বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

বর্তমান সময়ে শিক্ষার সঙ্কট

বর্তমান সময়ে শিক্ষার সঙ্কট

দেবী চ্যাটার্জী

photo

চারিদিকে অঢেল টাকা! টাকার স্তুপ! এত টাকা একসঙ্গে বোধ হয় বাঙালি আগে কখনো দেখেনি! কিন্তু যখন সংবাদ মাধ্যমে দেখল, তখন দেখল আপাত মালিকরা আশ্চর্য্য রকম ভাবে নির্লিপ্ত, টাকার প্রতি উদাসীন এবং তার মালিকানা অস্বীকার করছে। সবাই বলছে ‘এ টাকা আমার নয়’! তবে কার?
এ সবের সঙ্গে আজ আমরা সুপরিচিত। আমরা জানি, এ টাকা শুধু কালোই নয়, এতে বড্ড বেশি কালি! এক প্রজন্মের মুষ্ঠীমেয় মানুষের হাতের কালির ছিটে শুধু সেই প্রজন্মের কলঙ্কই নয়, পরের প্রজন্মের চোখের জলের কারণ হয়ে উঠেছে। পাঠক ঠিকই বুঝেছেন। আমরা বাংলার বর্তমান শিক্ষা ক্ষেত্রে উঠে আসা কলঙ্কের কথা বলছি। টাকার স্তুপিকৃত পাহাড় মন্ত্রী ঘনিষ্ঠের বাড়িতে এবং অন্যান্য বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কৃত হতে, আইন আইনের পথে চলতে শুরু করে। এর ফলে প্রভাবশালী মন্ত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষা ক্ষেত্রের তাবড় তাবড় আধিকারিকরা আজ দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে কারারুদ্ধ। সম্ভাবনা আছে আরও রথী মহারথীদের নাম জড়াবে।
অভিযোগ ওঠে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত টেট বা টিচার এলিজিবিলিটি টেস্ট পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে। স্কুলে এক থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানোর জন্য যা পাস করা অত্যাবশ্যক। শিক্ষা ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে শ’য়ে শ’য়ে চাকুরি বিক্রি হয়েছে। উপযুক্তদের বাদ দিয়ে অনুপযুক্তদের নিয়োগ করা হয়েছে। পরীক্ষায় না বসা, সাদা খাতা জমা দেওয়া, অনুত্তীর্ণরা টাকার বিনিময়ে নিয়োগপত্র পেয়েছে। বিপরীতে, যারা উপযুক্ত, তারা তাদের প্রাপ্য পায় নি। দুঃখে, ক্ষোভে, চোখের জলে দিনের পর দিন এই সব চাকুরিপ্রার্থীরা পথে বসে তাদের প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছে। বলা বাহুল্য, এক দিকে বিষয়টিকে নিয়ে তীব্র রাজনৈতিক চাপানউতর জারি আছে। অন্যদিকে, আইন আইনের পথে চলছে। আদালতে একের পর এক ঐতিহাসিক রায় উঠে আসছে। ইতিমধ্যেই আদালতের নির্দেশে স্কুল সার্ভিস কমিশন প্রথমে একশ তিরাশি জনের ও পরে চল্লিশ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে যাদের, কমিশনের স্বীকারোক্তি মতো, ভুল করে নিয়োগ করা হয়েছে। আরও কয়েক হাজারের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন আছে। এর পাশাপাশি, ইতিমধ্যেই উঠে এসেছে নবম দশম শ্রেণীর শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘটা দুর্নীতির অভিযোগের কথাও। অর্থাৎ যে দিকে তাকানো হয়, সেদিকেই যেন দুর্নীতির ছায়া।
****
আজ বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী অর্থনীতির অগ্রগতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। বিশ্বজুড়ে মন্দার আশঙ্কার কালো ছায়া ঘনীভূত হচ্ছে। ‘বিশ্বায়ন’কে কেন্দ্র করে, পুঁজিবাদের সঙ্গে তার যোগসূত্র না বুঝে, অনেকের মনে এক সময় যে উৎসাহ, উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল, তা আজ অনেকটাই স্থিমিত। বিশ্ব জুড়ে বেকারত্ব বেড়ে চলেছে। হাজারে হাজারে মানুষ কর্মক্ষেত্র থেকে ছাঁটাই হচ্ছে। ভারত তার ব্যতিক্রম নয়। অন্য অনেক দেশের মতই, এখানেও কর্মহীন উন্নয়ন আজ বাস্তব। পাশাপাশি ভয়াবহ মূদ্রাস্ফীতি জনজীবনে অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতা বাড়িয়ে চলেছে। এই অবস্থায়, সমাজে দ্রুত ও ব্যাপক অবক্ষয়ের চিত্র সর্বত্র চোখে পড়ে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ভালবাসার সামগ্রী বা ব্যক্তিও পণ্যে রূপান্তরিত হয়। বাজার দরের নিরিখে তার মূল্যায়ন হয়। নারী থেকে শিশু, সবকিছুই পণ্য হিসাবে কেনাবেচা চলে। এ হেন পরিস্থিতিতে যে চাকরির কেনা বেচা চলবে, তা আর আশ্চর্যের কী। আর, চাকরির কেনা বেচা যেখানে হবে, সেখানে যে অন্যান্য চাকরির পাশাপাশি শিক্ষকের চাকরির কেনা বেচা চলবে সেটা ধরেই নেওয়া যায়। আর, বলা বাহুল্য, সঙ্কট যত ঘনীভূত হচ্ছে, এই কেনা বেচার চরিত্র ততই হিংস্র আর নগ্ন রূপ ধারণ করছে।
আমাদের চোখের সামনে শিক্ষা আর পাঁচটা বস্তুর মত বাজারি পণ্যে পরিণত হয়ে চলেছে। বৈষয়িক হিসাবপত্র, দর কষাকষি, বাজারের অঙ্কে তার কার্যকারিতা, শিক্ষার মূল্যায়নের মানদন্ড হয়ে উঠছে। জ্ঞানলাভের কথা সেখানে মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। শিক্ষা জ্ঞানলাভের জন্য নয়, শিক্ষা চাকরির জন্য, অর্থ উপার্জনের জন্য, এমন এক চিন্তা কারো কারো মনে যেন অতি দ্রুত স্থান করে নিচ্ছে। এই ধরনের মনোবৃত্তি যেখানে, সেখানে, যে শিক্ষা সেই উদ্দেশ্য পূরণে বেশি সফল হয়, সেটা ততটাই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বাজারের হিসাবে তা গ্রহণযোগ্য হয়। তার সঙ্গে যথার্থ জ্ঞানবৃদ্ধির সম্পর্ক থাক বা নাই থাক। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। যেখানে সব কিছুই বাজারের চাহিদা মোতাবেক নির্ধারিত হয়, সেখানে যে শিক্ষার বেলাও তাই হবে তা বোঝাই যায়। অন্যথা হলেই বরং আশ্চর্য হওয়ার কথা। আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষা ক্ষেত্রে বেড়ে চলা অসম প্রতিযোগিতা, ছাত্র ও তার পরিবারের মনে যেনতেন প্রকারে সাফল্য অর্জনের ইন্ধন যুগিয়ে যায়। বাজারের নজরে ‘ভাল’ এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রকে স্থান পেতে হবে, পরীক্ষায় নম্বর পেতে হবে – আবারও যেনতেন উপায়ে, আর তার ভিত্তিতে যত ‘অর্থ’-বহ সম্ভব, কাজ পেতে হবে। এ সবের মধ্যে বেচারা ‘জ্ঞান’-এর স্থান কোথায়? সে তো অনেক আগেই এই শিক্ষার কেনাবেচায় হেরে বসে আছে! এক দিকে শিক্ষকের চাকরি, অন্য দিকে শিক্ষা উভয়ই, দুঃখজনক ভাবে, ক্রয়যোগ্য হয়ে ওঠে!
