বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

প্রতিরোধের মশাল জ্বেলে…

প্রতিরোধের মশাল জ্বেলে…

গৌতম ব্যানার্জী

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ এপ্রিল, ২০২২— নৈরাজের এক সর্বব্যাপী আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছে আমাদের পশ্চিমবাংলা। যারা এই নরকে বাংলাকে নিক্ষেপ করার কাণ্ডারীর ভূমিকায় ছিলেন তারাও এখন নিম্ন স্বরে রব তুলছেন সব গেল, গেল বলে। ষড়যন্ত্র, দ্বি-চারিতা আর প্রতারণায় এরা কালজয়ী। এরাই ছিল পশ্চিমবাংলার ‘পরিবর্তন’-এর কাণ্ডারি। এদের প্ররোচনায়, সাহচর্য্যে, ষড়যন্ত্রের ব্যবস্থাপনায় পশ্চিমবাংলায় কায়েমী স্বার্থবাদীদের পুনরুত্থানপর্ব সম্পন্ন হয়েছিল। হয়েছিল ঠিক তখন যখন বাংলা দীর্ঘ বঞ্চনা আর অবরোধের পাহাড়গুলো ডিঙোতে ডিঙোতে মোটের ওপর একটা অগ্রসর রাজ্য হওয়ার দিকে অগ্রসরমান। গোটা দেশের মধ্যে পশ্চিমবাংলা তখন শিল্পে-কৃষিতে-শিক্ষায়-মানবোন্নয়নে সামনের সারিতে।
ঠিক তখনই আঘাত এলো। পুঁজি চায় প্রশ্নহীন আনুগত্য, চায় নির্বিচার লুঠের অবাধ স্বাধীনতা। বামফ্রন্টের সরকার এই কায়েমী স্বার্থবাদীদের চক্ষুশুল হয়েছিল। দেশব্যাপী উদারনীতির বগ্লাহীন দাপট আর দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্নকারী ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির বিরুদ্ধে বামপন্থীদের অবস্থান—এইসব মিলিয়েই দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়ার চক্র ‘পরিবর্তন’এর আওয়াজ তুলেছিল। অধুনা যা পোস্ট ট্রুথ বলে আলোচিত তার নির্মাণ আমরা পশ্চিমবাংলায় দেখেছিলাম। ১১ বছর ধরে সেই পরিবর্তনের রাহু গ্রাসে পশ্চিমবাংলা এখন বধ্যভূমি, বগটুই-এর শ্মশান। পরিবর্তনের স্বর্গ যখন আমতা-বর্ধমান-ঝালদা-বগটুই-মগরাহাট-হাঁসখালির বধ্যভূমি হয়ে দাঁড়ায় তখন অতি বড় চোরের মায়েদেরও গলার উচ্চগ্রাম মিইয়ে যায়। বাংলার সংস্কৃতির সেইসব ছত্র ধারকরা বড় বিপত্তিতে। সম্পাদকীয় নিবন্ধে উচ্চকিত্ত আর্তনাদ – ‘কবিরা কোথায়’…
কোথায় সেই কবিকুল তথা বিদ্দজনেরা? বগটুই শ্মশানে তারা কি তন্ত্র সাধনায় সমাসীন, নিরাসক্ত, মৌন। মোটেই না। মাথার ভাগাড় থেকে তুলে আনছে নন্দীগ্রাম, নানুর, নেতাই, সাঁই বাড়ি। এই সবই পশ্চিমবাংলার মানুষের বিরুদ্ধে করা কায়েমী স্বার্থবাদী শোষকের ভয়াবহ অপরাধের এক একটি ঘৃণিত নজির। বগটুইতে বিপর্যস্ত মমতাকে পথ দেখাচ্ছে ভাড়াটে কলমচী আর সংবাদমাধ্যমের মালিকের দল। এই বিশেষ প্রজাতির কাজ হল মানুষের মনন ধ্বংস করা, চিন্তন ক্ষমতা চৌপাট করে দেওয়া। বিজ্ঞাপনের উচ্চিষ্ট না জুটলে এদের কারবারে লালবাতি জ্বলার আশঙ্কা আর কলমচীদের পুরস্কার তথা নানা কমিটি আলো করার সুযোগ হড়কে যাওয়ার যন্ত্রণা।
বহু দিন থেকেই এরা শীতঘুমে। পুরসভা দখলের অভিযানে তৃণমূলীরা ১০২টি পুরসভা দখল করেছে, এর ৩৮টি থেকে বিরোধীদের পুরোপুরি মুছেই দেওয়া হয়েছে। ২১৭০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৮৭০টি ওয়ার্ডেই দখল করেছে তৃণমূল। এই ভোটকে ঘিরে যে অদ্ভূতপূর্ব সন্ত্রাসের পরিবেশ গড়ে তুলেছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন, রাজ্য সরকার, পুলিশ এবং তৃণমূল লুঠেরা বাহিনি মিলিতভাবে তা যে প্রতিটি নির্বাচনেই নতুন নজির সৃষ্টি করেছেন সে বিষয়ে কি কোনও সন্দেহ আছে? শহর, গ্রাম, স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, কারখানা সর্বত্রই জাকিয়ে বসেছে তৃণমূলের ভয়ানক দখলদারি। এখন দখলদারিকে কেন্দ্র করেই তৈরি হচ্ছে একটি বিস্ফোরক অর্থনীতি, যেখানে মিলছে নবান্ন থেকে স্থানীয় তৃণমূল নেতা, আইএএস, আইপিএস, ডিএসপি, ওসি সহ সবাই। একটা রাজ্য মাত্র ১১টা বছরের ব্যবধানে অধঃপাতের কোন অতলে দাঁড়িয়ে? পশ্চিমবাংলার ঋণগ্রস্ততা বাড়তে বাড়তে এখন ছয় লক্ষ কোটির গন্ডি ছাড়িয়েছে। নতুন করে কোনও বড় ভারী শিল্প গড়ে ওঠেনি। স্থানীয় ছোট শিল্পে তোলাবাজির দৌড়াত্ম্য নাভিশ্বাস উঠেছে। এলাকায় এলাকায় সিণ্ডিকেট, বালি খাদান, পাথর খাদান, কয়লা খাদান, গোরু পাচার আর তাকে ঘিরে তৃণমূলের লুঠেরা বাহিনি। ঠিক যেমনটা আজকের লুঠেরা পুঁজির চাহিদা। এমন নজির ছড়িয়ে আছে দুনিয়া জুড়ে, যেখানেই মার্কিনী নজর সেখানেই। পশ্চিমবাংলাও তার বাইরে নয়। গণতন্ত্রের কাঠামোকে যেমন খুশী ভেঙে চুড়ে লোপাট করে তার ওপর কালিঘাটের গঙ্গাজল ছিটিয়ে নিলেই হল। এটাকে কেন্দ্র করেই আবর্বিত হচ্ছে পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এক শ্বাসরুদ্ধকর ভয়াবহতা। অর্থনীতি ধ্বসে গিয়েছে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিসর এখন একটা নিপাট তামাসা, সাংস্কৃতিক জীবনের কথাটা না হয় তোলাই থাক। সমগ্র বিগত কয়েক মাস জুড়ে যে একের পর এক হত্যাকান্ড হয়ে চলেছে তা হল তৃণমূল জমানার অনিবার্য্য ফল।
২০০৭ সালে থেকে পশ্চিমবাংলায় বামপন্থীদের উৎখাতের লক্ষ্যে যে অভিযান চলছিল তা এখন পূর্ণ প্রস্ফুটিত। ভারতবর্ষের উপর সেই সময়কালে মার্কিন খবরদারি বৃদ্ধি আসলে তো লুঠেরা আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজিরই দাপট বৃদ্ধি। সে দাপট অব্যহত রাখার জন্য জরুরি ছিল পশ্চিমবাংলার মতো একটি অগ্রসর গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল চিন্তার রাজ্য থেকে বামপন্থীদের উৎখাত করা। এক দশক আগেও প্রাক স্বাধীনতার পর্ব থেকে আজ পর্যন্ত পশ্চিমবাংলা জাতীয় রাজনীতির নানা বাক এবং মোড়ে খুবই উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে এসেছে। পশ্চিমবাংলা থেকে একটা আওয়াজ উঠলে তার যে অভিঘাত জাতীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় সেটার গুরুত্ব সকলেই উপলব্ধি করতেন। ফলে পশ্চিমবাংলায় যা ঘটছে, ঘটে চলেছে তা আপাত নৈরাজ্যের আড়ালে চালু থাকা একটি সুগভীর ষড়যন্ত্রের মহড়া। এর গভীরতা যথাযথ উপলব্ধি করতে না পারলে সমূহ বিপর্যয়। আর সেই বিপর্যয়কালীন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই আমরা চলছি, চলতে হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ের হত্যাকাণ্ডগুলির পাশাপাশি আরো যা নজরে আসছে তা হল তৃণমূল বাহিনির নেতৃত্বে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ব্যাপক হারে জমি দখল এবং বন্দুকের ডগায় তাকে আইনি সিলমোহর দিয়ে নেওয়া। জলাজমি, সরকারি সম্পত্তি এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি কিছুই ছাড় পাচ্ছে না। সরকারি প্রকল্প থেকে পুরসভা পঞ্চায়েতের অর্থের দেদার লুঠ চলছে। সেই লুঠের টাকার একটা অংশ যাচ্ছে কালিঘাটের নজরানায়, একটা অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে নিত্যনতুন সম্পত্তি নির্মাণে আর একটি অংশ ব্যয় হয়ে চলেছে সশস্ত্র