বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
স্কুল খুলবে ১৫ জুন। ফের কি পড়ুয়াদের পাতে পড়বে মুরগির মাংস, নিয়মিত ডিম, শেষ পাতে মরশুমি ফল? জানুয়ারি থেকে এপ্রিল চার মাসের জন্য এমন বরাদ্দ করেছিল শিক্ষা দপ্তর। বরাদ্দ করা হয়েছিল ৩৭২ কোটি টাকা। প্রতি সপ্তাহে মাথাপিছু ২০ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ করা হয়েছিল। অর্থাৎ, সপ্তাহে ছ’দিন ধরলে ৩.৩৩ পয়সা। প্রাথমিকের নিয়মিত বরাদ্দ ৫.৪৪ পয়সা। আর উচ্চ প্রাথমিকে ৮.১৭ পয়সা। তাহলে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল যথাক্রমে, ৮.৭৭ পয়সা ও ১১.৫০ পয়সা। নিন্দুকেরা তখন বলেছিল, পঞ্চায়েত ভোটের মুখে অভিভাবকদের খুশি করতেই এটা ভোটমুখী চাল। না হলে চার মাস কেন?
পঞ্চায়েত ভোটেরও ঘোষণা হয়ে গেল। এ যেন, কন্যার মতামতের তোয়াক্কাহীন অভিভাবকের আদেশ— উঠ ছেমরি তোর বিয়া। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে প্রকাশিত হল ভোটের নির্ঘণ্ট। সে অন্য প্রসঙ্গ, বারান্তরে আলোচনা করা যাবে। কিন্তু, ছাত্রদের, অভিভাবকদের, মিড-ডে মিলের রাঁধুনি দিদিদের দীর্ঘকালীন দাবি তো মিড-ডে মিলের বরাদ্দ বাড়ানোর। সেটি বাড়বে কি? ৩০ মে তাপদাহ উপেক্ষা করে কলকাতা অভিযান করেছিলেন মিড ডে মিল সহায়িকারা। অ্যাসোসিয়েশন অব মিড-ডে মিল অ্যাসিস্ট্যান্টস (আম্মা)-র ছাতায় তলায় গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে রানি রাসমণি রোডে জড়ো হয়েছিলেন বেশ কয়েকশো ‘দিদি’। সভা ছাড়াও তাঁরা সদলবলে তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে দেখা করেছিলেন রাজ্যের মিড-ডে মিলের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর সঞ্জীব মণ্ডলের সঙ্গে। আলোচনায় যা উঠে এল তার নির্যাস এরকম, তিনি সহায়িকাদের প্রতি সহানুভূতিশীল; সহায়িকাদের ন্যূনতম মজুরি, চাকরির স্বীকৃতি, ১০ মাসের জায়গায় ১২ মাসের মজুরি, মাতৃত্বকালীন ছুটির মতো দাবিগুলির সঙ্গেও সহমত, তাঁদের কাজের অনিশ্চিতয়তা রয়েছে তাও মানেন এবং বরাদ্দ বাড়ানো উচিত বলেও তিনি মনে করেন— কিন্তু, কেন্দ্র বরাদ্দ না বাড়ানোয় কিছু করা যাচ্ছে না। আর বরাদ্দ বাড়ানোর কোনও নির্দেশও তার কাছে নেই। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল ৩৭২ কোটি টাকা ফ্লেক্সি ফান্ড থেকে রাজ্য বরাদ্দ করেছিল। সে টাকা শেষ। নতুন কোনও নির্দেশও নেই। অতএব, অতিরিক্ত বরাদ্দের গুড়ে বালি।
