বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

লকডাউন ও শ্রমজীবীদের জীবন

লকডাউন ও শ্রমজীবীদের জীবন

গার্গী ব্যানার্জী

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জুলাই, ২০২১— করোনার প্রথম ঢেউ: লকডাউন-আনলক, দ্বিতীয় ঢেউ: লকডাউন, তৃতীয় ঢেউ: সম্ভাব্য লকডাউন। প্রায় দুই বছর। অতিমারি পরিস্থিতিতে সমাজের একটা অংশের মানুষের কাছে এর জন্য অসুবিধা বিশেষ কিছু নেই। ট্রেন-বাস বন্ধ, তাতে কী? গাড়ি আছে, র্যাপিডো-ওলা-উবের আছে। দোকানপাট খোলার সময় নির্দিষ্ট কিন্তু অনলাইন ডেলিভারির ব্যবস্থা আছে— সেখানে আবার ছাড়ও মিলছে। সিনেমা হল বন্ধ: কিন্তু নেটফ্লিক্স অ্যামাজন প্রাইম আছে। অনলাইন অফিস, অনলাইন স্কুল; মোটের উপর ভালোই চলছে— ঘরে বসেই সব পাওয়া যাচ্ছে। শুধু একটাই সমস্যা যখন খুশি বেরনো যাচ্ছে না, করোনার ভয়ে আত্মীয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা যাচ্ছে না, সিনেমা, শপিং মল, পার্লার, রেস্টুরেন্ট, ঘুরতে যাওয়া ব্যাপারে একটু খুঁতখুঁতানি বেড়েছে। ঘরে রকমারি রান্না হচ্ছে, ফেসবুক-ইন্সটাগ্রামে দেওয়া হচ্ছে, ভ্যাকসিন কবে পাওয়া যাবে সেই চিন্তা— এভাবেই জীবন এগিয়ে চলেছে। জীবন মানে সমাজের একটা অংশের মানুষের জীবন— যাদের কথাগুলোই বেশি বেশি উঠে আসছে টিভিতে, খবরের কাগজে বা সামাজিক মাধ্যমে।

কিন্তু এর উল্টোদিকে সমাজের বিরাট অংশের মানুষদের রাতের ঘুম উড়ে গেছে পরের দিন কী রোজগার হবে, কাজটা থাকবে কি না চিন্তায়। টিটাগড়ের মাফুজাদি, সায়রাদি, বিদ্যাধরপুরের অপর্ণাদিদের মাথায় হাত সংসার কী করে চালাবেন ভেবে। এঁরা প্রত্যেকেই ট্রেনে করে বেলঘরিয়া, যাদবপুর, ঢাকুরিয়া আসেন; পেশায় গৃহশ্রমিক। গত বছর লকডাউন আর ট্রেন বন্ধ থাকায় এই পেশায় থাকা অধিকাংশরই কাজ চলে যায়, সামান্য যে জমানো টাকা ছিল সেই দিয়েই কোনও মতে দিন কাটে। লকডাউন ওঠার পর কাজ পেলেন কিন্তু অনেক কম মাইনেতে। লকডাউনে কাজে আসতে না পারায় বেশির ভাগ গৃহশ্রমিকই মাইনে, বোনাস পাননি। অনেকে পরিযায়ী শ্রমিক, স্বল্প ভাড়ার ঘরে থেকে কাজ করেন। এখানে রেশন কার্ড নেই, রেশন কার্ড গ্রামের ঠিকানায়। ফলে অধিকাংশই না পেয়েছেন রেশন, না পেয়েছেন সরকারি কুপন। যাঁরা রেশন পেয়েছেন তাঁদেরও শুধু চাল আর গম দিয়ে কি দু’বেলা পেট ভরে! এ বছর লকডাউনে কেউ কেউ কাজে আসতে পারলেও যাতায়াত খরচ বেড়ে গেছে প্রায় তিনগুণ, নয় তো হাঁটাই ভরসা। স্টাফ স্পেশাল ট্রেনে যদি ওঠেনও, সেখানে আছে রেল পুলিশের চোখ রাঙ্গানি, তার সঙ্গে সময়ের অপচয়। যাঁদের ট্রেন লাইন থেকে দূরে বাড়ি তাঁদের পক্ষে আসাও প্রায় অসম্ভব। আগের থেকে পরিশ্রম ও যাতায়াতের সময় অনেক বেশি খরচ হচ্ছে কিন্তু মাইনে কমে গেছে তুলনায়। আবার অনেক কাজের বাড়ি থেকে নিদান দিয়েছে ভ্যাকসিন না নিলে কাজে আসা যাবে না, কিন্তু ভ্যাকসিন নেবে কীভাবে সেটা কেউ বলে দেয়নি। বেসরকারি হাসপাতালেতে ৮০০-১,০০০ টাকা দিয়ে প্রতি ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া সম্ভব না আর সরকারি জায়গায় কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও ভ্যাকসিন পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই, তার জন্য ছুটিটাও মিলবে কিনা সন্দেহ।

