বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
তখন রাত সাড়ে ন’টা, ছুটেছি গলি থেকে রাজপথে। কয়েক ঘণ্টা পরেই স্বাধীনতা দিবস। ৯ আগষ্ট আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একমাত্র সন্তানকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। সে ছিল ওই হাসপাতালের ছাত্রী চিকিৎসক, টানা ৩৬ ঘণ্টা ডিউটির পর একটু ঘুমিয়েছিল। নিদ্রাচ্ছন্ন মেয়েটির ওপর এই দুর্বল মুহুর্তে ঘটেছে পাশবিক অত্যাচার। পরের দিন ওই অভিশপ্ত জায়গায় বাধাহীনভাবেই সকলেই ঢুকে পড়েছে, কেবল ঢুকতে দেওয়া হয়নি নিহত মেয়েটির বাবা মাকে। এই ঘটনা আমাদের মত সাধারণ মানুষকে নাড়া দিয়েছে। সাধারণ মানুষগুলো অনেক দিন লুকিয়েছিল, হারিয়ে গিয়েছিল। এতদিন দেখেছি পথে ভিড় দেখে বেশিরভাগ পথচারীরা একরাশ বিরক্তি নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ভিড় এড়িয়ে চলে গেছেন অন্য পথ ধরে। কোনও পথে মিছিল আসছে শুনে পথচারীরা বিকল্প পথ ধরেছেন তাঁদের লক্ষ্য পৌঁছানোর জন্য। আর মানুষের এই মুখ ঘোরানো, এড়িয়ে চলা, লুকিয়ে পড়ার মধ্যেই মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে সব রকম দুর্নীতি, বঞ্চনা, অর্জিত অধিকার হরণ, ধর্ষণ-খুন সবকিছু।
জানি না, এই গভীর রাতে হাজার হাজার আমির এই সমাবেশ, শ্লোগান মুখর প্রতিবাদী মিছিলে কোনও লাভ হবে কিনা! জানি না দোষীদের কঠিন শাস্তি হবে কিনা! কিন্তু এই পথে এসে, হাতে হাত ধরে বুঝেছি আমি, ওরা, আমরা কেউ একা নই। দেখলাম, আজ জনবিস্ফোরণের মধ্যে সকলেই দাঁড়িয়ে, কেউ আর লুকিয়ে নেই। যে মেয়েটা পথচলার সময়ে কুৎসিত মন্তব্য শুনেও মাথা হেট করে যন্ত্রণা বুকে চেপে, নিজের দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে চলে যেত, আজকের রাতে সেও এসেছে এই সমাবেশে। সারাদিন অফিসে যে মেয়েটি একটি কথাও বলতো না, সেও এসেছে কারুর সঙ্গে, সেও আজ ধীরে ধীরে পা মেলাচ্ছে সকলের সঙ্গে। যে যুবক সারাদিন আড্ডার ঠেকে সময় কাটায় সেও জীবনের অর্থ খুঁজতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে গভীর রাতে। এত পেশা, বন্ধু, প্রতিবেশি, জানাই ছিল না, আমরা এতজন একই মানসিকতার লোক এত কাছে থেকেও হারিয়েছিলাম। আজ প্রশান্তিতে হাজার হাজার হাতে হাত রেখে শক্ত মুঠি আকাশের দিকে তুললাম — আমরা এক হলাম।
চিকিৎসক সংগঠন, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং গণসগংঠন, রাজনৈতিক দল সহ অনেকেই ধারাবাহিকভাবে এই প্রতিবাদ আন্দোলনে সামিল হল — আরজিকরের ঘটনায় ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করার জন্য খুব জরুরি, আমরা রাজপথে এসে সকলেই ওই আন্দোলনের অংশ হয়ে গেলাম। সুপ্রীম কোর্টের তত্ত্বাবধানে সিবিআই তদন্ত দ্রুত অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনমাফিক তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সুনিশ্চিত করুক, এটাই সাধারণ মানুষের দাবি। এই দাবির ব্যাপকতা এবং মেঘাচ্ছন্ন আকাশের বিদ্যুতের ঝিলিকের পরেও দেখা গেল, অন্ধকারের জীবগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই গভীর রাতেই আরজিকর হাসপাতাল ভাঙ্গচুর চালালো, পুলিশ নির্বিকার রইল। ঘটনা প্রমাণ করলো, এই হত্যার নেপথ্যে থাকা গভীর দুর্নীতি চক্র এই নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদ আন্দোলন বন্ধ করতে চায়।