****
সব মিলিয়ে সমাজের এক বিপুল অবক্ষয়ের চিত্র উঠে এসেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রের এই দুর্নীতির দায় শুধু কালো টাকা গ্রহীতার উপর থাকে না। এই টাকা যারা দেয়, তাদের উপরও দায় পড়ে। সৎ পথে যা প্রাপ্য নয়, অসৎ পথে তা অধিকারের প্রচেষ্টা তাদের কালিমালিপ্ত করে। তারা সমাজের চোখে, আইনের চোখে, ছাত্রদের চোখে আর সর্বোপরি নিজেদের চোখে অপরাধী থেকে যায়। আইনের ফাঁদে কেউ ধরা না পড়লেও, সে কি সত্যিই নিজের বিবেকের কাছে স্বাচ্ছন্দ বোধ করবে?
অন্যদিকে, শিক্ষা ও শিক্ষকের শিক্ষা দানের সঙ্গে সমাজের যে শ্রদ্ধার মানসিকতা ছিল তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। সমস্ত শিক্ষকের সততা ও যোগ্যতা পদে পদে প্রশ্ন চিহ্নের মুখে পড়ছে। সৎ শিক্ষকদের যেন তাদের চতুর্দিক থেকে নিজেদের সততার প্রমাণ দেওয়ার দাবি ওঠে আসছে। তাদের ঘিরে থাকে, আর মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত করে চলে, হাজার হাজার সন্দেহের চোখ। অপরাধী বা নিরপরাধী, যাই হোক, অনেকেরই যেন বিচারের আগেই বিচার হয়ে যায় জনতার আদালতে, সমাজ মাধ্যমের দৌলতে। দেখা গেছে, কারো কারো ক্ষেত্রে সেই চাপ প্রাণঘাতি হয়ে পড়ে। আত্মহননের পথ বেছে নেয়। ইতিমধ্যেই এমন ঘটনার খবর উঠে এসেছে।
বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আজ বহুমুখী সঙ্কটের সন্মুখীন। বলা বাহুল্য, শিক্ষা ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটলে ছাত্ররাই সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আইনের জটিলতায় নতুন নিয়োগ বন্ধ হলে, বা নিযুক্ত কোনও শিক্ষকের বেনিয়মের ফলে চাকুরি গেলে, ছাত্রছাত্রীদের পঠনপাঠন ব্যাহত হয়। শ্রেণীকক্ষ শিক্ষকহীন হয়ে পড়ে। আবার, অনুপযুক্ত শিক্ষক শ্রেণীকক্ষের দায়িত্ব পেলে, হিতে বিপরীত হয়। এ ক্ষেত্রে অনেক সময়েই ছাত্রছাত্রীদের অতিপ্রয়োজনীয় পাঠ্য বিষয় জানা হয় না। আগামী দিনের পরীক্ষার প্রস্তুতি হয় না। শিক্ষার প্রতিযোগিতায়, নিজেদের কোনও দোষ ছাড়াই, অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। থেকে যায় অজ্ঞতার অন্ধকারে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্কট কিন্তু শুধু বিষয় ভিত্তিক হয় না। বহু ঘটনা প্রবাহ তাদের মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে ওঠে। এক দিকে লেখাপড়ার ছত্রাকার অবস্থা তাদের চাপ বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে, শৈশব থেকেই তারা ‘দুর্নীতি’, ‘চুরি’, ‘ঠগবাজী’ প্রভৃতি অবাঞ্ছিত কিছু শব্দের পরিমন্ডলের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে তাদের নিজেদের অতি পরিচিত প্রিয় শিক্ষকদের প্রসঙ্গে। আশেপাশে শুনতে পায় তাঁদের যোগ্যতা, সততা নিয়ে হাজারো