বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

স্বাধীনতা, ডিম ও মিড-ডে মিল

স্বাধীনতা, ডিম ও মিড-ডে মিল

শৌভিক দে

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ অগাস্ট, ২০২২— স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি। বাবা সাহেব আম্বেদকর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন পড়ুয়ারা লাইন করেছে। বাদলা হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে ভারতের জাতীয় পতাকা।
সূর্য উঠছে। টকটকে সিঁদুরে লাল সূর্যটাকে দেখে আসিফ তমালকে বললো, “দ্যাখ দ্যাখ সূর্যটা যেন হাঁসের ডিমের কুসুম!” তমাল মুগ্ধ হয়ে সূর্যটাকে দেখলো। ভোরের সূর্য। মাও জে দং এর “আটটা নটার সূর্য” না।
তমাল বললো “সত্যি, কতো দিন ডিম খাই না, বল?”
আসিফ বললো- “কী আর করা যাবে বল। আমার তো ভয় লাগে, মিড-ডে মিলটাই না তুলে দেয়।”
শুধু শিশুদের ডিম খাবার বাসনা বা আগ্রহ নয়। আসিফ তমালদের ডিম খাবার প্রয়োজনটাও জরুরি, খুব জরুরি। কিন্তু তাদের পাতে কি আদৌ জোটে একটা গোটা ডিম? সপ্তাহে অন্তত দু’ বার!
না, জোটে না।
কিন্তু কেন জোটে না? একটা হিসাব দিলেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে। সরকার মিড-ডে মিলের জন্য শিশু পিছু বরাদ্দ করেছে, প্রতিদিন ১০০ গ্রাম চাল, ২০ গ্রাম ডাল, ৫০ গ্রাম সব্জি এবং সপ্তাহে দুটো করে ডিম। তবেই একজন শিশু তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেতে পারে।
এবার দেখা যাক এই পরিমাণ খাবারের বাজারমূল্য কতো? অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রতিষ্ঠিত প্রতীচী ২০১৮ সালে যে সমীক্ষা চালিয়েছিল তাতে দেখা যাচ্ছে সেই সময়েই ২০ গ্রাম ডালের দাম ছিল ২ টাকা, ৫০ গ্রাম সব্জির দাম ছিল ১.৫০ টাকা, ৫ গ্রাম তেলের দাম ৫০ পয়সা, নুন এবং মশলার দাম ৪০ পয়সা, জ্বালানী ১.১০ টাকা। এছাড়া সরকারের মত অনুসারেই সপ্তাহে দু’ বার শিশুদের ডিম দেবার কথা। সে সময়ে ডিমের দাম ৫ টাকা হলেও ভর্তুকি সমেত ১.৬৭ টাকায় তা পাওয়া যেত। অর্থাৎ। ডিম বাদ দিয়ে মোট খরচ শিশু পিছু ২.০০ + ১.৫০ + ০.৫০ + ০.৪০ + ১.১০ = ৫.৫০ টাকা। ডিম সহ ৭.১৭ টাকা।
অথচ সরকারের অনুমোদিত বাজেট ৪.১৩ টাকা। শিশু প্রতি ঘাটতি ৩.০৪ টাকা।
বলাবাহুল্য বর্তমানে এই প্রতিটি খাদ্যদ্রব্য, জ্বালানি এই সব কিছুর দাম বেড়েছে। উপরন্তু শিশুদের মিড-ডে মিলে সয়াবিন যোগ করা হয়েছে। মাসে একটা করে সাবানও দেওয়ার কথা।
কিন্তু অর্থের সংস্থান? না বাড়েনি। সুতরাং প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো হোক বা অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রে শিশুদের মিড-ডে-মিলের জোগান করতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে। কখনো শিশুদের খাদ্যতালিকা থেকে ডিম বাদ পড়ছে। কখনো কোনওরকমে ভাত তার জলের মতো ডাল খাইয়েই তাদের পেট ভরানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। কোথাও কোথাও শিক্ষকরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য ব্যায় করছেন। কোথাও বা উপস্থিতির হার বাড়িয়ে দেখিয়ে কোনওরকমে সামাল দিচ্ছেনশিক্ষকরা।
