বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

কর্মসংস্থান ও বেকারি:‌ পশ্চিমবঙ্গ

কর্মসংস্থান ও বেকারি:‌ পশ্চিমবঙ্গ

নির্মলেন্দু নাথ

photo

সাধারণভাবে অর্থনীতিতে শ্রম তথা কর্মসংস্থানের গুরুত্ব সুবিদিত। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দর্শন ও ধারণার বিবর্তনের সঙ্গে কর্মসংস্থান সম্পর্কে অনুসৃত পন্থাও বিবর্তিত হয়েছে। একটা সময়ে যা ছিল রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকার উদাহরণ, বর্তমানে তা ‘‌অনুদান’‌ ও বাজার ব্যবস্থার দ্বারা নির্ধারিত। পশ্চিমী ধনতান্ত্রিক দেশগুলোতে রাষ্ট্রের সক্রিয় ভূমিকার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং তার ফলে বেকারি হ্রাস করার সামাজিক ও মানবিক দিকগুলো নিয়ে আলোকপাত করেন জন মেনার্ড কেইন্স (‌১৯৩৬)‌। কেইন্সীয় তত্ত্ব অনুসারে অর্থনীতিতে ‌কার্যকরী চাহিদার সম্প্রসারণ ও ভোগ্যপণ্যবস্তুর উৎপাদনে বিনিয়োগ ‘‌মাল্টিপায়ারের’‌ দ্বারা সামগ্রিক ভাবে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে গতিময়তা আনা যায়। কেইন্সীয় এই ধারণার প্রয়োগ ঘটিয়ে পুঁজিবাদী দেশসমূহ বিশেষত, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তাদের ১৯২৯–‌এর বিশ্বব্যাপী মহামন্দার ধাক্কাকে সামাল দেয়।
পশ্চিমী দেশগুলোর বিপরীতে দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশগুলোর বৈশিষ্ট্য হল উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি। এই উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি রাষ্ট্র কর্তৃক সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের তত্ত্বটি প্রথম তুলে ধরেন আর্থার লুইস (‌১৯৫৪)‌। লুইসের তত্ত্বে উন্নয়নের খাতগুলোকে সনাতন ও আধুনিক হিসেবে বিভাজিত করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে এই সব দেশগুলোতে কৃষিখাতে অর্থাৎ সনাতন খাতে শ্রমশক্তি উদ্বৃত্ত থাকে। গ্রামাঞ্চলের এই উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তিকে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় যে মজুরি, তার থেকে কিছুটা বেশি মজুরি দিলেই শহরে এসে আধুনিক শিল্পখাতে কাজ করবে। এই স্বল্প মজুরির শ্রম ব্যবহার করে আধুনিক খাতের শিল্পোদ্যোক্তারা প্রচুর উদ্বৃত্ত অর্জন করবে। উদ্যোক্তারা তাদের উদ্বৃত্ত আধুনিক খাতে পুনর্বিনিয়োগ করবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। লুইসের এই তত্ত্ব ‘‌উন্নয়নের দ্বৈত খাতভিত্তিক তত্ত্ব’‌ বলে অভিহিত। পরবর্তীকালে রানিস ও ফেই (‌১৯৬৪)‌ দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করে তত্ত্বটিকে আরও সমৃদ্ধ করেন। লুইস–‌রানিস–‌ফেই–‌এর তত্ত্বে বর্ণিত প্রাম থেকে শহরে শ্রমের চলাচলের ফলে অর্থনৈতিক শিল্পের আপেক্ষিক গুরুত্ব বৃদ্ধিজনিত যে কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটে, তা প্রথম তুলে ধরেন সাইমন কুজনেটস (‌১৯৭০)‌। সব মিলিয়ে প্রতিটি অর্থেই কর্মসংস্থানে ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আন্তঃসম্পর্কটি আলোচিত হয়েছে।
গত শতাব্দীর ‌৭০–‌এর দশক থেকে সমাজ ও অর্থনীতিতে ‘‌দারিদ্র’‌ একটা বিষয় হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। ফলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জোর দিয়েছে ‘‌দারিদ্র হ্রাসে’‌ ‘‌কর্মসংস্থান বৃদ্ধির’‌ ভূমিকার বিষয়ে। আমাদের দেশে ‘‌সুসংহত গ্রামীণ বিকাশ কর্মসূচি’‌ ও ‘‌জহর রোজগার যোজনা’‌ হল এর উদাহরণ। ১৯৯৯ সালে আইএলও ঘোষণা করে ‘‌লক্ষ্য শুধু কর্মসংস্থান নয়, বরং গ্রহণযোগ্য মানের কর্মসংস্থান তৈরি করা। ২০১৬–‌তে জাতিসঙ্ঘের ‘‌টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য’‌ সনদে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে কর্মসংস্থানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই সনদটি এসডিজি–‌৮ নামে পরিচিত। এখানে উল্লেখ করা হয়েছে ‘‌সকলের জন্য পূর্ণ এবং উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান ও ভাল মানের কাজ–‌সহ স্থিতিশীল অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন’‌। এই লক্ষ্যটির কৌশলে ও পরিবীক্ষণের প্রক্রিয়ার জন্য পরিমাপযোগ্য কতগুলো সূচকের কথা বলা হয়ে থাকে। এগুলো হল শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার, বেকারির হার, জিডিপির প্রবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসংস্থানের স্থিতিস্থাপকতা, অভিবাসনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ইত্যাদি।