photo

এ তো গেল শুধু গৃহশ্রমিকদের কথা। আমাদের পাড়ায় অধিকাংশ লোকেরই রোজগার ছোট ছোট ব্যাগের কারখানা আর গেঞ্জির কারখানা থেকে। সবাই যে শুধু মেশিনে ব্যাগ বা গেঞ্জি বানান তা নয়; কেউ সুতো কাটেন, কেউ ট্যাগ লাগান, কেউ বা আবার ইস্ত্রি করেন। লকডাউনে স্কুল বন্ধ, দোকানপাট আংশিক বন্ধ, পরিবহণ সমস্যা, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় জামাকাপড়, ব্যাগের চাহিদা কমে গেছে। তাই এঁদের অবস্থা তথৈবচ। অধিকাংশ ছোট কারখানা বন্ধ, কিছু টিমটিম করে চলছে। ছোট মালিকদের মাথায় মহাজনের ধারের বোঝা। এই অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যাঁরা কাজ করতেন তাঁদের রোজগার প্রায় বন্ধ। অনেকে তাই বাধ্য হয়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। কেউ সবজি বেচছেন, কেউ ফল বেচছেন, বা অন্য কিছু ফেরি করার চেষ্টা করছেন। কারোর কাছে আবার এই সব্জি-ফল কিনে বিক্রি করার মতোও সামান্য পুঁজিও নেই।

বেলঘরিয়া স্টেশনে উত্তমদার চায়ের দোকান আছে, চায়ের সঙ্গে বিভিন্ন রকমের বিস্কুট, কেক পাওয়া যায়। এই দোকানের জন্য রেলকে প্রতি মাসে ভাড়া দিতে হয়। বেলঘরিয়া শিয়ালদহ উত্তরের লাইনে খুবই জনবহুল একটা স্টেশন। উত্তমদার দোকান ভালোই চলত। এখন দিনে সামান্য কয়েকটা ট্রেন চলে, রোজগার অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। যাঁরা ট্রেনে ট্রেনে হকারি করতেন তাঁদের রোজগার সম্পূর্ণ বন্ধ। এঁদের পাইকারের থেকে মাল তুলতে হয় বেশির ভাগই ধারে। একে তো রোজগার নেই তার উপর মাল কেনার ধার এবং বিক্রি না হওয়ায় মাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এঁরাও পেশা পরিবর্তন করছেন বাধ্য হয়ে কিন্তু যাবেন কোন পেশায়?
ট্রেন-বাসের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ছোটখাটো কারখানা বা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকা অনেক লোক তাঁদের কর্মস্থলে যান। কিন্তু এখন গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় বেশির ভাগেরই কাজ বন্ধ। কেউ আবার কাজ বাঁচানোর তাগিদে সাইকেলে ৩০-৪০ কিমি রোজ পাড়ি দিচ্ছেন।