মানে, সহায়িকাদের ভাষায়, সেই ট্যালটেলে আলুর ঝোল আর ভাতে ফিরে যাওয়া। ঠিক কত বরাদ্দ মিড-ডে মিলে? আগেই জেনেছি, প্রাথমিকে ৫.৪৪ পয়সা ও উচ্চ প্রাথমিকে ৮.১৭ পয়সা। এই আট মাস আগেই তা ছিল যথাক্রমে ৪.৯৭ পয়সা ও ৭.৪৫ পয়সা। গত ৭ অক্টোবর এই প্রকল্পে মাত্র ৯.৬% বরাদ্দ বৃদ্ধি করে কেন্দ্রীয় সরকার। এই টাকায় জ্বালানি, ডাল, সব্জি, সপ্তাহে দু’দিন ডিম দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে। খাদ্য সুরক্ষা আইন অনুযায়ী চাল দেয় কেন্দ্র। ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধির সময়ে তাই নুন আনতে পান্তা ফুরনোর দশা। ডাল হলে সয়াবিন বাদ পড়ে, সয়াবিন হলে ডাল। সপ্তাহে একটা ডিম দিতে গেলেও আপস করতে হচ্ছে অন্য পদ বাদ দিয়ে। গ্যাসে রান্না করা বাধ্যতামূলক অথচ গ্যাসের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলে, তাই বহু জায়গায় গোবর-কাঠি ভরসা।
কিন্তু, এদিকে আবার একটা গোল বেঁধেছে। ৩০ মে আম্মা’র প্রতিনিধিদের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর জানিয়েছিলেন, বাড়তি খাবার দেওয়ার কোনও নির্দেশ নেই। এখন শোনা যাচ্ছে, বাড়তি খাবার দেওয়ার ভাবনা-চিন্তা করছে শিক্ষা দপ্তর। কেন হঠাৎ এই বোধের উদয়? শিক্ষক সংগঠনের একটি অংশ হিসাব করে দেখিয়েছেন অতিরিক্ত গরমের ছুটি দেওয়ার ফলে পড়ুয়ারা অন্তত ৩২ দিন মিড-ডে মিল থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁদের ও পুষ্টিবিদদের মতে মিড-ডে মিল থেকে বঞ্চিত হওয়া মানে সমাজের এই পিছিয়ে থাকা অংশের পুষ্টির বঞ্চনা। টাকার অঙ্কে এই বঞ্চনার পরিমাণ কত? শিক্ষকরা হিসাব কষে দেখাচ্ছেন, বাড়তি ৩২ দিনের হিসাবে পঞ্চম শ্রেণী পিছু ১৭৪ টাকা চার পয়সা এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ২৬০ টাকা আট পয়সা হিসাবে ধরলে এই বঞ্চনার আর্থিক পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা। শিক্ষক সংগঠনের হিসাবে রাজ্যে যদি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়ার সংখ্যা ৮০ লক্ষ হয় তবে সরকার বেশ কয়েক কোটি টাকা বাঁচিয়েছে। তাঁদের দাবি, স্কুল খুললে এই অর্থে মিড-ডে মিলে অতিরিক্ত বরাদ্দ করা হোক। জানা যাচ্ছে, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেছেন, “গরমের ছুটিতে পড়ুয়াদের মিড-ডে মিলের যে-ঘাটতি হল, সেটা পূরণ করার একটা প্রস্তাব এসেছে। সংশ্লিষ্ট দফতরকে বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে বলেছি।“(বাড়তি ছুটিতে স্কুল-খাবারে ‘বঞ্চনায়’ প্রশ্ন, মন্ত্রীর আশ্বাস, আর্যভট্ট খান, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ জুন ২০২৩)
মিড-ডে মিলে যা অর্থ বরাদ্দ তার ৬০% দেয় কেন্দ্র, রাজ্য দেয় ৪০%। বরাদ্দ বাড়ানোর কথা উঠলেই রাজ্যের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর থেকে শিক্ষা মন্ত্রী সকলেরই আঙুল তোলেন কেন্দ্রের দিকে। কিন্তু, রাজ্যই বা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসবে না কেন। সে নজির যে নেই, তা তো নয়। কর্তাব্যক্তিদের আম্মা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে, তামিলনাড়ু সরকার ক্লাস টেন অবধি