বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

নির্বাচনের দাবিতে মেডিকেল কলেজে অনশন

নির্বাচনের দাবিতে মেডিকেল কলেজে অনশন

সৌমিজিত গাঙ্গুলি

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২— এই লেখা যখন লিখছি তখন মেডিকেলের অনশন ১৫০ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক ছাত্রছাত্রী সংসদ নির্বাচন অগণতান্ত্রিক ভাবে বাতিলের দাবিতে আমরণ অনশনে চালাচ্ছে রণবীর সাবিত প্রত্যুষ কৌশিক। ১০০ ঘন্টার মাথায় অসুস্থ রীতমকে বন্ধুরা মিলে ভর্তি করেছে সিসিইউ’তে। জ্ঞান ফেরার পরে মুখে খাবার খেতে অস্বীকার করে অনশন মঞ্চে ফিরতে চেয়েছে সে। ১২ তারিখের কনভেনশনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন চিকিৎসক সমাজ। ১৩ তারিখের ছাত্রছাত্রী নাগরিক মিছিলে রাজপথ কেঁপেছে আঠরোর হুঙ্কারে, অগণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে প্রেসিডেন্সী যাদবপুর আলিয়া বিশ্বভারতী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহ সমগ্র ছাত্রছাত্রী সমাজ। সমর্থনে রাস্তায় নেমেছেন নাগরিক সমাজ, অধিকার রক্ষা সমিতি সহ বিবিধ গণতান্ত্রিক সংগঠন।
মেডিকেল কলেজ কলকাতায় নির্বাচিত ছাত্রছাত্রী সংসদের দাবি নতুন নয়। ২০১৬ তে বিধানসভা ভোটে দ্বিতীয়বার জয়লাভের পর থেকেই তৃণমূল কংগ্রেস ক্যাম্পাস গণতন্ত্র শব্দটাকে পশ্চিমবঙ্গবাসীর অভিধান থেকে প্রায় মুছে দিয়েছে। জয়লাভের পর পরই সমস্ত কলেজে ছাত্রসংসদ নির্বাচন বাতিল করে সিলেকশানের মাধ্যমে স্টুডেন্টস কাউন্সিল মডেলের কথা ঘোষণা করে মেডিকেল কলেজ। আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ২০১৭র স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ইলেকশন বিল। যেখানে ব্যতিক্রমীভাবে চার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের নোটিশ জারি হয়। যেখানে উল্লেখ থাকে – এই বিল দেখিয়ে পরবর্তীতে কোনও ছাত্রছাত্রী সংসদ নির্বাচনের দাবি জানানো যাবে না। গত পাঁচ বছরে পর্যায়ক্রমে অত্যন্ত সচেতন ভাবে সমস্ত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্রের নির্বাসন ঘটিয়েছে তৃণমূল সরকার। প্রশস্ত করেছে দুর্নীতি ও গুণ্ডাগিরির রাজনীতি। ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের কথা, তাদের অধিকারের লড়াইকে সমস্ত রাজ্য জুড়ে বলপূর্বক বিনাশ করেছে অঙ্কুরেই।
২০১৬-র পর ছাত্রছাত্রী সংসদ নির্বাচন হয়নি এশিয়ার প্রাচীনতম মেডিকেল কলেজে। গত চারমাস ধরে সংগঠিত হয়েছে মেডিকেল কলেজের গণতন্ত্রপ্রিয় ছাত্রছাত্রীরা, একাধিক বিক্ষোভ-ডেপুটেশনে দাবি তুলেছে সংসদ নির্বাচনের। লাগাতার ৫২ ঘন্টা ঘেরাওর পর ২৫ অক্টোবর কলেজ কাউন্সিল বাধ্য হয়ে ঘোষণা করে ছাত্রছাত্রী সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে কলেজ কাউন্সিলই সক্ষম। ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এর মধ্যে করা হবে এই আয়োজন। ৩০ নভেম্বর ঘোষণা করা হয় আগামী ২২ ডিসেম্বর, ২০২২ এ নির্বাচন সংগঠিত হবে। ৫ ডিসেম্বর আকস্মিক ভাবে জানানো হয়, নির্বাচন সংগঠিত করা সম্ভব নয়। লিখিত কোনও নোটিশ ছাড়াই কেবল মাত্র হায়ার অথোরিটির কাল্পনিক হাতে বাতিল করা হয় নির্বাচন।
সহজেই অনুমেয় – এই সিদ্ধান্তের পিছনে কোনও যুক্তি নয়, সরাসরি হাত রয়েছে সরকারের। সামান্য ছাত্রছাত্রী সংসদ নির্বাচন আটকাতে প্রবল প্রতাপান্বিত তৃণমূল সরকার এতটা ব্যস্ত কেন? বুঝতে গেলে সামগ্রিক ভাবে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের এবং আপামর স্বাস্থ্য পরিষেবার রাজনৈতিক বাতাবরণ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়োজন।