বাচ্চাদের বা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের স্কুলে আসা যাওয়া করার পুলকার চালকদের কথা যদি ধরা হয়, করোনা ও লকডাউনের ফলে তাদের অবস্থাও অথৈবচ। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার জন্য পুলকারের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, এঁদেরও উপার্জন বন্ধ। কিছু সহৃদয় ব্যক্তি এঁদের প্রাপ্য মাইনে দিলেও অধিকাংশই দিচ্ছেন না। এঁরাও এখন চরম সঙ্কটে।

গ্রামাঞ্চলেও অবস্থাটা আশাব্যঞ্জক নয়। যেমন ধরা যাক বাঁকুড়ার বিমলদার কথা। পাঁচাল গ্রামের ভূমিহীন খেতমজুর পরিবারের সন্তান বিমল বাউরি পেশায় নির্মাণ শ্রমিক। গ্রামের আশেপাশেই তাঁর কাজ। গ্রামে নির্মাণ কাজ বলতে মূলত বিভিন্ন আবাস যোজনা ও সরকারি নানা প্রকল্পের নির্মাণ কাজ। খুব যে রোজগার হতো তা নয় তবে অন্যের জমিতে পারিবারিক শ্রম আর ধানজমির চুনোমাছ, হরেকরকম ছত্রাক, শাক দিয়ে পরিবারের পাঁচজনের পেট চলে যেত। গত বছরের লকডাউনে গ্রামাঞ্চলে করোনার আতঙ্ক কম ছিল তাই গ্রামের মধ্যে টুকটাক কিছু কাজ হচ্ছিল। কিন্তু এবারের লকডাউনে তা প্রায় পুরো বন্ধ। কাজের জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া, সারা দেশ জুড়ে আর্থিক মন্দা আর সরকারি প্রকল্পে নির্মাণ কাজে ভাটা পড়ায় এবার কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। ১০০ দিনের মাটি কাটার কাজে নাম লিখিয়েছিলেন সেখানেও মাত্র বারো দিন কাজ পেয়েছেন। পেট কী করে চলবে সেই চিন্তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নির্মাণ শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের পেশাগত ব্যাধি - কোমর ও শিরদাঁড়ার ব্যারাম। না আছে তার জন্য কোনও সবেতন “মেডিকেল লিভ”, না আছে রাজ্যের নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ পর্ষদ (BOCWA 1996 আইন অনুযায়ী গঠিত)-এর কোনও ব্যবস্থা। নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ খাতে অর্ধেকের বেশি সেস বাবদ জমা পড়া টাকা অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে আর একের পর এক লকডাউনের কোপে বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকু খোয়াতে বসেছেন বিমলদার মতো বহু গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষ।

