বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
বছরের শেষ লগ্নে হাতে পাওয়া গেল গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল। নরেন্দ্র মোদির দল সেখানে নিজেদের এবং অন্যদের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে খানখান করে দিয়ে সপ্তম বার একাদিক্রমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। এই ‘ঐতিহাসিক’ বিজয় নিয়ে বিস্তর কথা শোনা গেল, সেই রাজ্যের রাজনীতিতে আম আদমি পার্টির উত্থান এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পতন বিষয়েও বিচার-বিশ্লেষণ কম হল না। কিন্তু এই কথাসরিৎসাগরে কোনও বামপন্থী দলের নামও কার্যত উচ্চারিত হয়নি, হওয়ার কোনও কারণও ছিল না। পশ্চিম ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যটির নির্বাচনে, বস্তুত তার রাজনীতিতেই, তারা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। এ নিয়ে আলাদা করে বলার কিছুই নেই, গুজরাতে বামপন্থী দল বরাবরই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে থেকেছে। কিন্তু ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে’ বলে মূল প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যাওয়া চলে না। কেন এই অপ্রাসঙ্গিকতা? এমন তো নয় যে সে রাজ্যে বামপন্থী রাজনীতির কোনও স্থান নেই, কোনও প্রয়োজন নেই। বড় রকমের প্রয়োজন আছে, উত্তরোত্তর সে প্রয়োজন বেড়েছে। বেড়েছে, কারণ তথাকথিত ‘গুজরাত মডেল’-এর ঢক্কানিনাদের অন্তরালে যে বিপুল অসাম্য এবং অনগ্রসরতার ছবি বিভিন্ন সমীক্ষায় ক্রমাগত প্রকট হয়েছে, তা আমাদের অজানা নয়। গ্রামে ও শহরে শ্রমজীবী মানুষের বিপন্নতার এই ধারাবাহিকতা সত্ত্বেও বামপন্থী দলগুলি কেন সেখানে সংগঠন গড়ে তুলতে পারেনি? এই না-পারার হাজারটা কারণ থাকতে পারে, গুজরাত-বিশেষজ্ঞরা সে-সব কারণ নিয়ে অতিকায় সন্দর্ভ রচনা করতে পারেন, লাগাতার বক্তৃতা দিতে পারেন, কিন্তু তাতে বুনিয়াদি প্রশ্নটার উত্তর মিলবে না।
গুজরাত উপলক্ষ্য মাত্র। প্রশ্নটা আসলে বৃহত্তর ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে। একটি অপ্রিয় সত্য, কেবল অপ্রিয় নয়, কঠোর এবং নির্মম সত্য সাফ সাফ স্বীকার করে নেওয়া দরকার, তা না হলে আমরা যে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছি তা থেকে উত্তরণের কিছুমাত্র সম্ভাবনা আছে বলে মনে করি না। সত্যটা এই যে, ভারতবর্ষের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে আমাদের পরিচিত বামপন্থী রাজনীতির ধ্বজাধারী দলগুলির পায়ের নীচে কোনও জমি নেই, যেখানে যেটুকু জমি ছিল তারও অধিকাংশই তারা হারিয়ে ফেলেছে এবং সে জমি খুঁজে পাওয়ার কোনও প্রত্যাশাও নির্মাণ করতে পারছে না। বস্তুত, বামপন্থী দলগুলির দুর্বলতা এমন একটি স্তরে পৌঁছেছে যে তাদের নিয়ে আলোচনাও স্তব্ধপ্রায়। কেরালা বহু বিষয়েই ব্যতিক্রম, আজও ব্যতিক্রম, এবং আজ সেই ব্যতিক্রমকে কতটা তার বামপন্থী চরিত্র দিয়ে নির্দিষ্ট করা যায় আর কতটা দক্ষিণ ভারতীয় আঞ্চলিকতা দিয়ে, তা নিয়েও আলোচনার অবকাশ আছে। ত্রিপুরা নানা অর্থেই প্রান্তবর্তী। বাকি রইল পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে বামপন্থী দলগুলির বহুচর্চিত অভিজ্ঞতা কেবল শোচনীয় নয়, এই অভিজ্ঞতাই এক অর্থে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাদের ব্যর্থতার কারণগুলিও অনেকাংশে বুঝিয়ে দেয়, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের দর্পণে বৃহত্তর দেশের পরিস্থিতিটিও বেশ কিছুটা বোঝা যেতে পারে।