তথ্য সম্পর্কে কয়েকটি কথা

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই সূচকগুলির সাহায্যে বিগত তিন দশকে ভারতের অন্যতম অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থান ও আর্থিক প্রবৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করা হবে। আলোচনাটি মূলত তথ্যভিত্তিক আর সরকারি তথ্যই ব্যবহার করা হবে। তবে সরকারি তথ্য সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলা জরুরি। সরকারি ভাবে আমাদের দেশে শ্রমশক্তি ও শ্রমিক সম্পর্কে তথ্যের প্রধান উৎস হল ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেন (‌এনএসএসও)‌, সেন্সাস অফ ইন্ডিয়া ও লেবার ব্যুরো। এই তিনটির মধ্যে প্রথম দুটি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং যথেষ্ট সমাদৃত। ১৯৭২ সালে ডান্ডাওয়ালা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এনএসএসও শ্রমের বাজারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রতি পঁাচ বছর সমীক্ষা করে এবং সমীক্ষালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করে। স্বশাসিত এই সংস্থা শ্রমের ব্যাপ্তির ধরন অনুসারে শ্রমিকদের তিন ভাগে ভাগ করে:‌ বছর ভিত্তিক, সাপ্তাহিক ও দৈনিক। বছর ভিত্তিকের ক্ষেত্রে বিগত বছরে ১৮০ দিনের বেশি প্রধান কাজকে বিবেচনা করা হয়। সাপ্তাহিক ক্ষেত্রে বিগত সপ্তাহে প্রতিদিন ১ ঘণ্টার কাজকে ধরা হয় আর দৈনিক ক্ষেত্রে প্রতিদিনের কাজকে হিসেবে ধরা হয়। আমাদের দেশে কাজের যা ধরন তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এই বিভাজন করা হয়েছে। ২০১৪ সালে পরিকল্পনা কমিশনের অবলুপ্তির তিন বছর বাদে, ২০১৭ সালে অমিতাভ কুণ্ডু কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এই স্বশাসিত সংস্থার অবলুপ্তি ঘোষণা করা হয় এবং জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর নামে একটা নতুন সংস্থা গঠন করা হয়। এই ‘‌জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর’‌–এর মুখপাত্র হল ‘‌পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে’‌। এর প্রতিবেদন দু’‌ধরনের— ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক। এই সংস্থার প্রথম‌ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় এপ্রিল ২০১৭। এনএসএসও সম্পর্কে এত কথা বলার তাৎপর্য হল অবলুপ্তির ফলে তথ্যের ছন্দপতন ঘটেছে আর সমীক্ষার নমুনাচয়ন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ‘‌জনগণনা’‌ নিয়ে এখনও তেমন কিছু হয়নি, তবে ২০২১–‌এর জনগণনা যে এখনও শুরু হয়নি তা সকলেই জানেন। আমাদের দেশে ‘‌জনগণনা’‌র তথ্য অসীম গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪১ সাল বাদ দিলে এই ধারা ১৮৭২ থেকে চলে আসছে অথচ এ বিষয়ে শুধু কিছু অর্থবরাদ্দের কথা ঘোষিত হয়েছে। এনএসএসও–‌এর ছন্দপতন ও ‘‌জনগণনার’‌ বিলম্বের জন্য বর্তমান আলোচনা একটু ক্ষুণ্ণ হবে, একথা অনস্বীকার্য।

