বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

বিকল্পের সন্ধানে

বিকল্পের সন্ধানে

সঞ্জয় পূততুণ্ড

photo

সোভিয়েতের পতনের পর আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদী দেশগুলি বিশ্ব অর্থনীতির উপর নয়া উদারবাদী আগ্রাসন নামিয়ে আনে। সারা পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ, শ্রম শক্তি ও মেধা সম্পদের বলগাহীন লুঠ শুরু হয়। দেশে দেশে জাতি-রাষ্ট্রগুলি খাদ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশু ও বৃদ্ধদের সুরক্ষা, শ্রমিকদের ৮ ঘন্টা কাজ, উপযুক্ত মজুরি এবং সামাজিক সুরক্ষার দায়িত্ব থেকে হাত তুলে নিতে থাকে। সমস্ত কিছুই ছেড়ে দেওয়া হয় বাজারের উপর। যে কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ নিজেদের শ্রম দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত কিছু উৎপাদন করছে তারা নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হতে থাকে। পৃথিবীজুড়ে বৈষম্য তীব্র হতে থাকে। সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র, বেকারি, ক্ষুধা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সংকটে নিমজ্জিত হয়। বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমতে থাকে। নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদী অর্থনীতির সংকট আমেরিকা সহ উন্নত দেশগুলিকে গ্রাস করে। ২০০৮ সালে আমেরিকাতে সৃষ্টি হওয়া মহামন্দা সারা পৃথিবীতে ছায়া ফেলে যার থেকে আজও পৃথিবী বেরিয়ে আসতে পারিনি।
আমেরিকায় সৃষ্ট বিশ্ব মন্দার সময় থেকেই গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এ ধরনের সংকটের সম্ভাবনা থেকে নিজের দেশ ও জনগণকে বাঁচাতে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ করে চীন দেশের মরুভূমি অঞ্চল সহ সমস্ত অসেচ জমিতে ব্যাপক সেচ ব্যবস্থা তৈরি করে; সমস্ত কৃষকের ফসল লাভজনক দাম দিয়ে কিনে নেওয়া এবং সমস্ত দেশবাসীকে সস্তায় খাদ্য সরবরাহের প্রকল্প গ্রহণ করে। তাদের লক্ষ্য ছিল চীন দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলে দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদাকে প্রসারিত করা এবং রপ্তানিজনিত ঘাটতির সমস্যার মোকাবেলা করা।

সংকটের থেকে বেরিয়ে আসতে নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদ এ পথে যেতে প্রস্তুত নয়। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির অনুসৃতপথে আমাদের দেশেও সংকটের পুরো বোঝাটাই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের উপর। তীব্র হচ্ছে বেকারি, ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস। কাজের বোঝা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কাজের সময় বাড়তে বাড়তে ১২-১৪ ঘন্টা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কাজের খোঁজে অসংগঠিত শ্রমজীবীদের দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে হচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে। শ্রমিকদের বহু সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে অধিকারগুলি অর্জিত হয়েছিল এবং আইন স্বীকৃত হয়েছিল সেই অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যেই চালু করা হয়েছে চারটি শ্রম কোড। দীর্ঘ গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে খাদ্য সুরক্ষা আইন, ১০০ দিনের কাজের নিশ্চয়তা প্রকল্প, বনাধিকার আইনের মতো যে সমস্ত আইন ও অধিকারগুলি দেশের শ্রমজীবী মানুষ অর্জন করেছিলেন কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে সেগুলিকে লঘু করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বর্তমান বিজেপির সরকার। বৈষম্য তীব্র গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদেশের সম্পদের ৭২ শতাংশের মালিক মাত্র শতকরা ১০ জন এবং বিপরীতে সম্পদের ৩ শতাংশের মালিক দেশের শতকরা ৫০ জন।