মিড-ডে মিল দেয় সেই ১৯৮৩ সাল থেকে। সপ্তাহে পাঁচ দিন ডিম দেওয়া হয়। কেরালাতেও এমন নজির রয়েছে। এই খাতে যে অতিরিক্ত বরাদ্দ তা বহন করে রাজ্য সরকার। এতো গেল একটা দিক। আর শিশুদের জন্য আরও ভাল, পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য যাঁরা লড়ছেন, সেই সহায়িকাদের হালটা কী? কীই-বা তাঁদের কাজের শর্ত, মজুরি কিংবা অধিকার? সে এক জাতীয় লজ্জার কথা।
সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে নির্দেশ দিয়েছে, ১৫ জুন স্কুল খুলবে। মিড-ডে মিলের সব ব্যবস্থা যেন পাকা থাকে। তার মানে, স্কুলগুলি যেন ধুয়েমুছে সাফসুতরো করে রাখা হয়। মিড-ডে মিলের আয়োজনে যেন কোনও ত্রুটি না থাকে। হাঁড়িকুঁড়ি, থালাবাসন যেন পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন থাকে। জ্বালানি জোগাড় করে রাখা হয়। আলু, ডিম, চাল-ডাল যেন মজুত থাকে। কে করবে এত কাজ? অবশ্যই সহায়িকারা। এতো তাঁদেরই কাজ। রান্নাবাড়ার আয়োজন করা, জল তোলা, মশলা বাটা, রান্না করা থেকে খাবার বাড়া, এঁটো বাসন ধোয়ামাজা, তার পর সব গুছিয়ে-টুছিয়ে ছুটি। এবং এত সব কাজের শেষে সহায়িকা দিদিদের মাসিক ভাতা ১৫০০ টাকা। এবং সেটা মেলে বছরে ১০ মাস। দু’মাস স্কুল বন্ধ থাকে, রান্না করতে হয় না, তাই ভাতাও নেই। আবার বহু স্কুলেই ১০-১২ জনের স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী রান্নাবান্নার দায়িত্বে থাকে। সেখানে এই টাকাটাই সমান ভাগে ভাগ করা হয়। তাহলে দৈনিক ভাতা দাঁড়ায় ১০ থেকে ১৫ টাকা। এ যদি ‘বেগারি’ না হয়, তবে ‘বেগারি’ কি? সারা দেশ জুড়ে সাড়ে বাইশ লক্ষ এবং এ রাজ্যের সোয়া দুই লক্ষ সহায়িকাই এই সরকারি ‘বেগারি প্রথা’র শিকার। তামিলনাড়ু, কেরালার পরিস্থিতি অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় ভালো। তামিলনাড়ুতে সহায়িকারা তিনটি স্কেলে যথাক্রমে ৯০০০ টাকা থেকে ১৬,০০০ টাকা বেতন পান। কেরালায় গড় বেতন ১০,০০০ টাকা। তবে সেখানেও আরও উন্নত পরিষেবা এবং মজুরির লড়াই চলছে।
এত সব কথা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, মিড-ডে মিল প্রকল্পটির কোনও মর্যাদাই সরকারের কাছে নেই। সে কেন্দ্রীয় সরকার হোক কিংবা রাজ্য সরকার। নেহাত শিক্ষার অধিকার ও খাদ্যের অধিকার আইন করতে বাধ্য হতে হয়েছিল, তাই যেন সহায়িকাদের হাতে কিছু ভাতা গুঁজে দিয়ে পড়ুয়াদের জন্য ভাত-ডালের একটা ব্যবস্থা করা। এই বঞ্চনা ও বৈষম্য রয়েছে সারা দেশ জুড়েই। সরকারি স্কুল, সরকার পোষিত স্কুল কিংবা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল সাধারণ ভাবে গরিব, নিম্নবিত্ত, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের পড়ুয়াদের ভিড় বেশি। আর শিক্ষা ব্যবস্থাটাই চিরকালই শহুরে এলিট শাসিত। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তারা প্রথম থেকেই এই মিড-ডে মিল, খাবার রান্না করে খাওয়ানোর ঘোর বিরোধী। অর্থনৈতিক, সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের পড়ুয়ারা, দলিত, আদিবাসী সম্প্রদায়ের পড়ুয়াদের নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই উচ্চ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের। সেই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত তথাকথিত নাগরিক সমাজের। আর তা নেই বলেই, গণমাধ্যমেও দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এই অন্ধকার ছবিটির কোনও প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় না।
আর দেখতে পাওয়া যায় না বলেই, শিক্ষা দপ্তর বা শিক্ষামন্ত্রীর হঠাৎ মনে হয়, ৩৭২ কোটি টাকা পড়ে আছে ঠিক আছে দাও পড়ুয়াদের কয়েকদিন মাংস ভাত, ফল খাওয়ানো যাক। কিংবা ৩২ দিন অতিরিক্ত ছুটি দেওয়ায় কয়েক কোটি বেঁচেছে, সেই টাকায় আরও কয়েকদিন ভালো খাবার খাওয়ানো যাক। বিষয়টা যেন শিক্ষা দপ্তরের মর্জি, ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিড-ডে মিল প্রকল্পটি যে দেশের খাদ্যের অধিকারের আইনের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে কোনও দপ্তর, কোনও মন্ত্রীর মর্জির উপর নয়; কিংবা কবে কোন শিক্ষক সমিতি হিসাব কষে ‘প্রস্তাব’ দেবে, এত দিন বাড়তি ছুটির ফলে বা পড়ুয়াদের মিড-ডে মিলে ফাঁকি দিয়ে সরকার এত কোটি টাকা বাঁচিয়েছে— অতএব বাড়তি টাকায় বাড়তি খাবার দেওয়া হোক— এমন কোনও পড়ুয়া-দরদি সদিচ্ছার উপর মিড-ডে মিলে পেটভরা সুষম খাদ্য দেওয়া নির্ভর করে না। এবং পড়ুয়াদের চেয়েও ভোটার দরদি সরকার নির্বাচনের মুখে এমন ‘প্রস্তাব’ মেনে নেবে, অন্য সময় মুখ ফিরিয়ে নেবে এমনটাও চলতে পারে না।
মিড-ডে মিল প্রকল্পের নিজেরই একটি মর্যাদা রয়েছে। এই মর্যাদা রক্ষা করার জন্য যথাযথ আর্থিক, প্রশাসনিক, সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। যদি দেশের অধিকাংশ পড়ুয়ার উপযুক্ত পুষ্টির অভাবে মস্তিষ্কের উপযুক্ত গঠন, দেহের উপযুক্ত বাড়বৃদ্ধি না হয়— তার দায় সারা দেশকেই বইতে হবে। আর যে রাঁধুনি সহায়িকারা খাবার পড়ুয়াদের মুখে তুলে দেওয়ার জন্য প্রাণপাত করেন তাঁদের মর্যাদা দিতে হবে। মর্যাদা অর্থে সরকারি স্বীকৃতি, ন্যূনতম মজুরি, কাজের পরিবেশ, অবসরের পর নিরাপত্তা। এগুলো তো সাধারণ মৌলিক দাবি। এই দাবিদাওয়া নিয়ে বিগত প্রায় দু’বছর বিডিও দপ্তরে দপ্তরে ধর্না দিচ্ছেন সহায়িকারা। আম্মার ছাতার তলায় কলকাতা অভিযান করে মিড-ডে মিল ডিরেক্টরের কাছে দাবিদাওয়া জানিয়ে এসেছেন। তাঁরা আমাদের অনেকেরই চোখ খুলে দিয়েছেন। এবার সমাজের সোচ্চার অংশের দায় সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য এই দাবিদাওয়ার পক্ষে কথা বলা।