শ্রমশক্তি অংশগ্রহণের হার

সেন্সাস অনুযায়ী ২০১১ সালে পশ্চিমবাংলার জনসংখ্যা ছিল ৯.‌১২ কোটি আর মোট শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩.‌৪০ কোটি। এই হিসেবে মোট জনসমষ্টিতে ‘‌শ্রমশক্তি অংশগ্রহণের হার’‌ হল ৩৮.‌১ শতাংশ। আগেই বলা হয়েছে ২০২১–‌এর জনগণনা এখনও শুরু হয়নি। তবে ২০০১–‌১১ দশকে জনবৃদ্ধির হার (‌১৩.‌৮০ শতাংশ)‌ ও শ্রমিক সংখ্যার বৃদ্ধির হার (‌১৭.‌৮৯ শতাংশ)‌ ব্যবহার করে ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ‘‌শ্রমশক্তি অংশগ্রহণের হার’‌ নিরূপণ করা যায়। নিরূপিত এই হার হল ৩৯.‌৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ তফাতের মাত্রা ১.‌৩৫ শতাংশ। এর তাৎপর্য হল পশ্চিমঙ্গে সামগ্রিক ভাবে ২০২১ সালে প্রতি ১০০ জন ব্যক্তির মধ্যে ৩৯.‌৪৫ জন শ্রমের বাজারে আছে।
‘‌শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার’‌ (‌শঅগ)‌ বিষয়ক আলোচনা নানাভাবে করা হয়। এখানে তিন দিক থেকে দিয়ে আলোচনা করা হবে। প্রথমত, শহর ও গ্রামের মধ্যে ‘‌শঅগ’–‌এর পার্থক্য দেখা হবে। দ্বিতীয়ত, নারী ও পুরুষের মধ্যে ‘শঅগ–‌এর পার্থক্য দেখা হবে। সবশেষে ‘‌শঅগ’–‌এর আন্তঃরাজ্য পার্থক্য দেখা হবে।
শহর ও গ্রামের মধ্যে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের বিষয়টির বিভাজন সারণি ‌১–‌‌এ রাখা হয়েছে। সারণি ‌১–‌এ ব্যবহৃত তথ্য প্রসঙ্গে কয়েকটা কথা বলা দরকার। প্রথমত, তথ্য শুধুমাত্র ‘‌পুরুষ’–‌এর জন্য রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ২০২১–‌এর জনগণনা যেহেতু হয়নি সেই কারণে ‘‌পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স’–‌এর তথ্য ২০১৮–‌১৯–‌এর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।

সারণি ১:‌ শ্রমশক্তিতে শহর ও গ্রামের মধ্যে পার্থক্য (‌%‌)‌
পশ্চিমবঙ্গ:‌ ‌১৯৮০–‌২০১৯
বছর শহর গ্রাম মোট
১৯৮১ ৪৮.‌৭০ ৪৮.‌৭২ ৪৮.‌৭১
১৯৯১ ৪৯.‌৬৪ ৫২.‌০৯ ৫১.‌৪০
২০০১ ৫৪.‌০৭ ৫৪.‌৩০ ৫৪.‌২৩
২০১১ ৫৬.‌৮৪ ৫৭.‌২০ ৫৭.‌০৭
২০১৮-‌১৯ ৬০.‌৪০ ৫৭.‌৯০ —

সূত্র:‌ জনগণনা বিভিন্ন বছর, পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১৮-‌১৯।

