বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

কেমন আছেন মেডিক্যাল রিপ্রেজ়েন্টেটিভ মেয়েরা

কেমন আছেন মেডিক্যাল রিপ্রেজ়েন্টেটিভ মেয়েরা

স্বাতী ভট্টাচার্য

photo

শ্রমজীবী মেয়েদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথোপকথনের জন্য তৈরি হয়েছে ‘নারী দিবস উদযাপন মঞ্চ।’ সম্প্রতি মঞ্চের একটি বৈঠকে ‘অল ওয়েস্ট বেঙ্গল সেলস রিপ্রেজ়েন্টেটিভস ইউনিয়ন’-এর চারজন মহিলা সদস্য তাঁদের পেশায় মেয়েদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানালেন। পেশাগত কারণে তাঁরা নাম প্রকাশ করতে চান না। এই প্রতিবেদনটি তাঁদের বক্তব্যের একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ।
আমাদের ইউনিয়নে আট হাজারের বেশি সদস্য রয়েছে, তাঁদের মধ্যে বড়জোর দু’শোজন মহিলা। এঁদের মধ্যে মেডিক্যাল রিপ্রেজ়েন্টেটিভ (এমআর) এবং সেলস রিপ্রেজ়েন্টেটিভ, দুই পেশার লোকই আছেন। ইউনিয়ন নেতৃত্বের আন্দাজ, রাজ্যে এখন অন্তত তেইশ হাজার পুরুষ এই কাজের সঙ্গে যুক্ত, মহিলাদের সংখ্যা মনে হয় হাজারের বেশি হবে।
এই পেশায় যখন মেয়ে নেওয়া শুরু হয়, তখন হাফ-ডে, হাফ-পে ভিত্তিতে রাখারই প্রচলন ছিল। ‘হাফ-ডে’ বললেও, বেশির ভাগ মেয়েকেই সকাল থেকে বেলা সাড়ে চারটে পর্যন্ত কাজ করতে হত। হাফ ডে ভিত্তিতে কাজ করলে মেয়েরা কম ছুটি পেত, কোনও ইনসেনটিভ পেত না। এখনও অনেক মেয়ে হাফ-পে ভিত্তিতে কাজ করে, তবে এখন পুরো সময়ের কাজে মেয়েদের নেওয়া আর ব্যতিক্রম নয়।
বড় বড় ওষুধ কোম্পানিগুলো মেয়ে কর্মীদের সম্মান দেখানোর জন্য নানা উদ্যোগ দেখায়, কিন্তু সত্যি তারা মেয়েদের প্রতি কতটা সংবেদনশীল, সে প্রশ্ন থেকে যায়। একটি কোম্পানিতে ‘শি প্রজেক্ট’ নামে একটা প্রকল্প শুরু হয়েছিল। সে বিষয়ে অনুষ্ঠানের দিন একটি মেয়ে প্রশ্ন করে, কেন মেয়েদের চাকরি কনফার্ম করা হচ্ছে না। তার কথায় কেউ খুশি হয়নি, এবং পরে অন্য কয়েকজন মেয়ের চাকরি পাকা হলেও, ওই মেয়েটিকে কোনও ডিভিশন পাকা কর্মী হিসেবে নিতে রাজি হয়নি। নারী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রদীপ জ্বালাতে মেয়েদের ডাকা হয়, কিন্তু উদ্যোক্তা থাকে পুরুষরাই।
কিছু কোম্পানি আইন অনুসারে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি করেছে ঠিকই, কিন্তু যে মেয়েরা এমআর-এর কাজ করে, তাদের কাউকে কমিটিতে রাখেনি। হিউমান রিসোর্স থেকে মেয়েদের বলা হয়, কোনও সমস্যা হলে আমাদের বলবে। কিন্তু কমিটির অপরিচিত সদস্যকে কি সমস্যার কথা কেউ শোনায়?
এমআর-দের কাজের কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই, ছুটিরও নিশ্চয়তা নেই। ‘সেলস প্রমোশন এমপ্লয়িজ় অ্যাক্ট’ মেনে কোম্পানিগুলো ছুটি দিতে বাধ্য, কিন্তু সব সংস্থা তা দেয় না। সকাল আটটায় কাজে বেরিয়ে মাঝরাতে বাড়ি ফেরা, এমনও হয়। এমআর কেবল ডাক্তারদের সঙ্গেই দেখা করেন, এমন নয়। তাঁর এলাকার ওষুধের দোকানে কেমিস্টদের সঙ্গে দেখা করে নিশ্চিত করতে হয় যে, নিজের ব্র্যান্ডের ওষুধ যথেষ্ট রয়েছে। স্টকিস্ট-এর সঙ্গে দেখা করতে হয়, টার্গেট কত দূর পূরণ হল তা দেখতে। এক একজনকে একটা এলাকা দেওয়া হয়, যেখানে দেড়শো-দু’শোজন ডাক্তার রয়েছেন। তাঁরা একটা নির্দিষ্ট সময়েই সঙ্গে দেখা করেন। এমআর মহিলা কিনা, তিনি রাতের শেষ ট্রেন বা মেট্রো ধরতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে অনেক ডাক্তার মাথাই ঘামান না। এমনও একজন চিকিৎসক ছিলেন যিনি রাত তিনটের সময়ে দেখা করার সময় দিতেন। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। গর্ভবতী অবস্থায় কর্মরত এমআর-কে তার সুবিধেমতো দেখা করার সময় দিয়েছেন, এমন চিকিৎসকও রয়েছেন।
