বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

আগুনে অঙ্গার আজ মেহনতি মানুষ

আগুনে অঙ্গার আজ মেহনতি মানুষ

শৌভিক দে

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ এপ্রিল, ২০২২— এই মুহূর্তে, বাজারে আগুন পেট্রল ডিজেল গ্যাসের দাম। যার আঁচে পুড়ছে আপামর সাধারণ মানুষ।
ক'দিন আগেই বীরভূমের রামপুরহাটের বগটুইয়ে শিশু নারী সহ অন্তত আটজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে যে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত করা হয়েছে তাতে আগুন ধরাতে ব্যবহার করা হয়েছিল পেট্রল-ডিজেলই। গণহত্যা ঘটানো খুনীদের একবারের জন্যও যে পেট্রল ডিজেলের দামের কথা ভাবতে হয়নি তা বলাবাহুল্য।
রামপুরহাটের বগটুইয়ের ভয়াবহ গণহত্যা, আনিস খান হত্যা, ঝালদার কংগ্রেস কাউন্সিলর কিম্বা কামারহাটির তৃণমূল কাউন্সিলর খুন, চুড়ান্ত লাঞ্ছনা করে তুহিনা খাতুনকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা - এই প্রতিটি ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এ রাজ্যে কতটা সুরক্ষিত আমরা। বুঝিয়ে দিচ্ছে লেসার ইভিলের আসল রূপ।
এ কথা অনস্বীকার্য যে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার মানবতার পক্ষে অত্যন্ত বিপদজনক। তারা দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করছে, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করছে, কর্পোরেটের দালালি করে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ এমনকি মানব সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবার ফলে সারা দেশে চূড়ান্ত অসাম্য, দারিদ্র্য, বেকারত্ব। নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের।
একবার রাজ্যের দিকে চোখ রাখুন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ডের অনুরূপ প্রতিচ্ছবি কি দেখতে পাচ্ছেন না?
এ রাজ্যে গণতন্ত্র কতটা সুরক্ষিত সেটা বোঝা যায়, আনিস হত্যা থেকে রামপুরহাটের গণহত্যার খবরে চোখ রাখলেই।
মানুষে-মানুষে বিভেদ? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য একসময় গর্ব করা এই বাংলায় আজ মুসলমানদের আদর করে "দুধেল গাই" বলেন মাননীয়া। তাই গরু যেমন দুধ দেয়, তাদের কুরবানিও যে দেওয়া হয় এই সত্য বারবার উঠে এসেছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে।
মুসলিমদের শুধুমাত্র ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করেই বিরত থাকেনি রাজ্যের বর্তমান শাসক দল, এই পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর দারিদ্র ও অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে তাদের একাংশকে দুর্বৃত্ত বাহিনি হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে। তাই আরাবুল থেকে আনারুলরা দলের সম্পদ তবে সময় বিশেষে আপদ হয়ে যান।
আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে বাংলায় হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণের তাস খেলতে চায় আরএসএস ও বিজেপি— তাদের হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে শক্তিশালী করার জন্য। যে ভাবে তারা উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডে বিধানসভা নির্বাচনে জয় করায়ত্ত করেছে।
আরএসএস-এর রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। তারা এখন শাসন ক্ষমতায়। কিন্তু মনে করার কোনও কারণ নেই যে তৃণমূল, বহুজন সমাজবাদী পার্টির মতো আঞ্চলিক দলগুলিকে আরএসএস তাদের লক্ষ্য পূর্ণ করার জন্য ব্যবহার করছে না।
আরএসএস-বিজেপির সঙ্গে রাজ্যের শাসক দলের নীতিগতভাবে বিরোধ নেই। আরএসএস-বিজেপির বরাবরই 'ক্রোনি ক্যাপিটালিজম' বা 'বন্ধু পুঁজি'র পক্ষে অবস্থান নিয়ে এসেছে। আরএসএস-এর স্নেহধন্য হতে পারলে আম্বানি আদানিদের মতো ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের হাত ধরার পথ অনেকটাই সুগম হয়ে যায়।
কৃষক আন্দোলনের ধাক্কায় মুখ পুড়েছে মোদি সরকারের। একবছর মাটি কামড়ে থেকে আম্বানি আদানিদের বন্ধু মোদি সরকারকে ভয়াবহ তিন কৃষি আইন বাতিল করাতে বাধ্য করেছেন কৃষকরা। সেই সময়ে মোদি এবং কর্পোরেট বিরোধী জোটকে ভেস্তে দিতে আরএসএস এবং ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টরা তৈরি রাখতে চায় তাদের সেকেন্ড ডিফেন্স। এই সময়েই মাননীয়ার গলায় শোনা গিয়েছে, "আম্বানি আদানিদের চাই, কৃষকদের ও চাই!