শোষণের তীব্রতা ও নির্মম অবদমনের ফলে শ্রমিক কৃষক সহ সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে বিক্ষোভ। সারাদেশ এবং রাজ্যে শ্রমজীবী জনতার ছোট বড় অসংখ্য আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সেই ক্ষোভ প্রকাশিত হচ্ছে। গণআন্দোলনগুলিকে দমন করতে নামিয়ে আনা হচ্ছে কঠোর দমন পীড়ন। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার হরণ করার জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং রাজ্যের তৃণমূল সরকার একের পর এক ফ্যাসিবাদী-স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। জনগণের ঐক্যকে ভেঙে ফেলতে তারা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাস্তা নিয়েছে। আরএসএস বিজেপি তিন দশক আগে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যে বিপজ্জনক যাত্রা শুরু করেছিল আজকে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়ে তারা সেই কাজকে তীব্র করেছে। মুসলিমবিরোধী ফোবিয়া তীব্র করতে তারা ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন তৈরি করেছে।

এতদসত্ত্বেও দেশের কৃষি পণ্য ও কৃষি বাণিজ্যকে বড় কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে জন্য যে তিনটি কৃষি আইন করা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে সারাদেশের ৬০০টির বেশি কৃষক খেতমজুর সংগঠন ধর্ম-বর্ণ-জাতপাত এবং পতাকার রং নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লাগাতার আন্দোলন গড়ে তোলে। রাজধানী দিল্লিকে অবরুদ্ধ করে ১৩ মাস ধরে চলা ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের ফলে কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি ও কৃষক বিরোধী তিনটি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। প্রমাণিত হয় মোদি সরকার অপরাজেয় নয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকার প্রতিশ্রুতি মতো কৃষকের ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কার্যকরী করতে রাজি হয়নি। তাই আবারও কৃষক-ক্ষেতমজুররা আন্দোলনের পথে নেমেছেন। সারাদেশে তারা গ্রামীণ ধর্মঘট পালন করেছেন। তাদের সেই আন্দোলনে সামিল হয়েছেন শ্রমিকদের বড় অংশ। সারাদেশেই কৃষক-খেতমজুর সংগঠনগুলির সঙ্গে শ্রমিক সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়নগুলির ঐক্য ক্রমশ মজবুত এবং শক্তিশালী হচ্ছে। অন্ধ্রপ্রদেশে দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা বিরাট জয় অর্জন করেছেন। মহিলা কর্মীদের এই লড়াই অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে উদ্দীপ্ত করছে। পরিস্থিতি বলছে সারাদেশ এবং এই রাজ্য শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে সেই আন্দোলনকে সংগঠিত করতে বামপন্থী কর্মীদের অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

সন্দেশখালি এখন দেশের পরিচিত নাম। তৃণমূল সরকারের শাসনে সারা রাজ্যে বেপরোয়া জমি লুঠ, কৃষক-বর্গাদার উচ্ছেদ, মা-বোনেদের মর্যাদা লুঠ, ভোট লুঠ, রেশনের চাল, ১০০ দিনের কাজের মজুরি, আবাস যোজনার টাকা লুঠের যে রাজত্ব কায়েম হয়েছে তার বিরুদ্ধে জ্বলন্ত প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠেছে সন্দেশখালির মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। যে আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন মা-বোনেরা। পুলিশ বাধ্য হয়েছে লুঠের পান্ডা তৃণমূল নেতাদের গ্রেপ্তার করতে। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক বিজেপি যেন নিজের শক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে না পারে।

ক্রমবর্ধমান শ্রমজীবী মানুষের গণআন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে মোকাবেলা করতে কঠোর আইন ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতির পাশাপাশি শাসকদের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে সংবাদ মাধ্যম। অধিকাংশ বড় সংবাদ মাধ্যম কর্পোরেট স্বার্থবাহী সরকারি নীতিসমূহ এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতির স্বপক্ষে জনমতকে প্রভাবিত করার নিরন্তর প্রচার চালাচ্ছে। সারা দেশে বিজেপি সরকারের পক্ষে এবং পশ্চিমবাংলায় বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে দ্বিমেরুকরণের উদ্দেশ্যে প্রচার চালাচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সারাবিশ্বে আমাদের দেশের স্থান ১৫০তম। নির্ভীক সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে প্রায়শই।