অনেক সময়ে, বিশেষ করে মাসের শেষে, স্টকিস্ট-এর কাছে রাত ১১-১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তিনি স্টক দেখে অর্ডার দিলে, মোবাইলে তার ছবি তুলে বা মেল করে কোম্পানিকে পাঠিয়ে, তবে বাড়ি যেতে পারেন এমআর। রবিবার দিন যদি ডাক্তারদের সেমিনার থাকে, তা হলে সে দিন ছুটি বাতিল, কাজে ছুটতে হয়। ‘কমপেনসেটরি লিভ’ দেওয়ার কথা, কিন্তু অধিকাংশ কোম্পানি তাকে মান্যতা দেয় না।
এমআর-রা যে তাঁদের সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল, তার সুযোগ নিতে চায় ডাক্তার, স্টকিস্ট, কেমিস্ট, এমনকি ওষুধের দোকানের ফাই-ফরমাশ খাটা কর্মীও। ফোন নম্বর না দিয়ে উপায় নেই, তাই মাঝরাতে ভিডিও কল করে কথা বলার দাবি করেন অনেকে। আপত্তিকর কথাবার্তা, নানা কুপ্রস্তাব দিয়ে মেসেজ আসে। ‘ডিটেলিং শিখিয়ে দেব, চলো পার্কে গিয়ে বসি’, কিংবা ‘চলো এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করি’ — কোনও কোনও ম্যানেজারের কাছ থেকে এমনও প্রস্তাব আসে। যে ডাক্তাররা কথায়, কাজে মেয়েদের হয়রান করেন, তাঁদের কাছে কোনও পুরুষ এমআর পাঠাতে পারে ওষুধ কোম্পানিরা। তবে কোম্পানিগুলো সাধারণত এমআর বদল করে না। ‘তোমার সমস্যা তোমাকেই বুঝতে হবে’ এই ধরনের অবস্থান নেয়। অনেক মেয়ে এমন ঘটনায় অত্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বহু মেয়ে এই ধরনের হয়রানি মুখ বুজে মেনে নেয়, কোম্পানিকে জানায় না, কারণ তা হলে তার কাজের এলাকা বদলে দিতে পারে, তার বাড়ির থেকে অনেকখানি দূরে দিয়ে দিতে পারে, বা অন্য ভাবে হয়রান করতে পারে কোম্পানি।
ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করার জন্য ভারী ব্যাগ নিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় এমআর-দের। তাদের বিশেষ সমস্যা হল বাথরুমের ব্যবহারে বাধা। হাসপাতাল বা পলিক্লিনিক বলে দেয়, তাদের বাথরুম কেবল ডাক্তার আর রোগীদের জন্য। এমআর-দের প্রবেশ নিষিদ্ধ। কোভিডের পর থেকে এই কড়াকড়ি আরও বেড়েছে। হাসপাতালে বলা হয় সকলের জন্য নির্দিষ্ট শৌচাগার ব্যবহার করতে, কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করলে সংক্রমণ এড়ানো অসম্ভব। মফসসলের দিকে বহু জায়গায় আবার পাবলিক টয়লেট বলেই কিছু নেই। পিরিয়ড হলে খুবই অসুবিধায় পড়ে মেয়েরা।
খুব বড় সমস্যা মাতৃত্বের ছুটি নিয়ে হয়রানি। বিয়ে করা কিংবা গর্ভবতী হওয়ার খবর পেলেই কোম্পানির কর্তারা এমন ভাব করে, যেন ওই কর্মীর পক্ষে আর কাজে মন দেওয়া বা সময় দেওয়া সম্ভব নয়। সহানুভূতির ভান দেখিয়ে মেয়েটিকে বোঝানো হয়, তার পক্ষে শিশুকে সামলে কাজ করা কত কঠিন হবে। বহু মেয়ে যত দিন পারে গর্ভবতী হওয়ার খবর লুকিয়ে রাখে।