সেই সমীকরণ মেনেই নবান্নে একে একে আগমন মোদির বন্ধু গৌতম আদানি এবং তাঁর পুত্র করণ আদানির। আদানিদের হাতে প্রস্তাবিত দেউচা পচামির খোলা মুখ কয়লাখনি, তাজপুর বিমানবন্দর তুলে দেওয়া গেলে অনেকটাই নিশ্চিন্ত হওয়া যায় একের পর এক লোকরঞ্জক রাজনীতি চালিয়ে যেতে, কার্যত দেউলিয়া হয়ে যাওয়া রাজ্য কোষাগার সত্ত্বেও।
আর ঠিক এখানেই আমরা কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মিল খুঁজে পাই রাজ্য সরকারের। ঠিক একই ভাবে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের মানুষের স্বার্থের তোয়াক্কা না করে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ায়।
এই প্রাকৃতিক সম্পদ বললে একদিকে যেমন নদী, পাহাড়, জল, জঙ্গল, খনির কথা মনে পড়ে যায়, তেমনই উঠে আসে বালি খাদান, কয়লা খাদান, পাথর খাদানের কথাও। আর সেই সূত্র ধরেই ভেসে ওঠে বালি মাফিয়া, কয়লা মাফিয়াদের কথা। এই বালি খাদান, কয়লা খাদান, পাথর খাদানের অবৈধ কালো টাকা আর তার কাটমানির দৌলতে একদিকে যেমন ভাদু শেখ, আনারুলরা ঠিকে শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি থেকে রাজ্যের বর্তমান শাসক দলের ছত্রছায়ায় এসে প্রাসাদ গড়ে তোলে, গড়ে তোলে সাম্রাজ্য, তেমনই সেই কাটমানির টাকাতেই পুষ্ট হয় একদা 'বাংলার বিবেক'দের ঝুলি। আর সেই কলাটা মুলোটার লোভেই সেই সমস্ত 'বাংলার বিবেক'রা, সেই সমস্ত এলিট ক্লাসের সিটিজেনরা, রামপুরহাটের গণহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনার পরেও মুখে কুলুপ হেঁটে থাকেন। শুধু কুলুপ এঁটেই থাকেন না, কেউ আবার দাবি করেন যে তাঁরা রূদালী নন। তাই যে কোনও ঘটনা ঘটলেই তাঁরা কাঁদতে পারবেন না। অথচ সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের পরবর্তী পর্যায়ে 'বাংলার বিবেক' সেজে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সান্ধ্য তর্কের অনুষ্ঠান যাঁরা 'আলোকিত' করতেন, কন্ঠ কাঁপিয়ে কাঁদতেন, তাঁরা গুলিয়ে ফেলেছেন যে রূদালীরা এমনি এমনি কাঁদেন না। কাঁদার জন্য পয়সার বিনিময়ে তাঁদের ভাড়া করা হয়।
কর্পোরেট বাজারি মিডিয়া অবশ্য আরেকটা জিনিস তৈরি করেছে। সেটা হল বাইনারি। আরএসএস যেমন হিন্দু-মুসলমান বাইনারি তৈরি করেছে, তেমনই কর্পোরেট মিডিয়া আরএসএস এবং ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের বানানো ফর্মুলাতেই তৈরি করা হয়েছে তৃণমূল-বিজেপি বাইনারি। অর্থাৎ হয় এপক্ষ নাও, নয় ওপক্ষ। হয় বিজেপি নয় তৃণমূল। তৃতীয় কোনও পক্ষর অস্তিত্বই তারা স্বীকার করতে চায় না। এই বাইনারি তৈরি করতে গিয়েই বারবার রামপুরহাটের গণহত্যা নিয়ে আলোচনায় রামপুরহাটের সঙ্গে তুলনা টানা হয় নেতাই কিম্বা ছোট আঙারিয়ার। অথচ এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে রামপুরহাটের গণহত্যার পার্থক্য অনেক। এই সমস্ত ঘটনাগুলোয় স্পষ্টতই লড়াই হয়েছিল দুই পক্ষের বা দলের মধ্যে।
রামপুরহাটের ঘটনায় কিন্তু তৃণমূলের হাতেই তৃণমূলের গণহত্যা ঘটেছে। যতই ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য বীরভূমের বেতাজ বাদশা অনুব্রত টিভি ফেটে আগুন লাগার থিওরি দিক, যতই শাসক দলেররা নেতারা 'গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র'র কথা বলুন, খোদ মুখ্যমন্ত্রী নিজে রামপুরহাটে গিয়ে চেক বিলি করতে করতে বলে দিয়েছেন, আনারুলকে পুলিশ পাঠাতে বললেও সে পাঠায়নি। মাননীয়ার নির্দেশেই রামপুরহাটের তৃণমূল ব্লক সভাপতি আনারুলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আর আনারুল অনুগামীরা দাবি করছেন আনারুল নাকি অনুব্রত মণ্ডলের ষড়যন্ত্রের শিকার।
কে কার শিকার তার উত্তর হয়তো বা খুঁজে পাওয়া যাবে ভবিষ্যতে। যেমন আজ নন্দীগ্রাম গণহত্যার জন্য কার্যত একদা সহযোদ্ধা শুভেন্দু অধিকারীকে দায়ী করেন মাননীয়া। কিন্তু একথা ঠিক যে বাংলায় আজ ঘোর অন্ধকার। ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে চারদিকে। শিল্প নেই, চরম বেকারত্ব। গত এগারো বছরে নতুন কোনও কারখানা বা শিল্পের হদিশ দূরবীণ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না।
বরং হুগলির চাঁপদানি থেকে হাওড়ার বাজে শিবপুর, বন্ধ হয়েছে একের পর এক কলকারখানা ও জুটমিল।
সুতরাং বেকার যুবকদের চপ শিল্পের চাইতে বালি খাদান, পাথর খাদান, কয়লা খাদানগুলোর বোমা শিল্পে, তোলাবাজি শিল্পে আকর্ষিত করাটা অনেক বেশি লাভজনক।
কিন্তু একেবারেই কি আশার আলো নেই? সরকারি চাকরি আর পাঁচ লক্ষ টাকার চেকের টোপ ফিরিয়ে দিচ্ছেন আনিসের বাবা। আমতায় আনিসের গ্রামের লোকজনের কাছে কার্যত তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন মন্ত্রী। আশা এখনো মরেনি...

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.