সাম্প্রতিক দুটো ঘটনায় যাবার আগে মিড ডে মিলের ইতিহাসের দিকে একবার চোখ রাখা যাক। এ দেশে প্রথম মিড ডে মিল চালু হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। মাদ্রাজে তৎকালীন কামরাজ নাদার সরকার কর্পোরেশন স্কুলগুলোতে মিড-ডে মিল চালু করে। পাঁচের দশকেই তামিলনাড়ুর পদ্মনাভন প্যালেসে বিরাট বড় হলে প্রতিদিন দু’ হাজারের বেশি শিশুকে খাওয়ানো হতো। ১৯৮০ সালে ডিএমকে’র এম জি রামচন্দ্রন মিড-ডে মিল চালু করেন পুরো তামিলনাড়ু জুড়ে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি উদ্যোগে বা বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় মিড-ডে মিল চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যেমন, নয়ের দশকের বীরভূমের ও বাঁকুড়ার একটি করে গ্রামে শিশুদের প্রথমে সপ্তাহে একদিন, পরে তিনদিন করে ডিম প্রকল্প চালু করা হয়েছিল ড. সিদ্ধার্থ মুখার্জীর উদ্যোগে। সরকারি ভাবে এই মিড-ডে মিল চালুর দাবিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থা উদ্যোগী হয়েছিলেন।
২০০১ সালের পিইউসিএল মামলায় রিট পিটিশনের মামলায় ২৮ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট রায়ে সমস্ত রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়, পড়ুয়াদের রান্না করা খাবার দিতে হবে।
এ রাজ্যে ১১০০ স্কুলে মিড-ডে মিল চালু হয় ২০০৩ সালে। তারপর ধাপে ধাপে শহর থেকে গ্রামের স্কুলগুলোতে মিড-ডে মিল চালু হয় ২০০৫-০৬ সালের মধ্যে।
কিন্তু বরাদ্দ নিয়ে অভাব অভিযোগ প্রায় প্রথম থেকেই ছিল। ছিল বাজারদরের সঙ্গে বরাদ্দের পার্থক্য।
এর মধ্যে অতিমারি চলাকালীন বিদ্যালয়গুলি বন্ধ থাকায় রান্না করা খাবারের পরিবর্তে শিশুদের চাল ডাল দেওয়া হতো।
বর্তমানে অতিমারি কেটে গেলেও স্কুলগুলোয় রাজ্য সরকার দীর্ঘ গরমের ছুটি ঘোষণা করায় রান্না করা খাবারের পরিবর্তে চাল, ডাল, আলু, সয়াবিন এবং একটা করে সাবান দেওয়া হতো।
বর্তমানে ফের স্কুলগুলো খুলেছে ঠিকই কিন্তু মিড-ডে মিলের চিত্রটা খুবই করুণ।
খোদ কোলকাতায় একটি স্কুলে নবম শ্রেণীর পড়ুয়ারা খিদের জ্বালায় অষ্টম শ্রেণীর পড়ুয়া সেজে মিড-ডে মিল খেতে গিয়ে ধরা পড়লে এগিয়ে আসেন দুই শিক্ষিকা। তাঁরা বলেন নবম দশম শ্রেণীর পড়ুয়াদের মিড ডে মিল খাওয়াতে যে অতিরিক্ত ব্যয় হবে, সেটা তাঁরাই বহন করবেন। আবার কলকাতার এক বিখ্যাত এনজিও যাঁরা শিশুশিক্ষা নিয়ে যৌথভাবে সরকারের সর্বশিক্ষা মিশনে কাজ করছেন তাঁদের এক কর্মী একটি বিদ্যালয়ে ট্রেনিং প্রোগ্রামে গিয়ে দেখতে পান অত্যন্ত কম শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকলেও তাদের দেওয়া হচ্ছে পাতলা জলের মতো ডাল আর ভাত। ডিম, সয়াবিন বা সব্জির কোনও বালাই নেই। ওই কর্মী এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষিকাকে প্রশ্ন করতে গেলে, তাঁকে এনজিও সংস্থার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের রোষের মুখে পড়তে হয়।
এই উদাহরণ মোটেই বিচ্ছিন্ন নয়। ২০২২ সালে বিশ্বের ক্ষুধা সূচকে একশো ষোলোটি দেশের মধ্যে ভারতবর্ষ কেন ১০১ নম্বরে, তা বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হয় না।
স্বাধীনতা ৭৫-এ, যখন খাদি ও গ্রামোদ্যোগ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যত ধ্বংস করার অভিপ্রায় নিয়ে আদানিদের কোটি কোটি জাতীয় পতাকা বানানোর বরাত দিচ্ছে মোদি সরকার তখন প্রাথমিক বিদ্যালয় বা অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রগুলির খুদে শিক্ষার্থীদের বরাতে ডিম জোটে না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.