মেটার্নিটি লিভ-এ যখন মেয়েটি থাকে, তখনও তাকে চাপ দেওয়া হয় ডাক্তার, স্টকিস্টদের ফোন করতে, ভার্চুয়াল মিটিং-এ উপস্থিত থাকতে। ‘কাজের মধ্যে না থাকলে ফিরে এসে এত কাজ সামলাবে কী করে?’ এই ধরনের যুক্তি দেওয়া হয়। মাতৃত্বের ছুটিতে ‘ডেলি অ্যালাওয়েন্স’ বা দৈনিক ভাতা বন্ধ থাকে। এমআর-এর কাজে বেতনের অঙ্ক কম, অনেকটাই নির্ভর করতে হয় ভাতার উপরে।
সন্তানের জন্মের পর কাজে জয়েন করলে সব রকম ভাবে চাপ দেওয়া শুরু হয়, যাতে মেয়েটি কাজ ছেড়ে দেয়। যেমন, যে এলাকায় সে কাজ করছিল, সেখান থেকে সরিয়ে তাকে সম্পূর্ণ নতুন এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এমআর-এর কাজ যে হেতু পরিচয়ের ভিত্তিতে, ফলে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হয় মেয়েটিকে। সাম্প্রতিক অতীতে একটি মেয়ে মাতৃত্বের ছুটির পর জয়েন করলে তাকে সারা কলকাতার ওষুধের দোকানে সার্ভে করার কাজ দেওয়া হয়, এবং শনিবার ও সোমবার শিলিগুড়িতে কাজ করতে বলা হয়। মাতৃত্বের ছুটির পর কাজ ছাড়তে না চাইলে কোম্পানি থেকে সরাসরি শাসানো হয়েছে, ‘কী করে কাজ করতে পারো, দেখে নেব।’ এমন কথাও শুনতে হয় মেয়েদের যে, ‘তোমরা একটা ছেলের জায়গা নষ্ট করছ।’
কাজে জয়েন করার পরে মেয়েদের কিছুতেই ছুটি দিতে চায় না কোম্পানি, সন্তানের টিকাকরণের দিনেও নয়। ইউনিয়ন থেকে এই সব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে সমস্যার সমাধান করতে হয়। এই পেশায় ‘মেটার্নিটি বেনিফিট অ্যাক্ট’-সহ সমস্ত ধরনের আইনগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সংগঠনের ভূমিকা অপরিসীম। তবু আজও মাতৃত্বের ছুটির পরে বহু মেয়ে কাজ ছেড়ে দিচ্ছে — আন্দাজ করা যায়, মহিলা কর্মীদের অর্ধেক, বা তারও বেশি।
সদ্যোজাত সন্তানকে ঘরে রেখে কাজে যোগ দিয়েছে যে মেয়েটি, তার মানসিক, শারীরিক অবস্থা কী থাকে, বোঝাই যায়। তাকে বাড়ির কাজ সেরে বেরোতে হয়, আবার ফিরে এসে কাজ করতে হয়। স্বামী যদি বা তার সহায়তায় এগিয়ে আসে, পরিবারের অন্য সদস্যরা, পড়শিরা, ছেড়ে কথা বলে না। দীর্ঘ সময়ের কাজ, রাত করে বাড়ি ফেরা, এ সব নিয়ে প্রতিবেশীদের কথার অন্ত থাকে না। গর্ভাবস্থা যেমন লুকোতে চায় মেয়েরা, তেমনই মানসিক কোনও সমস্যার কারণে ওষুধ খেতে হলে সেটাও লুকিয়ে যায়। যে হেতু মনোরোগের ওষুধ খাওয়ার জন্যেও তার কর্মক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিতে পারে।
এত সমস্যা সত্ত্বেও এই পেশা মেয়েদের স্বাধীন রোজগার, সমাজ ও পরিবারে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। কেউ বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর এই চাকরিতে ঢুকে বাড়ি থেকে চটজলদি বিয়ে দেওয়ার চাপ এড়াতে পেরেছেন। কেউ গার্হস্থ্য নির্যাতন থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন ভাবে সন্তানকে নিয়ে বাঁচার উপায় খুঁজে পেয়েছেন। যদিও প্রায়ই তাঁদের প্রশ্ন শুনতে হয় চিকিৎসক-সহ নানা মানুষের কাছ থেকে — ‘এই লাইনে কেন? এটা কি মেয়ের উপযুক্ত কাজ?’ পাশাপাশি রয়েছে নৈতিকতার বোধের সঙ্গে বোঝাপড়া। ওষুধ বিক্রির দায়িত্বে থাকা মহিলা এমআর-কে নিজেকেও কার্যত পণ্য করে তুলতে হবে, কথিত বা অকথিত এই দাবি তাদের বিপন্ন করে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.