বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

ভয় হতে তব অভয় মাঝে
নূতন জনম দাও হে

ভয় হতে তব অভয় মাঝে
নূতন জনম দাও হে

বসন্ত মুখোপাধ্যায়

photo

আরজি করে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় মানুষের প্রতিবাদ যেন থামতে চাইছে না। এই প্রতিবাদ কলকাতা ছাড়িয়ে জেলায়, শহর ছাড়িয়ে মফস্বল ও গ্রামে, রাজ্য ছাড়িয়ে গোটা দেশে এবং দেশ গন্ডী গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এই নির্মম ঘটনা ও তার প্রতিবাদের অভিঘাত এতটাই যে এমন কী ল্যানসেটের মতো বিশ্ববিখ্যাত মেডিক্যাল জার্নালও এতে সামিল হয়েছে। গোটা রাজ্যে ও দেশে বীরের মতো প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন চিকিৎসক সমাজ। নিত্য নতুন নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে তাঁরা তাঁদের প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই প্রতিবাদ আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল স্বতঃস্ফূর্ততা। একেবারে সেই ১৪ অগাস্ট প্রথম বারের রাত দখলের কর্মসূচি থেকেই সমাজের নানা স্তরের প্রতিবাদী মানুষের ঢল নেমেছে এই আন্দোলেন। সব বয়সের, সমাজের সব অংশের মহিলারা নিজেরদের তাগিদে নেমে এসেছেন রাস্তায় এবং এই মৃত্যুর কিনারা ও ন্যায়বিচার দাবি করেছেন। এই প্রতিবাদে এমন সব মহিলাদের দেখা যাচ্ছে, আগে কখনও ভাবা যায়নি যে তাঁরা এভাবে প্রতিবাদে সামিল হয়ে রাজপথে নেমে আসবেন।

এই প্রতিবাদ আন্দোলনের মূল ধারা দুটি — রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক। রাজনৈতিক স্তরে বিজেপি সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে মমতা সরকার বিরোধী এই আন্দোলনের ফসল নিজেদের ঝুলিতে জমা করতে। তবে ছাত্রসমাজ এর নামে নবান্ন দখল অভিযানের দিনই স্পষ্ট হয়ে গেছে বিজেপি এরাজ্যের বৃহত্তর নাগরিক সমাজকে এখনও স্পর্শ করতে পারেনি। তাদের লাশের রাজনীতির চেহারা মানুষ আগেই ধরে ফেলেছেন এবং সতর্ক রয়েছেন। নাগরিক সমাজের এই রাজনৈতিক সচেতনতা আন্দোলনের খুবই মূল্যবান সম্পদ।

এছাড়া রাজনৈতিক আন্দোলনে রয়েছে বামেরা। বামেদের মধ্যে মূল শক্তি বামফ্রন্ট। অনেক দিন বাদে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে বামদের গণসংগঠনগুলিকে হাত পা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে। একটা উজ্জীবিত মনোভাব ক্রমশ শহর থেকে গ্রামে ও জেলায় সঞ্চারিত হচ্ছে। রয়েছে লিবারেশনের নেতৃত্বে বামেদের একটা ধারা। আছে এসইউসিআইয়ের নেতৃত্বে আরও একটা বাম ধারা। লিবারেশন ও এসইউসিআইকে কেন্দ্র করেও একটা নতুন জাগরণের ছবি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এছাড়াও আছে বহু ছোট ছোট বাম সংগঠন। চরিত্রগত ভাবে বাম হলেও এই সব ধারা এখনও এক জায়গায় এসে মিলতে পারেনি। এদের বোঝাপড়া সম্ভব হলে নিঃসন্দেহে পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনীতিতে নতুন জোয়ার উঠবে। আশা করা যায়, ভবিষ্যৎ এই লক্ষ্যেই এগোবে।

