বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

সাংবাদিকতার কাজে অভিজ্ঞতা

সাংবাদিকতার কাজে অভিজ্ঞতা

অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়

photo

আমাদের বোনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর রাতে মেয়েদের চলাফেরা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারা কোন সময় বেরোবে, কোন সময় বাড়ি ঢুকবে — এসব কারুর ফতোয়ায় ঠিক হবে কেন? ১৯৮১ সালে রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিয়ে আমি নিয়মিত নাইট ডিউটি দিতাম। নিয়মিত মানে, সপ্তাহে একদিন। আজকাল-এর প্রথম সম্পাদক গৌরকিশোর ঘোষ মেয়েদের নাইট ডিউটি চালু করেন। তিনি সাংবাদিকতার অনেক ক্ষেত্রে পথিকৃৎ সম্পাদক সেই সময় মেয়েদের নাইট ডিউটি দেওয়ার সাহস উনি দেখিয়েছিলেন। আমি একটাই কাজ করেছিলাম — তাঁর দেওয়া সুযোগ লুফে নিয়েছিলাম।

আমাদের নাইট ডিউটি শুরু হতো সন্ধ্যে ছ’টায়। নাইট ডিউটিতে করা দু’একটা ঘটনার কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। ২৫ মার্চ আমাদের কাগজ প্রথম প্রকাশিত হয়। তার ক’দিন বাদেই বিরোধী কংগ্রেস দলের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ছিল এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে। তখন আমি পুলিশ বীট করতাম। তাই ঘটনাস্থলে আমি উপস্থিত ছিলাম। বড় ঘটনা বলে কাগজের আরও দু’তিনজন ঘটনাস্থলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন। সেই খবর লেখার পর (আমি লিখিনি, তথ্য সরবরাহ করছিলাম) রাতে বাড়ি ফিরছিলাম। সেদিন একটু বেশিই রাত হয়েছিল।

আমি বেহালার মিনিবাস ধরার জন্য কার্জন পার্কের সামনে এসে দাঁড়াতাম। সেদিন একটু বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় মিনিবাসের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। কার্জন পার্ক জায়গাটা ‘ভাল’ ছিল না। অন্যদিন লোকজন থাকায় বা বেহালার মিনিবাস দাঁড়িয়ে থাকায় কোনও অসুবিধে হত না। সেদিন কোনও অপেক্ষমান যাত্রী ছিলেন না, মিনিবাস স্ট্যান্ডে আমি একা। ভয় করছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে ওখানে দু’তিনজন চলে এল। তারা হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। হাতছানি দেওয়ার কায়দা ছিল অভিনব — লোকগুলি হাত দুটো পেছনে করে হাতছানি দিচ্ছিল, যাতে তা পরিস্কার দৃশ্যমান না হয়। বুক দুরদুর করছিল। আমার ভাগ্য ভাল, অল্প সময়ের মধ্যে মিনিবাস এসে গেল। রাত এগারটার পর তখন কলকাতার রাস্তায়, বিশেষত এসপ্ল্যানেড, পার্ক স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট অঞ্চলে চলাফেরা করা কঠিন ছিল।

তার কিছুদিন আগে পর্যন্ত পার্ক স্ট্রিট-ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মুখে আলিয়াঁজ ফ্রাঁসেজে ফ্রেঞ্চ শিখতে যেতাম। ডিপ্লোমা বা ডিপ্লোমা-সুপেরিয়রের ক্লাস থাকত সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা থেকে ন’টা পর্যন্ত। ওখানকার ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশেরই নিজস্ব গাড়ি ছিল। আমার ছিল না। রাত ন’টায় ক্লাস শেষ হওয়ার পর প্রফেসরদের সঙ্গে কাফেতে বসে একটু আড্ডা হত (আসল উদ্দেশ্য, গল্পগুজবের মাধ্যমে ফ্রেঞ্চ শেখানো)। ওই লেভেলের সব পড়ুয়াই কাফেতে থাকত। কফি খেতে খেতে আরও খানিকটা দেরি হত। রাত দশটার পার্ক স্ট্রিট ভয়াবহ। দালালরা কানে কানে ... হোটেলে যাওয়ার কথা বলত। ‘রেট’ বলত। রাতে গড়িয়াহাট হোক বা বেহালা কিংবা বাগবাজার — কোথাও উৎপাত পাইনি। মধ্য কলকাতার রাত মেয়েদের পক্ষে বিপজ্জনক।

বাংলার বহু জেলায় ঘুরেছি। অনেক রাত অবধি কাজ করতে হয়েছে। সেসব রাতেও কোনও সমস্যা হয়নি। এসব ক্ষেত্রে কেবল যৌন সমস্যার কথাই বলছি। অন্য আর যা অসুবিধে, সেসব আমরা ‘প্রফেশনাল হ্যাজার্ড’ হিসেবেই নিই।