রাজ্যের সমস্ত মেডিকেল কলেজেই তৃণমূলের একাধিপত্য চলছে। গতবছর আরজিকর হাসপাতালের আন্দোলনকেও ছলে বলে কৌশলে দুরুমুশ করেছে শাসক দল। বিরুদ্ধতার স্বর অবদমিত। একমাত্র উল্লেখজনক ভাবে ব্যতিক্রম থেকেছে কলকাতা মেডিকেল কলেজ। দীর্ঘকালব্যাপী শাসকদলের প্রতিনিধিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি, চিকিৎসকবিরোধী নীতির ফলে ছাত্রছাত্রী মহলে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। ছাত্রছাত্রী সংসদ নির্বাচনেও একই ঘটনা পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা প্রবল। এই পরাজয় শুধুমাত্র লজ্জার নয়, আশঙ্কারও। কারণ ছাত্রছাত্রীর সংগঠিত স্বর শুধু মেডিকেল কলেজ নয়, ছড়িয়ে পড়লে টলাতে পারে মেডিকেল কলেজগুলিতে তৃণমূল সরকারের আগ্রাসন। এমনিতেও সাম্প্রতিক মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনে তৃণমূলের নির্লজ্জ রিগিং এবং দুর্নীতি নিয়ে সরকারের মুখ পুড়েছে। তার উপর, ছাত্রছাত্রীদের এই আওয়াজ সামগ্রিক ভাবে টলাতে পারে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারের প্রভাবে। মেডিকেল কলেজে সরকারি স্বাস্থ্যপরিষেবার হাল বেহাল। অধিকাংশ সময়ই জরুরি ওষুধ, ব্যান্ডেজ, স্যালাইন অমিল। চুরি হয়ে যাচ্ছে জীবনদায়ী ইনজেকশন। সাধারণ রক্তপরীক্ষা বা ইউএসজির ডেট পেতেও চলে যায় মাসের পর মাস। মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য নিয়ে ধমক চমক কার্যত ফাঁকা আওয়াজ। নির্বাচিত ইউনিয়নের দায় বর্তায় স্বাস্থ্যের দাবিতে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার। এই নির্বাচন সরকারের পক্ষে শুধু অস্বস্তিকর নয়, অবাঞ্চনীয়ও বটে ।
ষড়যন্ত্র পরিষ্কার হতে ছাত্রছাত্রীরা বেঁছে নেয় আন্দোলনের পথ। নির্বাচন বাতিলের পর থেকেই প্রিন্সিপাল ঘেরাওয়ে শুরু হয় ক্যাম্পাসে বহিরাগত দুষ্কৃতিদের আনাগোনা। সারারাত টহল দিয়ে চলে তৃণমূল-সমর্থিত কর্মচারী ইউনিয়নের সদস্য ও দুষ্কৃতীরা। প্ররোচনা দিয়ে আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার জন্য রোগীপরিষেবা বিঘ্নিত করা হয় – দোষারোপ করা হয় আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর । অন্যদিকে প্রিন্সিপাল অফিস আলোচনার মধ্যেই আক্রমণ নেমে আসে ছাত্রছাত্রী প্রতিনিধিদের ওপর ।এক ছাত্রের গলা টিপে ধরে খুনের হুমকি দেন স্ত্রীরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. তপন কুমার নস্কর। ছাত্রদের বুকের ওপর পা দিয়ে হেটে বেড়িয়ে যান এক অধ্যাপিকা। এরপরেই অগণতান্ত্রিক ভাবে গণতান্ত্রিক নির্বাচন সংসদ বাতিলের দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলনে নামে ছাত্রছাত্রীরা। ৮ই ডিসেম্বর সকাল ১১টা থেকে অনশনে বসে পাঁচজন - রণবীর, সাবিত, কৌশিক, ঋতম, প্রত্যূষ। ১২ তারিখ ঋতম অনশনের মঞ্চে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হলে আমরণ অনশনে যোগ দেয় শুভ ও সৌমিত।
আজকের এই আন্দোলন শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রী সংসদ নির্বাচনের প্রশ্নে আবদ্ধ নয়। কলকাতা মেডিকেল কলেযে পড়াশোনার ন্যূনতম পরিকাঠামোটাও নেই। ক্লাসঘর বা লেকচার থিয়েটারের সংখ্যা গোটা কলেজে ছয়টি— একটি মেরামতির জন্য বন্ধ গত চার বছর, আরেকটিতে পঠনপাঠনের কোনও কাজ হয় না অতিমারির পর থেকে, অপর একটিতে আলো-হাওয়া প্রায় কিছুই নেই, নেই ডেস্ক অবধি। ঐতিহ্যবাহী জিএলটি (জেনারেল লেকচার থিয়েটার) তে ক্লাস চলাকালীনই ছাদ থেকে ভেঙে পড়ছে চাঙর, এতটাই দুরবস্থা। বস্তুত, কেবল দুটি লেকচার থিয়েটার পঠনপাঠনের উপযুক্ত। লাইব্রেরিতে নতুন বই নেই প্রায় বছর পাঁচেক। যেখানে চিকিতসা বিজ্ঞান প্রাত্যহিক চলমান সেখানে আপডেটেড কোনও জার্নাল নেই। ল্যাবরেটরি সরঞ্জাম ব্যবহারের অযোগ্য। নেই পানীয় জলের বন্দোবস্ত, খাবার অগ্নিমূল্য, শৌচাগারের হাল শোচনীয়। ছাত্রীদের হোস্টেলের অবস্থাও অতীব সঙ্গীন। সিট নেই। বাথরুম নেই। জলের ব্যবস্থা নেই। সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলার মতো এক্সট্রাকাররিকুলার অ্যাক্টিভিটির বেহাল দশার কথা বাদই দিলাম। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আজ স্পষ্ট, নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া তাদের এই অবস্থার উন্নতিও সম্ভব না। ইউনিয়ন নির্বাচনের দাবিতে তাই ঐতিহাসিক ভাবে ঐক্যবদ্ধ গোটা কলেজ। পাশে এসে দাড়িয়েছেন আপামর সমাজ। আগামী শনিবার গণ কনভেনশনের ডাক দেখেছে ছাত্রছাত্রীরা।
এই আন্দোলন আজ মেডিকেলের একক নয়, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রছাত্রী সমাজ এবং পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতির জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। সংগঠিত হয়ে এই লড়াইয়ের পাশে থাকার প্রয়োজন তাই ।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.