এতো শুধু কিছু খণ্ড খণ্ড চিত্র মাত্র। আসল ছবিটা আরও ভয়ানক, আরও মন খারাপ করে দেওয়া। এঁদের সামনে শুধুই অনিশ্চয়তা। গতবছর পরিযায়ী শ্রমিকদের সার দিয়ে ঘরে ফেরার ছবি এখনও আমাদের মনে তাজা। গতবার তাও খবরের কাগজ, টিভির দৌলতে এঁদের কর্মহীনতার কথা জানা গেলে এঁরা কিছু সাহায্য পেয়েছিলেন এবং দেশ জুড়ে কিছু আলোড়ন পড়েছিল কিন্তু এ বছর সেটাও নেই প্রায়। গতবার এঁদের জন্য কিছু আর্থিক প্রকল্প ঘোষণা করা হলেও আশি শতাংশ মানুষই তা পাননি। এ বছর সেরকম কোনও প্রকল্পও ঘোষণা হয়নি। রাজ্য সরকার থেকে রেশন দেওয়া হচ্ছে কিন্তু তাতে মিলছে শুধু চাল, গম। কিন্তু ভাতের সঙ্গে ন্যূনতম খাবার জন্যে লাগে সরষের তেল, সবজি, ডাল; জ্বালানি গ্যাস বা কেরোসিন তেল। আকাশছোঁয়া বাজারদরের দৌলতে সামান্য ডালভাত বা আলুসিদ্ধ ভাত জোটানোও মুস্কিল। পরিবারের কারো শরীর খারাপ হলে মাথায় হাত। ছেলে মেয়েদের স্কুল গত বছর থেকে বন্ধ, পরীক্ষা বন্ধ, পয়সার অভাবে অনেকের প্রাইভেট পড়াও বন্ধ। শিক্ষা পুরো রসাতলে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা। স্কুল বন্ধ দেখে এই ছেলেমেয়েদের অনেকে কাজে নেমে পড়েছে, অনেক অভিভাবক মেয়েদের আঠারো হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। এদের শিক্ষা নিয়ে উচ্চবিত্ত শ্রেণী বা সমাজ চালকদের মাথা ব্যাথা নেই। তাদের নিজেদের বাচ্চাদের অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে।

তথ্য অনুযায়ী দেশের ৯৭ শতাংশ পরিবারের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। দ্য হিন্দু-র এ বছর জানুয়ারি মাসের একটি খবর অনুযায়ী, সংগঠিত ক্ষেত্রে মজুরি হ্রাস পেয়েছে ৩.৬ শতাংশ আর অসংগঠিত ক্ষেত্রে মজুরি হ্রাস ২২.৬ শতাংশ অর্থাৎ ছয় গুণেরও বেশি। আর কতজন যে কাজ হারিয়েছেন তার কোনও ইয়ত্তা নেই। অনেকে পেশা পাল্টেছেন, অনেকে দুশ্চিন্তায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এই সংখ্যাটা ঠিক কত তাও আমাদের জানা নেই কারণ অসংগঠিত ক্ষেত্র নিয়ে সরকারের কাছেই কোনও সঠিক তথ্য নেই। রাজ্য সরকার এঁদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা যোজনা চালু করেছিল চার বছর আগে। পদ্ধতির নানা জটিলতার কারণে বেশিরভাগ শ্রমিকেরই নাম নথিভুক্ত নেই, উপরন্তু মাফুজাদি, সায়রাদি, অপর্ণাদি বা বিমলদাদের জীবনে যখন সবচেয়ে বেশি সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজন ছিল, গত বছর লকডাউনের সময় থেকে সরকার বাস্তবে তার রূপায়ন বন্ধ রেখেছে।

করোনা ভাইরাস তথা লকডাউন গোটা বিশ্বের অসাম্যের স্বরূপটিকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করে দিয়েছে। সমাজটার দু’টো ভাগ খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে চোখের সামনে। একভাগের কাছে আছে অঢেল অর্থ অথবা অঢেল অর্থ উপার্জনের উপায়। লকডাউন তাদের কাছে নির্বিঘ্নে অবসর যাপন করার বা মুনাফার পাহাড় বাড়িয়ে তোলার উপযোগী সময়। আর আর বেশিরভাগ মানুষের কাছে লকডাউন হল প্রতিদিনই বাঁচামরার পরীক্ষা। ঠিক যেন স্নোপিয়ার্সারের মতো, তুষার যুগ চললেও একদলের জীবনযাপনের পরিবর্তন নেই আর অন্য দলের বেঁচে থাকাটাই দায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শ্রমজীবী মানুষরাই সমাজের চালিকা শক্তি। সমাজের চাকা ঘোরানোর ক্ষমতা আছে তাদেরই হাতে। শুধু প্রয়োজন বেঁচে থাকার স্বার্থে, পৃথিবীকে বাঁচানোর স্বার্থে একজোট হওয়ার!

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.