কথা। শিক্ষককে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে তার ছাত্র নিজের জীবনের পথ অনুসন্ধান করবে এমনটাই আশা করা হয়, সেই শিক্ষকের পরিচিতি যখন দোদুল্যমান হয়ে ওঠে, তার সততা যখন প্রশ্নের মুখে পড়ে, তখন ছাত্রের জীবনে এক ভয়াবহ অন্ধকার ঘনীভুত হওয়ার বিপদ আসে। ছাত্র কি শিক্ষককে অবিশ্বাস করবে, তার যোগ্যতা, তার সততাকে সন্দেহের চোখে দেখবে? এ সন্দেহ কি কেবল মাত্র একজন কি কয়েকজন অভিযুক্ত শিক্ষকের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে, না কি এক সময়ে সমস্ত শিক্ষককুলের দিকেই আঙ্গুল উঠবে? ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক পারস্পরিক সন্দেহের জটিল জালে জড়িয়ে পরবে। সে জালের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে অবিশ্বাস আর ঘৃণা। একসময়ে, সমস্ত শিক্ষক আর শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি আসবে ছাত্রের বিরাগ।
দীর্ঘদিন পথে বসে আছে আশা হতাশার মধ্যে দোদুল্যমান কয়েকশো চাকুরি প্রার্থী। ন্যায়ের আশায়, কাজের আশায়। এখনো আশার আলো তাদের জন্য পুরোপুরি নিভে যায়নি। মানুষের মধ্যে থেকে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তাদের কণ্ঠস্বরকে শক্তি যুগিয়ে চলেছে, উচ্চ আদালতের একের পর এক রায় তাদের আশা জাগাচ্ছে। আগামী দিনের আশায় তারা বুক বাঁধছে। তাদের লড়াই যে বড় কঠিন তা তাদের চেয়ে ভাল করে আর কেই বা জানে!
***
সমাজের এই বিপূল অবক্ষয় কি পুঁজিবাদের পার্শপ্রতিক্রিয়া? বর্তমান অবস্থায় সমাজে কি নীতি-দুর্নীতির সূক্ষ বিভেদ রেখা ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে – নীতির স্থান দুর্নীতি গ্রাস করছে? এখানে কি বলা যায়, বিপদজনক ভাবে, টাকা বা অর্থ তার একটা নিজস্ব স্বকীয় অস্তিত্বের দাবিদার হয়ে উঠছে? এমন এক অস্তিত্ব বা পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হচ্ছে যার সাদা নেই, কালো নেই, শুধু আছে অপ্রতিরোধ্য বৃদ্ধির তাগিদ। আর, বহু মানুষের মধ্যে তা আহরণের, বাজার তাড়িত, নগ্ন, সীমাহীন প্রতিযোগিতা। এ যেন ক্রমেই সরু হয়ে আসা এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে শত শত দিশাহীন মানুষের ইঁদুর দৌড়!
আমরা বাঙ্গালীরা প্রায় সবাই ছোটবেলায় ঠাকুমা দিদিমার কাছে শোনা একটা ছড়ার সঙ্গে অতি পরিচিত। এর শব্দের কিছু হেরফের শোনা যায়, তবে সেটি মোটামুটি এইরকম: আমার গল্পটি ফুরোলো, নটে গাছটি মুড়োল; কেন রে নটে মুড়োলি, ছাগলে কেন খায়; কেন রে ছাগল খাস, রাখাল কেন চড়ায় না; কেন রে রাখাল চরাস না, বউ কেন ভাত দেয় না, ইত্যাদি...। অর্থাৎ, দায় ঠেলার গল্প। একজন থেকে অন্য জনে। আজও ঠিক তেমন ভাবেই, আমরা দায় ঠেলার ছেলে ভুলানো গল্প শুনছি, একজন থেকে অন্য জনে!

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.