বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

নারী ক্ষমতায়নে পিছুটান

নারী ক্ষমতায়নে পিছুটান

বঙ্কিম দত্ত

photo

প্রজাতি সংরক্ষণে নারীর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। প্রাণের বিবর্তনের ধারায় বিভিন্ন প্রাণীর মতো মানবীরাই কেবল সন্তান উৎপাদনে সক্ষম। নলজাতক শিশুরও মাতৃগর্ভ প্রয়োজন। প্রকৃতিরও উৎপাদন ক্ষমতার আমরা প্রকাশ দেখি নানাভাবে — সুজলাং সুফলাং। সন্তান তথা পরবর্তী প্রজন্মের উৎপাদন ও নতুন সমাজের পুনরুৎপাদনে নারীর ভূমিকা সমাজে নারীকে অনন‍্য করেছে। সেকারণে নারীকে প্রকৃতির প্রতিরূপ ভাবা হয়। সুদূর অতীত থেকেই নারী ও প্রকৃতির মিথোজীবী সম্পর্ক। প্রকৃতিকে রক্ষা করে খাদ‍্য, জ্বালানী সংগ্রহ, চাষ ও পশুপালনে নারীদের ভূমিকা আজও নানাদিকে স্পষ্ট। অরণ্য রক্ষায় নারীদের উজ্জ্বল ভূমিকার অন‍্যতম সাক্ষ‍্য চিপকো আন্দোলন (১৯৭৩)। কন্ট্রাক্টরদের করাতে গাছ কাটা আটকাতে গাড়োয়াল হিমালয়ে নারীরা সন্তান স্নেহে জড়িয়ে ধরেছিলেন গাছগুলিকে। উদাহরণ বাড়াবো না। প্রকৃতি সংরক্ষণে নারীদের রয়েছে অনন‍্য ভূমিকা। অন‍্যদিকে নারীর গর্ভস্থ ভ্রুণ সৃষ্টির প্রথম ক্ষণ থেকে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব তুলে নিয়ে জরায়ুতে পৌঁছে যায় কোটি-কোটি মাইক্রোব যা বায়ো-ইনফরমেটিক্সের বিজ্ঞানে এখন অনেক স্পষ্ট। অথচ প্রজাতি ও প্রকৃতি সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের সহায়ক নারী অর্থনীতি, রাজনীতি সহ সর্বত্রই অবহেলিত।
সভ‍্যতার অতি প্রাচীনকাল থেকেই নারী-পুরুষের প্রাকৃতিক বিভিন্নতা (তৃতীয় লিঙ্গবিচারে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বলাই শ্রেয়) পুরুষতান্ত্রিক ব‍্যবস্থার আনুকূল‍্যে বৈষম‍্য ও বিভেদ চুড়ান্ত রূপ নিয়েছে। প্রকৃতির সন্তান হয়েও নারীর অবস্থান পরিবার ও সমাজে পুরুষের সমান তো নয়ই বরং অনেকটাই পিছিয়ে। নারীদের উপর পিতৃতান্ত্রিক অবদমন অবসানের লড়াই বিশ্বজুড়ে, কর্মসূচি ও লড়াইয়ের পদ্ধতির নানা পার্থক‍্য নিয়েই।
তাই অবস্থার পরিবর্তনের যে সমস্ত চেষ্টা নানাস্তরে স্পষ্ট তা খন্ডিত হলেও আশা জোগাচ্ছে। নারীদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা রাজনীতিতে কী ভাষ‍্য নিতে পারে এই বাঙলায় সদ‍্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আমরা দেখলাম। এ রাজ‍্যে সরকারি সাহায্য হিসাবে সামান‍্য অর্থ নারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ‍্যে। এই সামান‍্য অর্থ হাতে পৌঁছানোর পর তা কীভাবে ব‍্যবহৃত হয় তা নিয়ে নির্দ্দিষ্ট সমীক্ষা নেই। অথচ একে শ্লেষ ও অবজ্ঞা করতে যারা পিছিয়ে ছিলেন না তাদের একটা অংশ বামপন্থী। বিরোধিতার দলীয় রাজনীতির বাধ‍্যতার কাছে এ একধরনের আত্মসমর্পণ। অথচ সক্ষমতা তৈরির বাজারমুখী এই প্রচেষ্টাকে, চালু পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরোধিতায় প্রসারিত করার সুযোগ ছিল। তুলে ধরা যেত পুঁজিতন্ত্রের মধ‍্যেকার বিরোধের প্রতিফলনকে যা পুঁজিবাদের নিজস্ব সংকটেরই প্রকাশ। সারা দেশজুড়ে কর্পোরেট সংস্থাকে দেওয়া ট‍্যাক্স ছাড় নাকচ করে নারীদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর কাজে লাগানো হোক এই দাবি উঠেছে বামপন্থীদের দিক থেকে নয়, দক্ষিণপন্থার দিক থেকে। অথচ আজকের কর্পোরেট বিরোধী আন্দোলনেরও অন‍্যতম দাবি তাই। এই লেখায় চেষ্টা থাকলো নারীদের ক্ষমতায়ন, প্রধানত আর্থিক ক্ষমতায়ন নিয়ে দুনিয়াজুড়ে চলা আর্থিক ব‍্যবস্থাটির অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতার স্বরূপ সন্ধান।
শ্রমশোষণের পুঁজিবাদী ব‍্যবস্থা সবসময়ই চুড়ান্ত নিষ্পেষণমূলক। বর্তমানে পুঁজি সঞ্চয়নের সূচকীয় গতিবৃদ্ধি নারী ও প্রকৃতি শোষণে সমানভাবেই সক্রিয় ও সেই শোষণ স্বৈরতান্ত্রিক।