অন্যদিকে, আরজি কর আন্দোলনকে ঘিরে একটা জোরালো অরাজনৈতিক স্রোত রয়েছে। সব দেশেই, সোভিয়েতের পতনের পর, মার্কসবাদের মতাদর্শগত নেতৃত্ব নিয়ে নানা ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। সেই সংশয়ের ভেতর থেকে জন্ম নিয়েছে একটা অরাজনৈতিক ধারা, যেটি প্রতিবাদ করতে পিছপা হয় না, কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের ছাতার তলায় যেতে অস্বীকার করে। এদের অনেকেরই আবার পরিচিতি সত্ত্বাভিত্তিক অস্তিত্ব রয়েছে। তাঁরা প্রতিবাদকে সেই গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চান। অরাজনৈতিক প্রতিবাদের এই ধারাকে রাজনৈতিক ধারার কাছে টেনে আনার লড়াই কষ্টকর হলেও তা চালিয়ে যেতে হবে।

অন্যদিকে, আরেক দল অরাজনৈতিক আন্দোলনের কথা বলছেন যাদের আসল লক্ষ্য পুরোপুরি প্রতিক্রিয়াশীল। এরা জানেন, যদি রাজনৈতিক খাতে এই আন্দোলনের মূল স্রোত বেড়ে উঠতে থাকে, তবে তাতে আখেরে লাভ হবে এরাজ্যের বামপন্থার। এরাজ্যের দীর্ঘ বাম আন্দোলনের ঐতিহ্য, যা এখন দক্ষিণপন্থার চাপে সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তার উৎসমুখ খুলে গেলে তা নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলবে। ফলে বিজেপির ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন ক্রমশ ফিকে হতে শুরু করবে। অতএব অস্থিমজ্জায় যারা নিজেদের শ্রেণীর স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন এবং বামদের পুনরুত্থান নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত, তারা কিছুতেই এই আন্দোলনকে রাজনীতিমুখী হতে না দিয়ে অরাজনৈতিক করে রাখতে চাইবেন। অরাজনীতি মানে আসলে যে কোনও উপায় আন্দোলনকে বামমুখী হতে না দেওয়া। তাকে দক্ষিণপন্থার দিকে ক্রমাগত ঠেলে দেওয়া। কারণ অরাজনীতি মানে নির্দিষ্ট দিশাহীনতা, স্বতঃস্ফূর্ততার ওপর একপেশে জোর এবং যা ক্রমশ আন্দোলনকে চোরাবালিতে ডুবিয়ে মারে। সেই হিসাবে দেখলে, মতাদর্শের ক্ষেত্রে এরা সংগঠিত বামেদের প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। তবে প্রথম ধরনের অরাজনৈতিক পথের পথিকদের সঙ্গে নানা স্তরীয় ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকছে।

আরও একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এই আন্দোলনে নাগরিক সাড়া। মনে রাখতে হবে, এটা একটা প্রতিবাদ আন্দোলন যার ওপর ফোঁস করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। পরদিনই দুর্গাপুরে তৃণমূলের বাহিনী বামেদের ওপর হামলা চালায়। তবে পাল্টা প্রতিবাদে তাদের পিছিয়ে আসতে হয়। এই বাহিনীই উইংসের ধারে অপেক্ষা করছে সময়মতো রাস্তা পুনর্দখল করার জন্য। তবে সেই সুযোগ তাদের দেওয়া চলবে না। এসব ভীতি অগ্রাহ্য করে, ভয় ভেঙে ফেলে সাধারণ নাগরিকেরা রাস্তায় নামছেন। এবং সেব্যাপারে তাদের কোনও ক্লান্তি দেখা যাচ্ছে না।

জওহরলাল নেহরু তাঁর ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ বইয়ে ভারতের রাজনীতিতে গান্ধীজির আবির্ভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে এমনই একটা মুহুর্তের কথা লিখেছেন। তিনি লিখছেন, “The greatest gift for an individual or a nation, so we had been told in our ancient books, was abhaya (fearlessness), not merely bodily courage but the absence of fear from the mind. But the dominant impulse in India under British rule was that of fear— pervasive, oppressing, strangling fear; ... So, suddenly, as it were, that black pall of fear was lifted from the people’s shoulders, not wholly of course, but to an amazing degree. As fear is close companion to falsehood, so truth follows fearlessness.” (“আমাদের প্রাচীন পুঁথিগুলিতে যেমন বলা হয়েছে, একটি ব্যক্তি বা একটি জাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার হল অভয় (ভয়শূণ্যতা), নিছক শারীরিক সাহস নয়, মন থেকে ভয়ের অনুপস্থিতি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতে প্রাধান্যকারী অনুভূতি ছিল ভয়— ব্যাপক, নিপীড়নকারী, শ্বাসরোধকারী ভয়; ... হঠাৎ, ভয়ের সেই কালো পর্দা জনগণের কাঁধ থেকে উঠে গিয়েছিল, অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে নয়, কিন্তু একটি আশ্চর্যজনক মাত্রায়। ভয় যেমন মিথ্যার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী, তেমনি সত্য ভয়শূণ্যতাকে অনুসরণ করে।”— ভাষান্তর সম্পাদকের)

