বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
গত ক’দিনের নানা ঘটনায় আমরা সবাই কমবেশি পর্যুদস্ত। প্রথমে এক জঘন্য হত্যা এবং ধর্ষণ এবং তার পরে কখনও প্রশাসনিক উদ্যোগে ঘটনাটার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে এমন লোকেদের তড়িঘড়ি আড়াল করার চেষ্টা, কখনও বা হত্যার প্রমাণ লোপ হয়ে যেতে পারে এমন কিছু কাজকর্ম হুটপাট করে শুরু করে দেওয়া, কখনও একদল দুষ্কৃতীর হাসপাতালে ঢুকে ভাঙচুর করে আরো অনেক কিছু নষ্ট করে ফেলা... সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত ও সন্দেহজনক কান্ড চলছে। যা সরকারের নেতিবাচক ভূমিকা এবং দোষীদের আড়াল করার লজ্জাজনক প্রচেষ্টাকে প্রকট করে তুলেছে। আপাতত হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত শুরু হয়েছে। সুপ্রীম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত মামলা শুরু করেছে।
আর জি করের এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে রাজ্য তথা দেশ জুড়ে এক শক্তিশালী প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়েছে। কেবল আমরা নারীরা নই, সমস্ত স্তরের জনগণ এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সামিল হয়েছেন। দেশ জুড়ে জুনিয়র ডাক্তার ও চিকিৎসকরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে এই লড়াইতে আছেন। ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে রাজ্যের অসংখ্য জায়গায় অসংখ্য মেয়ে এবং তার পাশাপাশি বহুল সংখ্যক পুরুষও মিছিল করে, স্লোগান দিয়ে জমায়েত হয়েছিলেন। সবারই এই ভাবনাটাই ছিল যে ‘এটা আমার সামাজিক কর্তব্য’। তারপর রোজ দিনই নানা জায়গায় নানা জমায়েত এবং মিছিল হচ্ছে। প্রত্যেকেই এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত এবং প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতার ও কঠোর শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। রাজ্য তথা সারা দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীসুরক্ষার বিষয়টিও জোরালোভাবে উঠে এসেছে।
এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, বিভিন্ন নারী সংগঠন ও গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলির সক্রিয় ভূমিকা অভিনন্দন যোগ্য। কিন্তু একই সঙ্গে এই আন্দোলনে উঠে এসেছে এমন স্বর যা নারী সুরক্ষার প্রশ্নটিকে মূলত নারীর বিষয় বলে মনে করে। পুরুষতন্ত্রেও যে বহু নারী বসে আছেন সেকথাটা তারা ভুলে যান। অভয়ার মৃত্যু শুধু পুরুষতন্ত্রের আক্রমণে হয়নি, এই জনবিরোধী দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাও তার জন্য সমান দায়ী। শুধুমাত্র নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতা আর অধিকার পুরুষতন্ত্রকে বদলে ফেলতে পারে না। বর্তমানে এ রাজ্যের শীর্ষস্থানে তো একজন নারীই আছেন। নারীমাত্রই নারীর বন্ধু নন আবার পুরুষমাত্রই নারীর শত্রু নন। পুঁজিপতি নারী আর শ্রমজীবী পুরুষের মধ্যে শ্রমজীবী নারীরকে কাছের জন তা বোঝার জন্য পিএইচডি থিসিস করতে লাগে না। নারী কোনও অখন্ড সামাজিক ধারণা নয়। তাই এই আন্দোলনকে যারা নারী ও লিঙ্গভিত্তিক পরিচয় ও অধিকারের আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে চাইছেন তারা অভয়ার মৃত্যুর কারণ হিসাবে দায়ী জনবিরোধী দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থাকে আড়াল করছেন, জনগণের ঐক্যে ফাটল ধরাচ্ছেন ও সর্বোপরি সাধারণ ও শ্রমজীবী নারীদের ক্ষতি করছেন।
আবার এই নারী সুরক্ষা শক্তিশালী করার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন সরকার যে সব প্রস্তাব রাখছেন তা সর্বতোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। নারী সুরক্ষা যে কারণে বিঘ্নিত হয় সেই কারণ দূর করার চেষ্টা না করেই তারা নারীকে রাতের ডিউটি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলছেন। যার মানে রাতের রাস্তা হায়না অধ্যুষিত থাকবেই এবং নারী রাতে রাস্তায় বেরোবে কেন? এই ভাবনাকেই প্রকারান্তরে মান্যতা দেওয়া হল সরকারি তরফেই। আর নারীসুরক্ষা কি শুধু রাতেই বিঘ্নিত হয়? এই রাতের ডিউটি থেকে নারীকে অব্যাহতি দিলে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে অসংখ্য নারী কাজ হারাবেন সেই ব্যাপারেও তো আমাদের সজাগ থাকতে হবে। তাই আমরা এই বিষয়টির তীব্র প্রতিবাদ জানাই ও কর্মক্ষেত্রে নারীর সুরক্ষা সংক্রান্ত বিশেষ প্রশ্নটির একটি সংবেদনশীল কার্যকর সমাধান চাই।অভয়ার মৃত্যু রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা, দুর্নীতি আর অবহেলিত নারী সুরক্ষার বিষয়টির বেহাল চেহারা মেলে ধরেছে। যে সমাজ ব্যবস্থা এ সমস্যাগুলোকে টিকিয়ে রেখেছে আসুন সবাই মিলে সেই ব্যবস্থাকে বদলাই।
২৩/০৮/২০২৪
অপরাজিতা মুখার্জি, কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়, পিয়াসা দাশগুপ্ত, শীলা চক্রবর্তী, পূর্বা রায়, পূবালী রাণা, রাই চট্টোপাধ্যায়, পূরবী ঘোষ, ঊর্মিমালা, ঝুমা লোহার, ঊষা লোহার, অঙ্কিতা মল্লিক, পিংকু লোহার, কল্পনা লোহার, কাজল রায়, পুতুল রায়, মঙ্গলা লোহার, সাথী বাউরি, অনিতা মল্লিক, সুমিত্রা সর্দার, পলি সেনগুপ্ত, গায়ত্রী দলুই, মিতা রায়, রাখী রায়, প্রতিমা রানা, দেবদ্রিতা রানা, অনিতা বর্মন, ডলি কুমার, কল্পনা মুখার্জি, ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী, তহমিনা খাতুন, সালেহা খাতুন, তন্দ্রা চক্রবর্তী, সারজিনা খাতুন, রাফিজা খাতুন, দিলওয়ারা খাতুন, ডাঃ শর্মিষ্ঠা রায়, জয়শ্রী সরকার, রিনা সরকার, ঈপ্সিতা সামন্ত, বন্দনা দাস, আরাত্রিকা দে, শ্রাবণী রায়, স্নিগ্ধা রায়, কাকলি চক্রবর্তী, কল্পনা নাগ, সুমনা পোদ্দার, টুকটুকি নাগ, অনুব্রতা দাস, মৌসুমী প্রামাণিক, সোমা কর, ফতেমা বেগম, ডঃ সোমা …