‘জেন্ডার সোশ্যাল নর্মস ইনডেক্স, ২০২৩ এর নতুন তথ্য প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। সেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা সহ নানা ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অধিকারের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয়। বিশ্ব জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশের অবস্থার উপর সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি সেই সূচকে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে মি-টু (Me too)-এর মতো জোরালো আন্দোলন সত্ত্বেও গত এক দশকে মহিলাদের প্রতি বৈষম্য কমেনি।
নারীরা গড়ে প্রতিদিন ৭.২ ঘন্টা গৃহস্থালির কাজে ব্যয় করে। কিন্তু যেহেতু তারা এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মশক্তির অংশ নয়, অর্থনৈতিক পরিমাপ বা নীতি তাদের এই শ্রমকে বেগার শ্রম হিসাবে ধরে। এছাড়াও একই কাজের জন্য নারী শ্রমিকদের, পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় বিশ্বব্যাপী কম বেতন দেওয়া হয়। খোদ মার্কিন দেশের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, বছরভর কাজের চুক্তিতে পুরুষরা ১ ডলার বেতন পেলে মহিলারা সেই কাজের জন‍্য পেয়েছেন ৮৪ সেন্ট। আর চুক্তিহীন কাজের ক্ষেত্রে মহিলারা পেয়েছেন ৭৭ সেন্ট, কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার ক্ষেত্রে যা আরো কম, ৫৪ সেন্ট মাত্র। অর্থাৎ মহিলাদের প্রাপ্তি বেড়েছে ঠিকই কিন্তু বৈষম্য কমেনি, কম বেতনের চাকরিতেই নারীদের বড় অংশ নিয়োজিত।
অন‍্য একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। দক্ষিণ এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কৃষি-শ্রমিক নারী। যদিও আমরা যখন কৃষকদের কথা চিন্তা করি তখন আমাদের মস্তিষ্কে পুরুষদের মুখই ভিড় করে আসে। এই নারী কৃষি-শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে অনেক কম বেতন পান।
নারীদের বেগার শ্রম শব্দটি সাধারণত শিশু, বয়স্ক, অসুস্থ এবং পরিবারের যত্ন পরিষেবার (caregiving) সঙ্গে জড়িত। এগুলির বেশিরভাগই “মহিলাদের কাজ” হিসাবে বিবেচিত হয়। বেশিরভাগ যত্নের কাজের জন্য পুঁজিবাদ কোনও পারিশ্রমিক প্রদান করে না; পরিবর্তে, পেমেন্ট হিসাবে বরাদ্দ হয় নারীর “মাতৃ-প্রকৃতির” প্রশংসা। শ্রমিক শ্রেণীর সদস্য হিসাবে যেটুকু অধিকার তাও লঙ্ঘিত হয়। ‘আন্তর্জাতিক সমান বেতন দিবস, ২০২২’ উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রসংঘ জানাচ্ছে “নারীরা পুরুষদের তুলনায় কমপক্ষে ২.৫ গুণ বেশি অবৈতনিক কাজ করে।”
৬৪টি দেশে সংগৃহীত সময়-ব্যবহারের সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে দেখা গেছে যে প্রতিদিন ১৬.৪ বিলিয়ন ঘন্টা অবৈতনিক পরিচর্যা কাজে ব্যয় করা হয়। এই অবৈতনিক পরিচর্যা কাজের মোট ঘন্টার ৭৬.২ শতাংশ মহিলাদের দ্বারা সম্পাদিত। অন্যভাবে বললে, সারা বিশ্বে মহিলাদের দৈনিক অবৈতনিক পরিচর্যার কাজ আসলে ১.৫ বিলিয়নেরও বেশি মহিলাকে বিনা বেতনে দিনে আট ঘন্টা কাজ করানোর সমতুল্য (সূত্র: Tricontinental: Institute for Social Research)।
“আমাদের বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয় যে অর্থনীতিতে অবৈতনিক মহিলাদের মোট অবদান প্রায় ২২.৭ লক্ষ কোটি টাকা (গ্রামীণ: ১৪.৭ লক্ষ কোটি টাকা এবং শহুরে: ৮.০ লক্ষ কোটি টাকা) যা ভারতের জিডিপির প্রায় ৭.৫ শতাংশ,” জানাচ্ছে ভারতীয় স্টেট ব‍্যাঙ্কের ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদন।
