযোগিতা এসব কারণ।
খ) ফুসফুসের রোগ - পাটকলের ভাসমান তন্তু শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুস এ ঢুকে জমা হয়। ধীরে ধীরে ফুসফুসের ক্ষমতা কমতেই থাকে। হাঁপানি, শাসকস্ট, এছাড়া ফুসফুসে নানা জীবাণু এমনকি যক্ষার রোগও বাসা বাঁধে। " বিসিনোসিস" নামে এক কঠিন রোগে এঁদের আনেকেই আক্রান্ত হন। এর সঙ্গে ধূমপান ও নানা দূষণের কারণে ফুসফুসের ক্যান্সার অনেককেরই আক্রমণ করে।
গ) হজমের গণ্ডগোল - অপুষ্টি, নেশা, বিশ্রামের অভাব - এসব নানা কারণে পাকস্থলীর ঘা, অম্বল, ক্যান্সার, লিভারের গন্ডগোল - এসব রোগে এঁদের বেশি করে ভুগতে দেখা যায়।
ঘ) পিঠের ও কোমরের ব্যথা - থেকে স্লিপ ডিস্ক- কয়েকবছর আগে যারা ভারত জুড়ে এক সমীক্ষাতে দেখা গেছে ভারতের পাটকলের শ্রমিকদের ৫৫ শতাংশ মানুষ বছরে অন্তত তিন মাস বা তার বেশি সময় মেরুদন্ডের রোগে ভোগেন। কর্মক্ষেত্রে এঁদের প্রায়ই অবিশ্বাস করা হয়। বাড়াবাড়ি হলে পিঠের অপারেশন করেও বেশিরভাগ শ্রমিক আর কোনওদিন কাজে ফিরতে পারেন না। পাটকলের শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক শ্রম নিয়মের বাইরে কুড়ি কেজির বেশি ওজন নিয়মিত তোলা, বিশ্রাম না নিয়ে একটানা কাজ করে যাওয়া, একভাবে বেকায়দায় ঝুঁকে বা হেলে ঘন্টার উপর ঘন্টা কাজ করা - শিরদাঁড়ায় সমস্যার কারণ বলে মনে করা হয়।
ঙ) কানের সমস্যা - কালা হয়ে যাওয়া। জুটমিলের ভেতর তাতকলের যান্ত্রিক শব্দ কখনোই আন্তর্জাতিক শ্রম নিয়মের নিরাপদ মাত্রার ভেতর থাকেনা । বছরের পর বছর এভাবে কাজ করতে করতে অনেকেই অল্প বয়সেই কম শোনা বা বধিরতায় আক্রান্ত হন।
চ) চোখের সমস্যা - মিলের ভেতর নানা ভাসমান ধুলোর জন্য চোখের ঝিল্লী শুকিয়ে "জেরপথালমিয়া" বলে রোগে ভুগতে দেখা যায়। কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে চোখের দৃষ্টিহানি ঘটতেও দেখা যায়।
ছ) উচ্চ রক্তচাপ, মধুমেহ – প্রতিদিন একদিকে কাজের চাপ অন্য দিকে কাজ হারানোর চিন্তা, এর সঙ্গে নিদ্রাহীনতা, আর্থিক অসঙ্গতি- এসব কারণে প্রায় বেশিরভাগ শ্রমিকেই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস ও হাজার ক্রনিক অসুখে ভুগতে দেখা যায়।
জ) জীবাণুসংক্রমণ – স্যাঁতসেতে আর আলো বাতাসের অভাব থাকার জন্য শ্রমিকদের বসতিগুলো নানা সংক্রমক জীবাণুতে ভরে থাকে। আমাশা, টাইফয়েড ছাড়াও মালারিয়া ডেঙ্গু এসবে প্রতিবছর নানা ঋতুতে এদের প্রায়ই ভুগতে দেখা যায়।
ঝ) অ্যানিমিয়া – অপুষ্টি - তবে জুটমিল শ্রমিকদের সবথেকে বড় অসুখ হল অপুষ্টি আর রক্তাল্পতা। প্রায় সব কর্মীদেরই রক্তাল্পতায় ভুগতে দেখা যায়। জুট মিলে ভারতে মহিলাদের সংখ্যা অনেক কম হলেও তাদের প্রায় সকলেই বেশি করে রক্তাল্পতায় ভুগতে দেখা যায়।
একদিকে পাটকলগুলোতে কাজের সুযোগ কমে যাওয়া তার সাথে নানা রকম পেশার অসুখে পাট-শ্রমিকরা সমাজের মূল স্রোত থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। এদের সমস্যাকে বিছিন্ন করে শুধু রোগের সমস্যা হিসেবে না দেখে— পরিবেশ রক্ষায় প্লাস্টিক এর বদলে পাটের ব্যাবহার বাড়ানোর জন্য আমাদের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে, কথা বলতে হবে সর্বত্র।