বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
পাশাখেলায় পরাজিত, বনবাসী পাণ্ডবদের সঙ্গে কৃষ্ণ দেখা করতে এসেছেন। সম্রাজ্ঞী দ্রৌপদী পদ্মের কুঁড়ির মতো দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “মধুসূদন আমার পতি নেই, পুত্র নেই, বান্ধব ভ্রাতা পিতা নেই, তুমিও নেই।” সব থেকেও কিছু না থাকার এই তীব্র আক্ষেপ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আজও — কখনও সন্দেশখালিতে, কখনও চোপড়ায়। সমবেত জনতার সামনে এক দুর্বৃত্ত প্রকাশ্যে একটি মেয়েকে ছপটির আঘাত করল, চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে বারবার মাটিতে আছড়ে ফেলল। এমন দৃশ্য দেখে অযুত-নিযুত নারীকণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসে এই আর্তচিৎকার — “আমার নেতা নেই, পুলিশ নেই, প্রশাসন নেই, মন্ত্রী সাংসদ বিধায়ক নেই, সংবিধানও নেই।”
মেয়েদের ভোটেই নাকি লোকসভা ভোটে বেশি আসন পেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। আর তারপর থেকেই বারবার, রাজ্যের নানা অঞ্চলে, গণপ্রহারের লক্ষ্য করা হচ্ছে মেয়েদের। এ কি পরিকল্পিত? বাংলার মেয়েরা তাদের ভোটের শক্তি যতই প্রয়োগ করুক, সমাজে তাদের অবস্থান কিছুমাত্র বদলায়নি — এই কি রাজনীতির বার্তা?
এক সম্রাজ্ঞীকে প্রকাশ্য সভায় চূড়ান্ত অপমান কেবল বিজেতার উল্লাস তো ছিল না. তার পিছনে ছিল শাসকের দুর্মর লোভ — প্রতিবার পাশা নিক্ষেপের পর ধৃতরাষ্ট্র বালকের মতো প্রশ্ন করছিলেন, “আমরা কী জিতলাম?” রাজধর্মের প্রতি এতটা অন্ধ না হলে প্রকাশ্য নারীনিগ্রহ এত ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠতে পারে না। আজ দুর্বৃত্তরা নিরপরাধ তরুণী-কিশোরীদের অকারণে প্রহার করছে, তারপর তার ভিডিয়ো ছড়াচ্ছে। উদ্দেশ্য — ঝিকে মেরে বউকে শেখানো। তীব্র স্বরে মাইক বাজানো থেকে শুরু করে গণধোলাইয়ে হত্যা, এ সবই সযত্নে-রচিত দৃশ্য। যার বার্তা, শাসক-আশ্রিত বাহুবলীর প্রকাশ্যে মারধরের সামনে পুলিশ-প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, মহিলা কমিশন-মানবাধিকার কমিশন, সব কৌরব সভায় সভাসদদের মতো স্থানু, নির্বাক থাকবে। রাজকর্মচারীরা যে যত বড় মহারথীই হন, রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধে গলা তুলবেন না। পুলিশ, আইন, আদালত, জনপ্রতিনিধি, সব থাকা সত্ত্বেও নাগরিককে রাস্তায় পড়ে মার খেতে হবে। শত অধিকার-ধারিণী, তবু অনাথবৎ এ রাজ্যের মেয়েরা।
সেই আতুরতার উপরেও নেমে আসছে বিদ্রুপের কশাঘাত। কেন, তুমিই তো জিতিয়েছ তৃণমূল কংগ্রেসকে। বিরোধীরা অবধি স্বীকার করছে যে, মেয়েদের ভোটেই এ বার লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের জয়জয়কার। অথচ, পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, বগটুই, হাসখালি, সন্দেশখালিতে কী অবস্থান ছিল তৃণমূলের, তা কি মেয়েদের অজানা ছিল? সব দেখেও লক্ষ্মীর ভান্ডারকে সর্বাধিক গুরুত্ব যদি দিয়ে থাকে রাজ্যের মেয়েরা, তা হলে ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’নীতি অনুসারে চুপ করে সওয়াই তো ঠিক।
এ কথা যদি কারও কাছে, কিছুমাত্র গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়, তা হলে বুঝতে হবে যে রাজনীতির হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ চেহারাটাকেই স্বাভাবিক বলে দেখানোর কাজে নেতারা সফল হয়েছেন। নাগরিকের প্রত্যাশা পূর্ণ করে তাদের সমর্থন যিনি আদায় করতে পেরেছেন, তিনিই নেতা — এই হল গণতন্ত্রের নিয়ম। আজ সব দল মিলে ব্যবস্থাটাকে উলটে দিয়েছে — নেতাকে যে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সমর্থন করে, তিনিই নাগরিক, বাকিরা আক্রমণযোগ্য প্রতিপক্ষ, এই যেন নিয়ম। বাংলার মেয়েরা তাদের সংসারের সংস্থান, আর্থিক স্বাতন্ত্র্য করে-দেওয়ার নীতিকে সমর্থন করেছে। সব রাজ্যেই দেখা গিয়েছে, সরকার কোনও বড়সড় অনুদান ঘোষণা, বা ঋণ মকুব করলে পরবর্তী নির্বাচনে তার প্রতিদান দিয়েছে জনতা। পশ্চিমবঙ্গের মেয়েরাও তা-ই করেছে।
তা বলে তাদের প্রতি বঞ্চনা, বৈষম্য তারা ভুলে বসে নেই। অন্য সব রাজ্যে একশো দিনের কাজ চালু রয়েছে, বন্ধ কেবল পশ্চিমবঙ্গে। মেয়েরা তা থেকে রোজগার হারিয়েছে, তার উপর কাজের খোঁজে পুরুষদের ভিন রাজ্যে যাত্রা বেড়েছে বলে একাকী সংসারের বোঝা টানছে। অথচ, খাদ্যের দাম লাগাম ছাড়া, শিক্ষা-চিকিৎসা নামেই ফ্রি। কোভিড-পরবর্তী আর্থিক চাপের প্রাবল্যের মুখে আর্থিক অনুদানকে প্রাধান্য দেওয়া অরাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, এমন নয়। তার মানে এই নয় যে গণপ্রহারের সংস্কৃতির প্রতি তারা উদাসীন, সহনশীল। দুর্বৃত্তের পীড়নকে উপেক্ষা করতে মেয়েরা রাজি আছে দুটো পয়সার জন্য, এ এক জঘন্য ধারণা।
মনে রাখতে হবে, মেয়েরা কেবল ভোটদাতা নয়, ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বীও। তারা কেবল অনুদান গ্রহণের সম্মান চায় না, বিরোধী প্রার্থীর সম্মানও চায়। সামনে পুরসভা ভোট। সেখানে সব দলের মহিলা প্রার্থীদের নিরাপদে মনোনয়ন জমা, প্রচার, ভোট দান করতে দেয় কিনা তৃণমূল সরকার, সেটাই সরকারের নারী-সক্ষমতার সর্ববৃহৎ পরীক্ষা। ভোটলক্ষ্মী চঞ্চলা, আজ কৃপা করলেও কাল বিরূপ হতে দ্বিধা করে না।