মহিলাদের, বিশেষ করে, তাদের ২০–৩০ বছর বয়সের সময়ে, “সন্তানের জন্য যত্ন ও পেশাগত কাজের মধ‍্যেকার ভারসাম্য বজায় রাখা”র দ্বন্দ্বে পেশা ত্যাগ করতে হয় বা শ্রম-সময় কমাতে হয়। তারা পরে কাজ ফিরে পেতে চাইলে, ঐ সময়কালীন বেতন বৃদ্ধি এবং পদোন্নতি যা তাদের পুরুষ সহযোগীরা পায়, তা থেকে বঞ্চিত হয়, বিশেষত ছোট বা কোনও স্থায়ী কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা নেই এমন চাকরির ক্ষেত্রে এটাই দস্তুর। কর্মরত মহিলাদের প্রায় ৯০% এই ধরনের কাজেই যূক্ত।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, তার সমান কাজের জন‍্য নারী ও পুরুষের সমান মজুরি দেওয়ার আহ্বানটি জানিয়েছে ১৯৫১ সালের কনভেনশনে- “সমান মূল্যের কাজের জন্য পুরুষ ও মহিলা শ্রমিকদের সমান পারিশ্রমিক”। অথচ রূঢ় বাস্তব হল, ৭০ বছরেরও বেশি সময় পার করেও মজুরির লিঙ্গভিত্তিক এই অসমতা বেশিরভাগই ক্ষেত্রেই চলছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যপরিষেবা খাতে মহিলাদের অবৈতনিক বা কম বেতনের শ্রমের উপর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে: ১) স্বাস্থ্যপরিষেবা খাতে মহিলারা মোট কর্মশক্তির ৬৭%; ২) মহিলারা তাদের পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় গড়ে ২৪% কম উপার্জন করে; ৩) মহিলাদের অংশগ্রহণ বেশি হলেও, ব্যবস্থাপনার উচ্চ স্তরে মহিলাদের সংখ্যা কম।
এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, স্বাস্থ্য-পরিষেবায় মহিলারা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও তাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না।
“শ্রমের লিঙ্গ বিভাজন, গার্হস্থ্য ক্ষেত্রে নারীর কাজকে স্বাভাবিক ভাবা এবং উৎপাদনশীল কাজের তুলনায় প্রজনন কাজের অব-মূল্যায়নকে চ্যালেঞ্জ করুন,” শ্লোগান তুলছে ওয়ার্ল্ড মার্চ ফর ওমেন। ওয়ার্ল্ড মার্চ ফর উইমেন একটি আন্তর্জাতিক নারীবাদী আন্দোলন যা লিঙ্গ সমতার পক্ষে প্রচার করে এবং মহিলাদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং তাদের প্রতি সহিংসতা হ্রাস করার কাজে তদারকি করে। সমাধান হিসাবে তাদের বক্তব‍্য – গার্হস্থ্য এবং পরিচর্যা কাজের পুনর্গঠন, যাতে এই কাজের দায়িত্ব একটি পরিবার বা সম্প্রদায়ের পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হয়।
এটি বাস্তবে পরিণতি পাওয়ার লক্ষ‍্যে সংস্থাটি সামাজিক উৎপাদনকে (যেমন ক্রেজ, যৌথ লন্ড্রি এবং রেস্তোরাঁ, বয়স্কদের যত্ন ইত্যাদি) সমর্থনের লক্ষ‍্যে প্রয়োজনীয় নীতিগুলি প্রণয়ন ও গ্রহণের দাবি তোলে। সেইসঙ্গে বেতন ছাঁটাই ছাড়াই কাজের সময় কমানোটাও তাদের অন‍্যতম দাবি।
এই সমস্যাগুলির সমাধানের লক্ষ‍্যে তারা পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে “নারীবাদী অর্থনীতি” দ্বারা প্রতিস্থাপন করার আহ্বান জানায়, যা “নারীবাদী বৈশিষ্ট্য সহ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি”হিসাবে বিবেচিত হতে পারে বলে এই আন্তর্জাতিক উদ‍্যোগটি মনে করে। শ্রমিক শ্রেণীর সহায়তার জন‍্য এই নারীবাদী উদ‍্যোগটি সামাজিকভাবে বিপ্লবী কিছু ভূমিকা নেবার আহ্বান জানিয়ে নানা আন্তর্জাতিক প্রতিবাদী মঞ্চে ভূমিকা নেয়।
গার্হস্থ্য কাজে (বেগার-শ্রম) নারীদের প্রাধান্যকারী ভূমিকা এবং প্রচলিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের প্রান্তিক অবস্থান একটি বাস্তবতা। বেগার শ্রম, পুঁজিবাদী অর্থনীতিজাত কম মজুরি এবং হীন ও আদিম পেশাগ্রহণের বাধ‍্যবাধকতা এই ত্রহ‍্যস্পর্শযোগের ভারকেন্দ্রে এদেশে রয়েছে মনুবাদী সংস্কৃতি, যা নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে দেখে ও গৃহকর্মে সুনিপুণা হবার জন‍্য গৃহবন্দী রাখতে চায়। ‘রাত কত হইল?’ উত্তর মেলে না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.