ওপরের সারণি থেকে এটা পরিষ্কার ১৯৮১ থেকে ২০১১-‌এর পরিসরে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে পুরুষের মধ্যে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার শহরাঞ্চলের তুলনায় বেশি ছিল। ২০১১ থেকে ২০১৮-১৯‌এর পরিসরে গ্রামাঞ্চলে শ্রমশক্তির হারে স্থবিরতা আসে এবং আপেক্ষিকভাবে শহরাঞ্চলে শ্রমশক্তিতে আংশগ্রহণের হার বেড়ে যায়। ঠিক কোথায় কাজের সুযোগ বেড়েছে তা আমরা পরে দেখব।
শ্রমশক্তিতে পুরুষ ও নারীর অংশগ্রহণের হার বিষয়ক তথ্য সারণি ‌২-‌এ রাখা হয়েছে।

সারণী ২:‌ শ্রমশক্তিতে নারী ও পুরুষ অংশগ্রহণের হার (‌%‌)‌
পশ্চিমবঙ্গ:‌ ১৯৮১–‌২০১৮–‌১৯
বছর মোট পুরুষ নারী
১৯৮১ ২৯.‌৩৪ ৪৮.‌৭১ ৮.‌০৭
১৯৯১ ৩২.‌২০ ৫১.‌৪০ ১১.‌৩০
২০০১ ৩৬.‌৭৮ ৫৪.‌২৩ ১৮.‌০৩
২০১১ ৩৮.‌০৮ ৫৭.‌০৭ ১৮.‌০১
২০১৮–‌১৯ ৪৪.‌১৭ ৬০.‌০৫ ১৭.‌৫০

সূত্র:‌ জনগণনা বিভিন্ন বছর, পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১৮-‌১৯ (অনুমিত)।

ওপরের সারণিতে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে নারী ও পুরুষের মধ্যে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হারের পার্থক্য যথেষ্ট। তবে যা বলা দরকার তা হল ১৯৮১–‌২০১১–‌এর পরিসরে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার ধীরে ধীরে বেড়েছে। তবে বিগত দশকে অর্থাৎ ‘‌মা-মাটি-‌মানুষের’‌ জমানায় তা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে ১৭.‌৫০ শতাংশ হয়েছে। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার হ্রাস পাওয়ার বিষয়টা অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কুজনেটস (‌১৯৭০) এর মতে অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে যদি শিল্প ক্ষেত্রের প্রাধান্য উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে, তাহলে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ নানাভাবে বাড়ে। আর যদি শিল্প ক্ষেত্রের প্রাধান্য না বাড়ে তাহলে নারীরা গৃহবন্দি হয়ে পড়ে। আমাদের ধারণা এ–‌রাজ্যে তাই ঘটেছে।
ভারতের ১৫টি নির্বাচিত রাজ্যে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ২০১১ থেকে ২০২০-২১‌এর পরিসরে কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা সারণি ৩-এ রাখা হয়েছে। এখানে বলা দরকার ২০১১এর তথ্যের উৎস জনগণনা আর ২০২০-২১‌এর তথ্য ‘‌পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে’‌।

শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার (‌%‌)‌ ২০১১ থেকে ২০২০-‌২১

২০১১ থেকে ২০২০-২১‌এর পরিসরে শ্রমশক্তিতে (‌পুরুষ)‌ অংশগ্রহণের হার কেবলমাত্র পশ্চিমবাংলা বাদে বাকি ১৪টি নির্বাচিত রাজ্যে হয় বেড়েছে না হয় একই জায়গায় আছে। যে রাজ্যগুলোতে এই হার বেড়েছে সেগুলি হল উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, জম্মু ও কাশ্মীর, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়। এছাড়া মহারাষ্ট্র, গুজরাট, ওড়িশা, কর্ণাটক ও তামিলনাডুতে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার কমবেশি একই জায়গায় আছে। শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হারের এই আন্তঃরাজ্য পার্থক্য থেকে পশ্চিমবাংলা থেকে পশ্চিম বা দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে শ্রমের অভিবাসন সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। এর মধ্য দিয়ে পূর্বে বর্ণিত ‘‌লুইস তত্ত্বের’‌ বাস্তবতা অনুধাবন করা যায়। আলোচনার শেষাংশে এই অভিবাসনের মাত্রা সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া হবে। আপাতত শ্রমের বাজারের পূর্ণাঙ্গ আলোচনার জন্য ‘‌শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হারের’‌ পরিপূরক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে বেকারির হার সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলা হবে।

