বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
রাজ্যের জননেতা, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিদায় নিলেন। সশ্রদ্ধ বিদায় জানালেন অগণিত জনতা। ছাত্র-যুব আন্দোলনের পথ বেয়ে দীর্ঘ সময় বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালনের পর তিনি এক দশকের বেশি সময় মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ রোগ যন্ত্রণার সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে ৮ আগস্ট সকালে চিরনিদ্রায় চলে গেলেন। সিপিআইএম পার্টি এবং বামফ্রন্ট নেতৃত্ব তাঁর মরদেহ তুলে দিলেন এনআরএস হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা বিজ্ঞানে কাজে। সারা জীবন সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন — মৃত্যুর পরেও তাঁর মরদেহ যেন মানুষের কল্যাণে লাগে সেই অঙ্গীকার করে গেছিলেন তিনি।
১৯৪৪ সনের ১ মার্চ উত্তর কলকাতায় তাঁর জন্ম। বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক হন। তারপরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা। এই সময়ই ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করেন। ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার সময় থেকেই সুবক্তা হিসেবে তিনি পরিচিত। ১৯৬৬ সনের খাদ্য আন্দোলন সহ নানা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আন্দোলনের সময়ে তিনি গ্রেপ্তার এড়িয়ে আত্মগোপনে কাজ করেছেন।
ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের গঠন পর্বে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। ১৯৬৮ সনে তিনি যুব ফেডারেশনের রাজ্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে দমদমের একটি স্কুলে দু’ বছর শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন।
পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি শিক্ষকতার কাজে ইস্তফা দিয়ে সর্বক্ষণের কর্মীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এক দশক কাল রাজ্যব্যাপী যুব সংগঠন করার কাজ করেন। ১৯৭৭ সনে কাশিপুর বিধানসভা থেকে শত ঘোষকে পরাস্ত করে বিধায়ক নির্বাচিত হন।
তিনি কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভ্রাতুষ্পুত্র হলেও কবির সান্নিধ্য পাননি। তাঁর শৈশবেই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রয়াত হন। কিন্তু পরিবারের সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক পরিবেশ তার উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। তিনি সারা জীবন রাজনীতি এবং সংস্কৃতি চর্চা একইসঙ্গে করেছেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীরতা অর্জন করেন। বিশ্ব সাহিত্য ও চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে তার যথেষ্ট বিচরণ ছিল। প্রথমে মন্ত্রী রূপে এবং পরে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বাংলার সংস্কৃতি জগতের দিকপালদের উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে অনেক কাজ করেছেন। কলকাতা বইমেলা তাঁর উদ্যোগে ১৯৮৪ সনে আন্তর্জাতিক বইমেলা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। রাজ্যে সাংস্কৃতিক তৎপরতা আজ অনেকটাই ম্রিয়মান।
বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এ রাজ্যের সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয় এবং তাঁদের বিরুদ্ধে সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু অন্য রাজ্যে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা থাকায় তাঁরা মুক্তি পাননি। জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ওই সমস্ত রাজ্যে পাঠান। ওইসব রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে মামলা প্রত্যাহৃত হয় এবং অনেকে মুক্তি পান। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েও সেই গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য রক্ষা করেছেন। রাজ্যে বিরোধী দলের কার্যকলাপ কখনও আক্রান্ত হয়নি। নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। জনসভা করে বলেছেন, মানুষ না চাইলে নন্দীগ্রামে কারখানা হবে না।
নয়া উদারনীতির পর্বে লাইসেন্স ব্যবস্থা উঠে যাওয়ায় এ রাজ্যেও কারখানা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাজ্যে ব্যাপক ভূমি সংস্কারের ফলে আভ্যন্তরীণ বাজারও প্রসারিত হয়েছিল। এই দ্বিবিধ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এ রাজ্যে কারখানা করার উদ্যোগ শুরু হয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রীত্ব কালে তা এগোনোর সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু সমস্যাও কম ছিল না। বিভিন্ন রাজ্য সরকার পুঁজিপতিদের বহুবিধ সুবিধার ডালি দিয়ে আহ্বান করছিল। নয়া উদারবাদের বিরোধিতা করেই বামপন্থীদের শিল্প করার কাজে এগোতে হয়। শিল্পের জন্য প্রয়োজন ছিল জমি। জমি অধিগ্রহণে বিরোধীদের প্রবল বাধা এবং আন্দোলনের মুখে পড়তে হয়। বিরোধীদের প্রচারে বাংলার জনগণ, বিশেষ করে, কৃষকরা প্রভাবিত হন। সিঙ্গুরে জনমত গঠনের কাজ অনেকটা হলেও রাজ্যজুড়ে ততটা ফলপ্রসু হয়নি। যে রাজ্যে ভূমি সংস্কারের ফলে জমি প্রধানত ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক জোত, সেখানে শিল্প গড়তে সরকার কর্তৃক জমি অধিগ্রহণের গুরুত্ব কৃষক জনতা তথা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর কাজ ততটা ফলপ্রসু হয়নি।
পশ্চিমবাংলা সহ দেশের নানান রাজ্যের মন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রীদের জীবনধারার সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সহজ সরল জীবনধারার সুস্পষ্ট পার্থক্যের ছবি চোখে পড়ে।
স্বপ্ন ছিল, বর্তমান সংকটের সময়ে নতুন পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করে তীব্র বেকারির সমস্যা সমাধানে ভূমিকা পালন করার। এ বিষয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে, আছেও। তবে আজ বোঝা যাচ্ছে, তাঁর উদ্যোগ সফল না হওয়ার পরিণতি।