এ রাজ্যে গত কয়েক মাসে শাসক দলের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আন্দোলন গড়েছেন প্রধানত বামপন্থী দলের নেতা ও কর্মীরাই। একদিকে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এবং অন্যদিকে বিচারব্যবস্থা, দুই মহলের তৎপরতা সেই আন্দোলনের প্রধান জীবনীশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। দুর্নীতি এবং অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই ধারাবাহিক প্রতিবাদের ফলে সমাজের অন্তত একটা অংশের মনে শাসকদের নৈতিক অধিকার যে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে সে-কথাও অস্বীকার করা চলে না। রাজ্য প্রশাসন এবং শাসক দল বামপন্থীদের এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে যে পরিমাণ বিষোদ্গার করেছে এবং সরাসরি ক্ষমতা প্রয়োগ করে আন্দোলন ভাঙতে চেষ্টা করেছে তাতে বোঝা যায়, তারা এই লাগাতার বিরোধিতা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই আন্দোলন রাজনীতিতে বামপন্থীদের শক্তি কতটা বাড়াতে পারবে এবং সেই বর্ধিত শক্তি কতটা গভীর হবে?
অধুনা এই প্রশ্নটিকে সচরাচর ভোটের অঙ্ক দিয়ে বিচার করা হয়। সেটা অযৌক্তিক নয়। ভোটের রাজনীতি বামপন্থীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, জনসমাজের কাছে তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা ভোটের ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। শাসকের প্রতি যাঁরা বিরূপ তাঁরা বিরোধীদের কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন, সেটা বাস্তব রাজনীতিতে অবশ্যই একটি বড় প্রশ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই গত এক দশকে রাজ্যের নির্বাচনী রাজনীতির বিরোধী পরিসরে বামপন্থীদের দুর্বলতা রীতিমতো প্রকট। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের উদ্যোগপর্বে তাঁদের প্রচারে কিছুটা উদ্যম দেখা গিয়েছিল, বিশেষত নবীন প্রজন্মের প্রার্থী ও প্রচারকদের ব্যাপক উপস্থিতি অনেকের মনে কিছুটা আশা জাগিয়েছিল, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার ফসল বিশেষ ওঠেনি। আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে অন্য রকম অভিজ্ঞতা হবে, এমন আশা খুব প্রবল নয়।
কেন নয়? প্রশ্নটা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, কারণ তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজ্যের আন্দোলনরত বামপন্থীদের চিন্তাভাবনা ও কার্যক্রমের সীমাবদ্ধতার প্রশ্ন। সীমাবদ্ধতা দু’দিক থেকে। প্রথমত, দুর্নীতি এবং দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জরুরি হলেও যথেষ্ট নয়, সেই প্রতিবাদে সীমিত থাকলে শাসকদের নীতি ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধী অবস্থান নেওয়ার দায়িত্ব অপূর্ণ থেকে যায়। অথচ বর্তমান শাসকদের বিরুদ্ধে তেমন অবস্থান নেওয়ার সুযোগ কম নেই, তার প্রয়োজনও বিস্তর। বিশেষ করে, রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি এবং সর্বজনীন উন্নয়নের প্রশ্নে, বুনিয়াদি শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নে তাঁরা কেবল ব্যর্থ নন, এ বিষয়ে সুচিন্তিত নীতি দূরস্থান, তাঁদের কোনও মাথাব্যথাই যে নেই সেটা এত দিনে সুস্পষ্ট— অতিমারিতে বিধ্বস্ত শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি পূরণের কোনও যথার্থ উদ্যোগ তাঁরা করেননি, উল্টে পাইকারি ভাবে এবং অনর্থক স্কুল বন্ধ রাখার আদেশ জারি করে তার পথ রোধ করেছেন, এমনকি নিজেদের উদ্যোগে কোথাও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন হলে তাতে নানা ভাবে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকার তথা শাসক দলের এই দিশাহারা এবং নেতিবাচক ভূমিকাটিকে জনসাধারণের কাছে তথ্য ও যুক্তি সহকারে তুলে ধরা বিরোধীদেরই কাজ। অথচ তার কোনও সুষ্ঠু উদ্যোগ আজও দেখা যায়নি।