বেকারি ও তার সাম্প্রতিক প্রবণতা

বেকারি সমস্যার দুটি দিক আছে। প্রথমত, বেকারদের হাতে অব্যবহৃত সময় থাকে, আয় থাকে না। দ্বিতীয়ত, বেকারি বেশি হওয়ার অর্থ হচ্ছে উৎপাদনক্ষম সম্পদের অপচয়। সাধারণভাবে কোনও ব্যক্তি (‌সাধারণত ১৫ বছরের বেশি বয়স)‌ যদি কাজের সন্ধান বা চেষ্টা করে থাকে, অথচ কাজ পায় না অর্থাৎ কোনওরকম উপার্জন করতে পারে না, তখন তাকে বেকার বলে। কোনও অর্থনীতিতে বেকারের মোট পরিমাপকে মোট জনসমষ্টি দিয়ে ভাগ করলে বেকারির হার পাওয়া যায়। সাধারণভাবে বেকারির হার পাঁচ শতাংশের কম থাকলে সেটা সন্তোষজনক। তার ওপরে উঠলে বা দুই অঙ্ক অতিক্রম করলে তা দুশ্চিন্তার কারণ। পশ্চিমবাংলা তথা ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে এই বেকারির হার ১৯৯৩-৯৪ থেকে ২০১৯-‌২০এর পরিসরে কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তা সারণি ‌৪-‌এ রাখা হয়েছে।

সারণী ৩:‌ বেকারির হার (‌%‌)‌ পশ্চিমবাংলা ও ভারত:‌ ১৯৯৩-২০২০
বছর পশ্চিমবাংলা ভারত পশ্চিমবাংলা ভারত
শহর গ্রাম
১৯৯৩-‌৯৪ ৭.‌৯ ৪.‌৫ ১.‌৮ ১.‌২
১৯৯৯-২০০০ ৭.‌৬ ৪.‌৭ ২.‌৮ ১.‌৫
২০০৪-‌২০০৫ ৬.‌২ ৪.‌৫ ২.‌৫ ১.‌৭
২০০৭-‌২০০৮ ৫.‌৮ ৪.‌১ ২.‌৬ ১.‌৬
২০০৯-‌২০১০ ৪.‌০. ৩.‌৪ ১.‌৯ ১.‌৬
২০১১-২০১২ ৪.‌৮. ৩.‌৪ ২.‌৭ ১.‌৭
২০১৭-‌২০১৮ ৬.‌৫ ৭.‌৮ ৩.‌৮ ৫.‌৩
২০১৮-‌২০১৯ ৪.‌৯ — ৩.‌৩ —
২০১৯-‌২০২০ ৫.‌১ — ৪.‌৪ —

সূত্র:‌ এনএসএসও বিভিন্ন রাউন্ড ও পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে

ওপরের সারণি ‌৪ থেকে এটা দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবাংলায় শহরের ক্ষেত্রে বেকারির হার ১৯৯৩-‌৯৪ থেকে ২০০৯-‌১০ পর্যন্ত ধীর গতিতে হ্রাস পেয়েছে। ২০০৯-‌১০ সালে এটা সর্বনিম্ন অর্থাৎ ৪ শতাংশ হয়েছে। তারপর এটা বেড়ে ২০১৭-‌২০১৮ সালে ৬.‌৫ শতাংশ হয়েছে। ২০১৯-২০ সালে এই হার হল ৫.‌৯ শতাংশ, যা সংখ্যা অনুযায়ী দুশ্চিন্তার কারণ। রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে বেকারির হার কখনওই ৫ শতাংশ অতিক্রম করেনি। তবে ১৯৯৯-‌২০০০ থেকে ২০০৯-‌১০‌এর পরিসরে এই হার ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। ২০০৯-১০এ এই হার মাত্র ১.‌৯ শতাংশ ছিল তারপর তা উর্ধ্বমুখী। ২০১৯-‌২০ সালে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে বেকারির হার ৪.‌৪ শতাংশ, যা ইতিপূর্বে কখনওই ছিল না। প্রসঙ্গত বলা দরকার, ২০১১ থেকে ২০১৮এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে বেকারের সংখ্যা গ্রামাঞ্চলে ৮.‌৩ লক্ষ বেড়েছে ও শহরাঞ্চলে বেড়েছে ৬.‌৫ লক্ষ। পশ্চিমবাংলায় বেকারি–‌প্রসঙ্গে উদ্বেগজনক বিষয় হল শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারির হার। ২০১৭-‌১৮‌এর পিএলএফএস অনুযায়ী ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেটধারীদের ২৯.‌২০ শতাংশ বেকার। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরদের ক্ষেত্রে এই হার যথাক্রমে ২.‌০ শতাংশ ও ১৩.‌৭ শতাংশ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে যে সাবেকি ধাঁচের পড়াশোনা তথা কর্মসংস্থান তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে। ওপরে শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারির হার তার নির্দেশক। এই বিষয়টা একটু অন্যভাবে আলোচনা করা হবে।