তৃণমূল কংগ্রেসের রাজত্বে এই বাংলার ঘাড়ে চেপে বসেছে এক সর্বগ্রাসী ভয়। পুলিশের ভয়, সিভিক ভলান্টিয়ারের ভয়, প্রশাসনের শীর্ষে থাকা দুর্নীতিগ্রস্তদের ভয়, তৃণমূলের ক্যাডার বাহিনীর ভয়, সমাজের সর্ববিধ কাজে তোলাবাজদের ভয়, তৃণমূল পুষ্ট সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের ভয়। এই ভয়ের পর্দাই মানুষকে দাবিয়ে রেখেছিল। আরজি করের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও মৃত্যুর প্রতিবাদে নেমে সেই ভয়টাই ভেঙেছে মানুষের। মানুষ নিজের হাতে সেই ভয়ের পর্দাকে সরিয়ে ফেলেছেন। পুরোটা সরিয়ে ফেলেছেন বলা যাবে না। তবে ভয় ভাঙছে। তাই মৃত্যুর এক মাস পরেও থামছে না প্রতিবাদ। এমনকী স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও সামিল হচ্ছে প্রতিবাদে। এ এক অসামান্য জাগরণ। এই নির্ভীক মনোভাবকে আরও ছড়িয়ে দিতে হবে। আরও মানুষকে প্রতিবাদে সামিল করতে হবে।

বাংলার এই প্রতিবাদে উজ্জীবিত হয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে মহারাষ্ট্রের বদলাপুর। নাগরিক মতামত সোচ্চার হচ্ছে যোগী রাজত্বে ধর্ষণের বিরুদ্ধে, বুলডোজারের বিরুদ্ধে। গোধরার ধর্ষকদের ফুলের মালা দিয়ে জেলের বাইরে বরণ করার বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ। এই কয়েক মাস আগেই উত্তরপ্রদেশে ওবিসি, দলিত আর আদিবাসী জনতা ভয়ের পর্দা সরিয়ে বিরোধী পক্ষকে ভোট দিয়েছিলেন বলেই উত্তরপ্রদেশে শক্তি হারিয়েছে বিজেপি ও আরএসএস। এমনকী খোদ অযোধ্যায় হেরেছেন বিজেপি প্রার্থী। একদিকে বিজেপির ভয়ের শাসনের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে তৃণমূলের ভয়ের শাসনের বিরুদ্ধে ক্রমশ সোচ্চার হচ্ছে জনমত। সোচ্চার হচ্ছেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। সাহসের এই দৃপ্ত মশালকে জ্বালিয়ে রাখতে হবে।

এক ধাক্কায় কাঙ্খিত ফল নাও হতে পারে। একবার ঢেউ উঠে থিতিয়ে যেতে পারে। পরের বার ঢেউ আরও বড় আকারে হাজির হতে পারে। ক্রমাগত ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে ধাপে ধাপে ঢেউ তার শক্তিকে বাড়িয়ে চলে। গণপ্রতিবাদের ঢেউয়ের ধর্ম সেই একই। একবার যখন সে ভয়ের শিকল ভেঙেছে, আর তার শৃঙ্খলিত হওয়ার ভয় নেই। অভয়া ও নির্ভয়াকে সামনে রেখে সেই নির্ভীক, নিঃসংশয়ের প্রদীপ জ্বেলে যেতে হবে এই রাজ্যের, এই দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে। অভয়া ও নির্ভয়ারা আমাদের নতুন জন্ম দিক, এই শুধু আজকের প্রার্থনা।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.