রাজ্য সরকারের প্রশাসনের উচ্চ স্তরে এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্য ইত্যাদি বিভাগে যে অরাজকতা দীর্ঘদিন ধরে চলছে, তার থেকেই আরজিকর হাসপাতালে ঘটে যাওয়া মারাত্মক এই অপরাধের জন্ম। তার অবসানের জন্য প্রয়োজন সরকারি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার।
অথচ আমরা দেখছি মুখ্যমন্ত্রী উচ্চ কন্ঠে এরপরেও আগের সরকারের আমলে ঘটা ধর্ষণের তালিকা পেশ করছেন এবং বিচারের নামে হাস্যকর কথাবার্তা বলছেন। প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের মুখ্য মানুষটি যদি এই মানসিকতার হন তাহলে ধর্ষকদের অপরাধী মন আরও উৎসাহিত হবে। তাঁর এই ভাষণ ধাক্কা দিচ্ছে, মহিলাদের মর্যাদা এবং সমানাধিকারের লড়াইকে। রাতের বেলা কর্মরত মেয়েদের ডিউটি না দেওয়ার সাম্প্রতিক সরকারি ফরমানও তাঁরই নির্দেশে ঘোষিত। যা রাজ্যে সরকারের পশ্চাদপদ মানসিকতাকে আবারও উন্মোচিত করেছে। দিনে হোক কিংবা রাতে মেয়েদের যৌন হিংসা থেকে রক্ষা করাটা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। আরজিকর ঘটনার পর রাজ্যে যৌন হিংসা বিরোধী যে গণআন্দোলন গড়ে উঠেছে তা তৃণমূল সরকারের এই নারী-বিরোধী মানসিকতার অবসান ঘটাবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।
নারীর নিরাপত্তা, চিকিৎসকদের সুরক্ষা ও ন্যায়ের দাবিতে এই গণআন্দোলনের ইস্যু নিয়ে ব্যাপক জনমত গঠনকে বন্ধ করার সব রকম প্রক্রিয়া চলছে। যে বিজেপি হাথরাসের নৃশংস খুন ধর্ষণের খবর করতে যাওয়ার অপরাধে সিদ্দিক কাপ্পানকে দু’ বছর জেলবন্দী করে অত্যাচার করেছিল তারাও! যারা গোধরার ধর্ষকদের মালা পরিয়ে বরণ করে তারাও নবান্ন অভিযান, বনধ করে ক্ষমতার সন্ধানে তারা আন্দোলনকে ঘেঁটে দিতে সচেষ্ট।
এমনিতেই এই হত্যার রহস্য সন্দেহ বাড়িয়েছে রাজ্য সরকার প্রতি এবং সন্দেহ বাড়াচ্ছে রাজ্যের পুলিশের ওপরেও। তার মধ্যে বিজেপি সচেষ্ট হয়েছে আন্দোলনটিকেই তাদের দলীয় কব্জায় নিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার সিঁড়ির ধাপ হিসেবে ব্যবহার করতে। এই বিপদ থেকে ন্যায়বিচার আন্দোলনকে বাঁচাতে হবে। রাজ্য ও কেন্দ্রের দুই শাসক দলের মধ্যে চালু বাইনারির বাইরের পরিসরে গড়ে ওঠা আমজনতা প্রথম দাবি করেছিল, “উই ওয়ান্ট জাস্টিস”। আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হয়েছে মানুষের দাবি এবং শ্লোগানও বেড়েছে।
আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে প্রায়ই শুনতাম, বামপন্থীরা ভীষণ রকম পার্টিজান। যদিও ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখেছি কথাটা সত্য নয়। আজকেও তার প্রমাণ, সমস্ত বাম দলগুলো এই জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের অগ্রগতির অভিমুখ ঠিক রেখেই তারা শাসকের বিরুদ্ধে অদলীয় সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক অতীতে দিল্লীর কৃষক আন্দোলনে পাঁচশোর বেশি কৃষক সংগঠনের সঙ্গে যুক্তভাবে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল সেখানেও তারা যোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।