কর্মসংস্থানের স্থিতিস্থাপকতা

উন্নয়নশীল দেশে যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়, তখন সেটা স্বাভাবিকভাবে শিল্প ও অন্যান্য অকৃষিখাতের প্রসার ঘটায়। বিষয়টা ১৯৭০ সালে সাইমন কুজনেটস্‌ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এসব খাতে বিনিয়োগ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব। কাজেই জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতির কাঠামোরও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। একই সঙ্গে কর্মসংস্থানের খাতভিত্তিক কাঠামোর পরিবর্তন হয়। এই দু’‌টি বিষয় অর্থাৎ মোট কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার ও জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে একটি সূচকের সাহায্যে প্রকাশ করা হয় যা কর্মসংস্থানের স্থিতিস্থাপকতা বলে পরিচিত। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৮এর পরিসরে ভারতের ক্ষেত্রে এই হিসেবটি করেছেন পাপালো (‌১৯৯২)‌ আর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এটা করেছেন অভিজিৎ মিস্ত্রী (‌২০২১)‌। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে হিসেবটা ১৯৯৩ থেকে ২০১৮‌এর পরিসরে। এখানে অর্থনীতিকে তিনটি খাতে বিভাজন করা হয়েছে যথা:‌ কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র, শিল্পক্ষেত্র এবং সেবাক্ষেত্র। উপরোক্ত ২৫ বছর সময়কে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলি হল:‌ ১৯৯৩-‌৯৪ থেকে ১৯৯৯-‌২০০০, ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৪-‌০৫, ২০০৪-‌০৫ থেকে ২০০৯-১০ এবং ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮। এই চারটি সময়সীমার পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিক্ষেত্র, শিল্পক্ষেত্র ও সেবাক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের স্থিতিস্থাপকতার মানগুলো সারণী ‌৫-‌এ রাখা হয়েছে।

সারণী ৪:‌ ক্ষেত্রভিত্তিক কর্মসংস্থানের স্থিতিস্থাপকতা:‌ পশ্চিমবঙ্গ:‌ ১৯৯৩-২০১৮

সময় কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র শিল্পক্ষেত্র সেবাক্ষেত্র মোট
১৯৯৩-৯৪ থেকে ১৯৯৯-‌২০০০ ০.‌১১ ০.‌০৪ ০.‌২৩ ০.‌১৩
১৯৯৯-‌২০০০ থেকে ২০০৪-‌০৫ ১.‌২৫ ০.‌৩৫ ০.‌৭৩ ০.‌৬২
২০০৪-‌০৫ থেকে ২০০৯-‌১০ –‌০.‌১৮ ০.‌৯৫ ০.‌২০ ০.‌২৩
২০১১-১২ থেকে ২০১৭‌-‌১৮ –‌০.‌০৭ -‌০.‌১৯ ০.‌১৫ ০.‌০৩