বশ্যতা না মানলে কেজরিওয়াল বা হেমন্ত সোরেনের মতো জেলে যেতে হবে এই উদাহরণ সৃষ্টি করেছে কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপি। তৃণমূল সহ দেশের অনেক আঞ্চলিক দল কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে। কিন্তু নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারিতে দেখা গেল কর্পোরেট ও ব্যবসায়ীদের বিপুল পরিমাণ টাকা ঢুকেছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের শাসক দলগুলির তহবিলে। তালিকায় সবার উপরে রয়েছে বিজেপি এবং তারপরেই রাজ্যের তৃণমূল দল। বিজেপি বিরোধী ভাবমূর্তি রক্ষা করতে তৃণমূল কোথাও কোথাও বিজেপি সরকারের সমালোচনা করে, কিন্তু গুরুতর প্রশ্নে আবার বিরোধ এড়িয়ে যায়।

বৃহৎ পুঁজি চায় বিজেপিকে যারা অপছন্দ করে তারা এই সমস্ত আঞ্চলিক দলের অনুগামী থাক। আবার আঞ্চলিক দলগুলির যারা বিক্ষুব্ধ তারা বিজেপির সঙ্গে আসুক। আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের মতো দ্বি-দলীয় পরিস্থিতি এখানেও হোক। কিন্তু কোনওভাবে যেন শ্রমজীবী শ্রেণীগুলির স্বার্থরক্ষাকারী বামপন্থী বিকল্প মানুষের সামনে না আসতে পারে। নির্বাচনী বন্ডের টাকা বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলির তহবিলকে স্ফীত করলেও সিপিআই(এম) সহ বামপন্থী দলগুলিকে স্পর্শ করতে পারেনি।
শোষণ পীড়নের দ্বিমেরু অভিযানের শেষ কোথায়? ইতিহাসের শিক্ষা হল অবশ্যই তা ভেঙে পড়বে। কিন্তু আপনা থেকে তা ভেঙে পড়ে না। তাকে ত্বরান্বিত করতে হয়। শোষণ যন্ত্রণার অবসানের উদ্যোগ নেওয়া আবশ্যিক। নব্য ফ্যাসিবাদী স্বৈরশক্তির প্রতিটি কার্যকলাপের মোকাবেলা করতে হবে। প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই ব্যবস্থা ভাঙ্গার বিকল্প শক্তির বিকাশ ঘটবে। বাম চেতনা সম্পন্ন বিকল্প গড়ে তুলতে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে নানা কারণে বিভিন্ন শক্তি প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদ ও আন্দোলনের সমস্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা বামপন্থীদের কর্তব্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে, নানা ধরনের প্রতিবাদীদের মধ্যে নানান সীমাবদ্ধতা ও দোদুল্যমানতা থাকে। তাই ঐক্য ও সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

লোকসভা নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচনের সাফল্য জয়-পরাজয় সমাজ জীবনের মূল সমস্যাগুলির সমাধান করবে না। কিন্তু জনগণের কাছে বিকল্পের প্রয়োজন স্পষ্টতর হবে। আন্দোলনের ময়দানে এগিয়ে আসছে তরুণ প্রজন্ম। নারী শক্তির উত্থান সমস্ত আন্দোলনকে শক্তিশালী করছে। বিগত শতাব্দীর ২০ দশক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ শক্তি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের লক্ষ্যকে জীবনের ধ্রুবতারা করে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা পৌঁছে গিয়েছিলেন শ্রমিক কৃষকের শোষণ জর্জরিত জীবন এবং আন্দোলনের মাঝে। সীমাহীন আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন শ্রমিক কৃষকের আপনজন। যে কোনও আক্রমণ ও বিপদের মুখে তারা থেকেছেন শ্রমিক কৃষকের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে। তার ফলে তৈরি হয়েছে বড় বড় লড়াই। এই সংগ্রামই প্রস্তুত করেছে বামপন্থী আন্দোলনের মজবুত ভিত্তি। তীব্র আক্রমণের বর্তমান পর্যায়ে তরুণ শক্তিকে শ্রমিক কৃষক খেতমজুরের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হতে হবে। তাঁদের জীবনযন্ত্রণা পাশে, তাদের মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অধিকারের আন্দোলনে সামিল হতে হবে। ব্যর্থ করতে হবে নতুন ধরনের ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার গভীর ষড়যন্ত্র।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.