অথচ এবারে বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গাঙ্গুলীর মত কারুকে পাঠিয়ে “গো ব্যাক” শ্লোগানের মুখোমুখি হচ্ছেন, কিংবা যখন সারারাত অনড় অবস্থান করে লড়াকু ডাক্তারা নিজেদের শর্তে পুলিশকে ডেপুটেশন দিচ্ছে, তখন রাজ্য শাসক দলের মুখপাত্র নিজেকে ওই ডেপুটেশনের কারিগর বলে মিথ্যাচার করে ধরা পড়ে অপদস্থ হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বামপন্থীরা দ্বিমুখী সংগ্রাম করছে: (এক) জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী রাখার জন্যে ঝান্ডা ছাড়া এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, (দুই) আবার নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়েই ওই ডাক্তারদের সংগ্রামের দাবিগুলি জনগণের কাছে তুলে ধরছে।
এই পথেই ১৪ আগস্ট মেয়েদের রাত দখলের অভিযানকে অনেকগুলো ক্ষেত্রে তারা নিজেদের শক্তিকে সংগঠিত করে পথে নেমেছিল, যেখানে জনগণ সুনামির মত এগিয়ে এসেছিলেন। আন্দোলনের এই উত্তাপ বুঝেই তারা উদ্যোগ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় দূরবর্তী ভাই বোনেদের নিয়ে এই ঘটনার ওপর নাটক, গান ও আবৃত্তি পরিবেশনের মধ্যে দিয়ে জনমতকে শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক সংগ্রামে যুক্ত করেছে। সংযোজিত হয়েছে “গণ-আদালত”, “রাজপথেই তিলোত্তমার ক্যানভাস” এর মতো অজস্র কর্মসূচি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হল, জনগণ আগ্রহ নিয়ে শাসকের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছেন। এই সমস্ত কর্মসূচিতে জনগণকে জমায়েতের উদ্যোগ নিতে হচ্ছে না। বরং তারাই যোগ দিচ্ছেন এই কর্মসূচিগুলোতে।
আজকের এই শ্লোগানের মুখোরতা বলছে “রাজা তোর কাপড় কোথায়!”
এই মুহুর্তে বামেদের জরুরি কর্তব্য রাজ্যবাসীদের স্বার্থে শুধুই শ্লোগানের সীমাবদ্ধ কর্মসূচি পালন নয়। কারণ জনগণের নজরদারিতে তিলোত্তমার ন্যায়বিচারের তদন্ত চালাতে ভূমিকা নিতে হবে বামপন্থীদের।
আজকের এই জঘন্য রাজনৈতিক পাশা খেলা বন্ধ করতে, সাধারণ মানুষের দাবি মতো আরজিকর কাণ্ডের ন্যায্য বিচারের দাবিতে, অনড় অবস্থান আন্দোলন। কোনও গতানুগতিক একদিনের দিনের “অভিযান”এর কর্মসূচি, ডেপুটেশন নয়। জনতার এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে হবে আরও আরও মানুষের কাছে — শহরের শ্রমজীবীদের কাছে, গ্রামের ক্ষেতমজুর, প্রান্তিক কৃষক, দরিদ্র মানুষের কাছে।
বামপন্থীদের এই আন্দোলনে জনমনে আশার সঞ্চার করতে সব রকম সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠা জরুরি। এ সময় কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত নয়। এখন অনেককে টেনে আনার দায়িত্ব বামেদের। কাউকে তাড়িয়ে দেওয়ার আধিপত্যের সময় নয় এটা — কারণ এ জাগরণ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। রাস্তা কারও বাবার নয় বলে বামেরা ঘোষণা করেছিল। তাই এ পথে আজ সবার অধিকার। পক্ষ এখন মাত্র দুটো — তুমি প্রতিবাদের রাতে আছো? নাকি এখনও ‘অনুপ্রাণিত’ লাভলি মৈত্র, উদয়ন গুহ তুমি?
আর কোনও ফারাক নেই। এ সময় জোড়ার সময়। এ সময় তাড়া করে মিছিল থেকে ছিটকে দেওয়ার নয়।
এ সময় কাউকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার নয়। এ সময় মানুষকে কাছে টানার। তিলোত্তমা বলছে... “মা আমায় চিনতে পারছো?/ আমি উন্নাও এ জন্মে/ কাশ্মীরের আসিফা হয়ে গেছি/ দিল্লীর বাসে উঠে, ভীতু আমি/ নির্ভয়া হয়ে গেছি/ মণিপুরের রাস্তায় উলঙ্গ হেঁটে/ মর্মে মরে গেছি/ আরজিকরে ছিন্ন হয়ে/ তুমি আর আমি অভিন্ন হয়ে গেছি।”
এই জন্যেই যতক্ষণ না দোষী ধরা পড়ছে, যতক্ষণ না দাবি পূরণ হচ্ছে, ততক্ষণ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। মানুষ ও সময়ের দাবি এখন এটাই।