সূত্র:‌ মিস্ত্রী (‌২০২১)‌

সারণি ৫–‌এ দেখা যাচ্ছে কর্মসংস্থানের স্থিতিস্থাপকতার সার্বিক মান ২০১১–‌১২ থেকে ২০১৭–‌১৮–‌এর পরিসরে সর্বাপেক্ষা কম (‌০.‌০৩)‌। আরও লক্ষণীয়, এই সময়সীমায় কৃষিক্ষেত্রে ও শিল্পক্ষেত্রে এই সূচকের মান ঋণাত্মক। এর তাৎপর্য হল এই দুই ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান হয়নি। বস্তুতপক্ষে কর্মচ্যুতি হয়েছে। নতুন কর্মসংস্থান যা হয়েছে তা হল সেবাক্ষেত্রে। এখানে যা বলা দরকার তা হল সেবাক্ষেত্রের অসংখ্য উপক্ষেত্র আছে। যাদের মধ্যে অন্যতম হল রিয়েল এস্টেট ও ফিন্সাস সম্পর্কিত কাজকর্ম। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। এখানে যে বিষয়টা আলোচিত হবে তা হল কৃষিক্ষেত্র ও শিল্পক্ষেত্র থেকে কর্মচ্যুতিজনিত শ্রমিকের অভিবাসন যা রাজ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।

অভিবাসন

শ্রমিকের অভিবাসনের বিষয় বহুধা বিস্তৃত। এদের মধ্যে প্রধান হল আন্তঃরাষ্ট্র ও অন্তঃরাষ্ট্র। অন্তঃরাষ্ট্রের বিষয়টা আবার আন্তঃরাজ্য ও অন্তঃরাজ্যের মধ্যে বিভক্ত। এখানে শুধু আন্তঃরাজ্যের বিষয়টা আলোচনায় রাখা হবে। অর্থাৎ পশ্চিমবাংলা থেকে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে শ্রমিকের আগমন ও নির্গমনের বিষয়টা দেখা হবে। এই অভিবাসনে আবার গ্রাম থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে গ্রাম এবং শহর থেকে শহরে অভিবাসনের মাত্রা দেখা হবে। এই অভিবাসনের মাত্রা ১৯৯১, ২০০১ এবং ২০১১–‌এর আদমশুমারির তথ্যের সাহায্যে করা হবে। এখানে বলা দরকার, ২০২১‌এর আদমশুমারি এখনও না হওয়ার জন্য ২০০১ থেকে ২০১১এর প্রবণতার ভিত্তিতে ২০২১–‌এর অভিবাসনের মাত্রাকে নিরূপণ করা হয়েছে। এভাবে নিরূপিত অভিবাসনের মাত্রা অর্থাৎ বিগত ৩০ বছরে কত লোক পশ্চিমবঙ্গে এসেছে ও অন্য রাজ্যে গেছে তার চিত্র সারণী ৬–‌তে রাখা হয়েছে।‌

সারণী ‌৫:‌ পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসন:‌ ১৯৯১-‌২০২১
সময় আন্তঃ‌রাজ্য আগমন আন্তঃরাজ্য নির্গমন নীট হিসেব
১৯৯১ ৫,৯৭,১২৮ — —
২০০১ ৭,২৪,৫২৪ ৭,৩০,২২৬ -৫৭০২
২০১১ ৭,২৯,৭০২ ১০,১১,৩৪০ -‌২,৮১,৬৩৮
২০২১ (‌অনুমিত) ৭,৩৪,৯১২ ১৩,৯৫,৬৪০ -‌৬,৬০,৭২৮

সূত্র:‌ মিস্ত্রী (‌২০২১)‌, লেখকের হিসেব।

ওপরের সারণি ‌৬ একথা সহজেই পরিষ্কার এ রাজ্যে থেকে‌ ভিন্ন রাজ্যে যাওয়ার পরিমাণ উত্তরোত্তর বাড়ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে নির্গমন রাজ্যের শহরাঞ্চল থেকে বেশি হচ্ছে না গ্রামাঞ্চল থেকে বেশি হচ্ছে?‌ অভিজিৎ মিস্ত্রী (‌২০২১)–‌এর প্রবন্ধ অনুযায়ী ১৯৯১ সালে গ্রাম থেকে অন্য রাজ্যে নির্গমন মোট নির্গমনের ৪৪.‌১ শতাংশ ছিল। এই মাত্রা ২০০১ সালে ৫১.‌১ শতাংশ হয় এবং ২০১১ সালে ৪৯.‌৪ শতাংশ হয়। পাশাপাশি শহর থেকে ভিন্ন রাজ্যে অভিবাসনের মাত্রা ১৯৯১ সালে ছিল ৫৫.‌১ শতাংশ, ২০০১ সালে হয় ৪৮.‌৯ শতাংশ এবং ২০১১ সালে ৫০.‌৯ শতাংশ। এই দুই প্রবণতা অর্থাৎ গ্রাম থেকে অন্য রাজ্যে পাড়ি দেওয়ার মাত্রা এবং শহর থেকে অন্য রাজ্যে পাড়ি দেওয়ার মধ্যে গ্রাম থেকে যাওয়ার প্রবণতা আপেক্ষিকভাবে। আমাদের অনুমান এই প্রবণতা ২০১১–‌২০২১–‌এর দশকেও বর্তমান থাকবে যা সারণী ৫-এ ইতিপূর্বে বলা হয়েছে।