বাহিনি গঠনে এবং তার রক্ষণাবেক্ষণে। পশ্চিমবাংলার এমন কোনও প্রান্ত নেই যা এই নেটওয়ার্কের বাইরে, প্রতি এলাকাতেই একেবারে জেলা সদর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত এই নেটওয়ার্ক। বীরভূমের অনুব্রত যেমন, রামপুরহাটে তার ছাতায় আনারুল-ভাদু, অন্যত্র এমন আরো কত মণি-মাণিক্য। নবান্নের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে একেবারে বিশুদ্ধ আইনি মতে সমস্ত প্রশাসন, পুলিশকে নিপাট দলদাস ভেড়ুয়ায় পরিণত করা হয়েছে। একই সঙ্গে পরিচালনা করে যাচ্ছেন রাজ্যব্যাপী শাসক দলের সশস্ত্র বাহিনিকে। এই বাহিনি কার্যত সকল আইনের ঊর্ধ্বে, সমস্ত ধরা ছোঁয়ার বাইরে। রাজ্য প্রশাসনের প্রধান কাজই হল এই অপরাধীদের নিরাপত্তা দেওয়া, যা শুরু হয়েছিল তৃণমূল সরকার কায়েমের একেবারে গোড়ায় ভবানীপুর থানা থেকে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এসে গ্রেপ্তার হওয়া অপরাধীদের ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। সেই ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজ্যের সর্বস্তরের খুনি-ধর্ষকদের কাছে পরিস্কার বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল যে কোনও চাপ নেই ‘দিদিকে বলো’। মনে রাখতে হবে, এই নেটওয়ার্ক কিন্তু এখনো বিজেপি’র নেই। আরএসএস-এর দুর্গার রাজত্বে শাখার সংখ্যা বেড়েছে ঠিকই কিন্তু তা এই বাহিনির কাছে কিছুই নয়। মা দুর্গার কৃপায় ওরা বাড়ছে, বেড়ে চলেছে একই অভিন্ন শত্রু বিনাশের লক্ষ্যে, আর তা হল পশ্চিমবাংলার বামপন্থীদের তথা কমিউনিস্ট আন্দোলন। সামনে যতই কুস্তি চলুক, ভেতরের দোস্তিটা আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। তা সত্ত্বেও আবার এমনটা বলা যায় না যে তৃণমূল এবং বিজেপি একই দেহে লীন হয়ে গেছে। এমনটা বলা হবে রাজনৈতিক ভুল। মানুষকে তার জীবনের অভিজ্ঞতায় লড়াইয়ের ময়দানেই শিখতে দিতে হয়। পশ্চিমবাংলার মানুষের জীবনে এখন তৃণমূলের সন্ত্রাস আর নৈরাজ্যের চাইতে বড় বিপদ আর কিছু নেই। তারই বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রতিরোধের সংগ্রাম আর রুটি রুজির লড়াইকে একই সুতোর মালায় গাঁথতে হবে। চালাতে হবে বিরতিহীন লড়াই। শত সহস্র ধারায় বিকশিত করতে হবে শ্রেণী আন্দোলন এবং গণ আন্দোলন। সেটাই রাস্তা। সমস্ত রকমের গতানুগতিকতা দূরে হটিয়েই গড়ে তুলতে হবে লড়াই সংগ্রাম। দেখনদারীর কর্মসূচি দিয়ে কোনও দিনই লড়াইয়ের জমি তৈরি করা যায় না। আজ যখন প্রায় শূন্য থেকেই শুরু করার পালা তখন ছোট থেকে বড় হওয়ার সৃজনশীল লড়াই গড়ে তুলতে হবে। এ বাংলার আপামর মানুষ আজ আক্রান্ত। তারাই জোগাবে ছায়া, রক্ষা করবে, কিন্তু সাহস করে চোখে চোখ রেখে নামতে হবে। আর একই সঙ্গে প্রয়োজন মতাদর্শগত চর্চা এবং সংগ্রাম। আদর্শগত সংগ্রাম ছাড়া কোনও লড়াইয়েরই কোনও সুনির্দিষ্ট অভিমুখ তৈরি হতে পারে না। কোনও শর্টকাট নেই, কোনও পথই বাতিল হয়ে যায়নি। তবে পরিস্থিতির দাবি হল স্থানীয় ভিত্তিতে পরের পর প্রতিরোধের মশাল জ্বালা, জ্বেলে চলা। আনিসের গ্রাম থেকে মানুষ তাড়া করে বার করে দিয়েছিল দুই মন্ত্রীকে। প্রতি মহল্লায় তেমনই প্রতিরোধের ব্যুহ গড়ে তুলতে হবে। এক, দুই করতে করতেই একদিন সে মশাল ছড়িয়ে যাবে বাংলায়, গোটা দেশে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.