আমি দেশের প্রায় সব রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কভার করতে গেছি। কখনও কখনও বহুরাত হয়েছে। যেমন, অন্ধ্রপ্রদেশে (তখন বিভক্ত হয়নি) পালাবদল হয়েছিল রাতে। এনটিআর-এর হাত থেকে তাঁর জামাই চন্দ্রবাবু নাইডু ক্ষমতার রশি হাতে নিয়েছিলেন। সাংবাদিকরা হায়দ্রাবাদ রাজভবনের কাছাকাছি একটা জায়গায় রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানে সব কাগজের সাংবাদিক হাজির থাকায় কোনও সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। হয়ওনি। কিন্তু অন্য বিভিন্ন ঘটনা কভার করার সময় ট্রেন বা ভোরের ফ্লাইট ধরতে রাতে বেরোতে হয়েছে। দক্ষিণ ভারতে আমি বহুবার গেছি। একবিন্দু সমস্যায় পড়িনি।

কিন্তু সব রাজ্যকে আমি এই সার্টিফিকেট দিতে পারছি না। পাটনা ও লক্ষ্মৌতে অটো রিকশায় ঘুরেছি রাতে, এ নেতার বাড়ি থেকে ও নেতার বাড়ি বা দলীয় কার্যালয়ে। পাশে পাশে বাইক ছুটিয়েছে দুষ্কৃতিরা। আজেবাজে মন্তব্য ছুঁড়েছে। অটো চালকরা খুব সাহায্য করেছেন। সুরক্ষিত আশ্রয়ে নিয়ে গিয়ে অটো চালক বলেছেন, ‘এখানে চা খান, বা এই বাড়ির গেট খুলে ঢুকে পড়ুন।’ পাটনার হোটেল আমাকে বলে দিয়েছিল, যাই করুন রাত আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে ফিরে আসবেন। হোটেল সম্রাট। এটাই তখনকার পাটনার অবস্থার কথা স্পষ্ট করে। হোটেলটি বড় রাস্তার ওপর এবং শহরের মোটামুটি কেন্দ্রস্থলে।

সময়টা কিন্তু মোবাইল, ওয়াইফাইয়ের যুগ ছিল না। আমাদের কাগজে লিখে প্রথমদিকে টেলিপ্রিন্টার/ টেলেক্সে খবর পাঠাতে হতো। পরের দিকে ফ্যাক্স ব্যবস্থায় অনেকটা সুবিধে হয়েছিল। সেজন্য খবর পাঠিয়ে হোটেলে ফেরার মুখেও কয়েকটি শহরে মৌখিক যৌন হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছে। আবারও বলছি, দক্ষিণ ভারতে কখনও সমস্যায় পড়তে হয়নি।

আমাদের তিলোত্তমা তাঁর কাজের জায়গায় ধর্ষিত ও খুন হয়েছেন। আমার কথা শুনবেন? আমাদের কোম্পানির তখন অত টাকা ছিল না যে, প্রত্যেক নাইট ডিউটির কর্মীকে গাড়ি করে বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া যায়। একটা কাগজে নাইট রিপোর্টার ছাড়াও ডেস্কে দু’তিনজন থাকেন, স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের লোকজন থাকেন। আমরা অফিসের টেবিলে দিব্যি চাদর পেতে আর গায়ে চাদর জড়িয়ে গল্পগুজব করতাম। কোনও কোনওদিন টেবিলের ওপরই ঘুমোতাম। ভোরে বাস-ট্রাম চললে, বাড়ি ফিরতাম। সেখানে আমি একা মেয়ে, বাকি সব পুরুষ-সহকর্মী। প্রথম প্রথম একটু জড়তা যে লাগেনি, তা নয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিলাম, বাড়ির পরে কর্মক্ষেত্রই আমার সব থেকে নিরাপদ জায়গা।

অনেকেই বলবেন, গোটা সমাজটাই আর আগের মতো নেই।
কলুষিত হয়েছে পরিস্থিতি, মানুষের মানসিক অবনমন হয়েছে। সমাজ পচে গেলে রাজনীতি টাটকা থাকবে কী করে? সত্যিই কি তাই? আমার ধারণা, ব্যস্ততা, প্রতিযোগিতার দৌড়, কাজের চাপ — এসবের মধ্যে লুকিয়ে আছে সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো। হারায়নি কিছুই। সঠিক সময়ে মানুষের ভেতরের অনুভূতিগুলো ঠিক বেরিয়ে আসে। আমাদের তিলোত্তমার ঘটনাই দেখুন না। কোনও সেলিব্রিটি নয়, একজন সাধারণ মেয়ে রিমঝিম বলল, ‘রাত দখল কর’। ও একা বলল, আর আমাদের বুকে প্রতিবাদের দ্রিমি দ্রিমি বাজনা বেজে উঠল। ১৪ আগস্ট রাত কলকাতা ভেসে গেল প্রতিবাদীদের কন্ঠস্বরে, প্রতিবাদীদের পায়ের চিহ্নে। স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদ। অন্যায়ের বিচার চেয়ে। মেয়ে নয়, মেয়ে-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, মধ্যবয়স্ক, বুড়ো-বুড়ি সব পৌঁছে গেল প্রতিবাদী পয়েন্টে। সেদিন এই বুড়িটাও ১১-৫৫ মিনিটের আগেই পৌঁছে গিয়েছিল যাদবপুর পয়েন্টে।

রাতের সব তারাই আছে / দিনের আলোর গভীরে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.