উপসংহার

কর্মসংস্থানের জন্য আর্থার লুইস বর্ণিত সনাতন ক্ষেত্র (‌কৃষি)‌ আধুনিক ক্ষেত্রে শ্রমের চলাচল আমাদের দেশে নতুন নয়। আর ধাক্কায় সাইমন কুজনেটস বর্ণিত অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তনও যে আমাদের দেশে হয়নি তা নয়। তবে এই কাঠামোগত পরিবর্তন ‘‌ক্ল্যসিকাল ফর্ম’‌এ ঘটেনি। শিল্পক্ষেত্র পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার আগেই সেবাক্ষেত্রের সম্প্রসারণ ঘটে। সেবাক্ষেত্রের সম্প্রসারণও যে সুষমভাবে হয়েছে তা নয়। ‘‌ইনফরমেশন টেকনোলজি ও ফাইনান্সের যুগে’‌ কতগুলি সীমিত ক্ষেত্রে তার সম্প্রসারণ ঘটেছে। ফলে কুজনেটস বর্ণিত কাঠামোগত পরিবর্তন এখানে হল না। একটা বিকৃত পরিবর্তন হল। এটা অনুধাবনের আদর্শ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ জুড়ে হুগলি নদীর দু’‌ধার জুড়ে যে চটশিল্প ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প গড়ে উঠেছিল তার অভিঘাতে ‘‌বিমারু’‌ রাজ্যগুলি থেকে এ রাজ্যে শ্রমিকের অভিবাসন ঘটে। শাস্ত্রে এটাকে ‘‌মাইগ্রেশন করিডর’‌ বলে। শহর কলকাতা পূর্ব ভারতের ভরকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে দুটি পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। প্রথমত, ভরকেন্দ্রের কাঠামোগত পরিবর্তন, দ্বিতীয়ত, দেশের অন্যত্র নতুন নতুন ভরকেন্দ্রের উদ্ভব। ভরকেন্দ্রের কাঠামোগত বিকৃত পরিবর্তনের জন্য ভরকেন্দ্র তার আকর্ষণী ক্ষমতা হারাতে থাকে। একই সঙ্গে ভারতের অন্যত্র নতুন নতুন ভরকেন্দ্র হওয়ার ফলে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি নতুন ভরকেন্দ্রের দিকে ধাবিত হয়। অর্থাৎ ‘‌মাইগ্রেশন করিডর’‌–‌এ পশ্চিমবঙ্গের নাম সংযোজিত হয়। আদমশুমারির ভাষায় যে রাজ্য ছিল ‘‌প্লেস অফ ডেসটিনেশন’‌ এখন তা হল ‘‌প্লেস অফ্‌ অরিজিন’‌। এই রাজ্যে ‘‌শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার’‌, বেকারির হার, উৎপাদনের ক্ষেত্রগত প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের স্থিতিস্থাপকতার মান ইত্যাদি এই রাজ্যের অর্থনৈতিক স্থবিরতাকে নির্দেশ করে ও ‘‌প্লেস অফ্‌ অরিজিন’‌কে ব্যাখ্যা করে। এই বাস্তবতার সমাধানের জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা। কোনও ‘‌অনুদানের দর্শন’‌ বা অভিবাসিত শ্রমিকদের দুর্ঘটনাজনিত বা দাঙ্গাজনিত অকালমৃত্যুতে ‘‌কুম্ভীরাশ্রু’‌ বিসর্জনে এর সমাধান হবে না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.