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির প্রশ্নটির গুরুত্ব নিয়ে কোনও সংশয় থাকতে পারে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের কত শতাংশ এই প্রশ্ন নিয়ে সত্যই বিচলিত? দেশের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়েই দুর্নীতি ক্রমশ সমাজ ও রাজনীতির ‘স্বাভাবিক’ অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সেটা উত্তরোত্তর সত্য হয়ে উঠেছে। বহু নাগরিকই মনে করেন, দুর্নীতি খারাপ, কিন্তু ও নিয়ে ভেবে খুব একটা লাভ নেই, কারণ ক্ষমতায় যে যায় সে-ই দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। এর পরেও নিশ্চয়ই পরিমাণগত তারতম্যের একটা প্রভাব থাকে, ক্ষমতাশালীদের ঘরে ঘরে কোটি কোটি টাকার তোড়া আবিষ্কৃত হলে অতি বড় শুভনাস্তিক মানুষও নড়েচড়ে বসেন। কিন্তু, সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা সাক্ষী আছে, সেই বিচলনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না, যাঁরা দুর্নীতির ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদের বা তাঁদের স্বজনবান্ধবদের বাদ দিলে বৃহত্তর জনসমষ্টি অতিকায় দুর্নীতি নিয়েও বেশি দিন বিচলিত থাকেন এমন কোনও লক্ষ্যণ দেখা যাচ্ছে না। এখানেই গভীরতর সত্যটির দিকে দৃষ্টিপাত করা দরকার। শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতিতে যাঁদের ক্ষতি হয়েছে কিংবা যাঁদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাঁরা অনুপাতের বিচারে সমাজের অতি ক্ষুদ্র অংশ। বাকিদের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে মাথা ঘামানোর বিশেষ কোনও কারণই নেই, তাঁরা বা তাঁদের ঘরের ছেলেমেয়েরা কোনও দিন সেই নিয়োগের প্রতিযোগিতায় নামতেই পারবেন না। এই পরিস্থিতিতে তাঁরা, সেই বৃহত্তর জনসমাজ তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, কেন এই বিষয়ে বড় রকমের উদ্বেগ বা দীর্ঘমেয়াদি ক্রোধে তাড়িত হবেন? স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, নিছক আদর্শচ্যুতির কারণে? বুঝ লোক যে জান সন্ধান।
একটা পাল্টা প্রশ্ন উঠতে পারে। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সমস্যা যেখানে পৌঁছেছে, তার ফলে শিক্ষার আয়োজনটাই তো বিপন্ন। কেবল দুর্নীতি নয়, সামগ্রিক ভাবেই শিক্ষকের ঘাটতি একটা বিপুল আকার ধারণ করেছে। তার কুফল তো সাধারণ মানুষকেই প্রভূত পরিমাণে ভুগতে হচ্ছে। তাঁদের সন্তানসন্ততির লেখাপড়া এবং ভবিষ্যৎ ভয়ানক রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন। তা হলে তাঁরা কেন দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনে যথেষ্ট উদ্দীপ্ত হবেন না? কেন তাঁদের স্বার্থহানির আশঙ্কা ও ক্ষোভ প্রতিবাদী রাজনীতির একটা বড় শক্তি হয়ে উঠবে না? কেন তাঁরা সমবেত ক্ষোভে প্রবল স্বরে শাসকের কাছে দাবি জানাবেন না— শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার, সেই অধিকার হরণ করা চলবে না, লেখাপড়ার সুব্যবস্থা করতে হবে, সেটা সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব?
এখান থেকে একটা গভীরতর প্রশ্ন উঠে আসে। অধিকারবোধের প্রশ্ন। সেই বোধকে কেন্দ্র করে রাজনীতি গড়ে তোলার প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক পরিষেবার পর্যাপ্ত ও যথাযথ আয়োজন বহুকাল ধরেই নেই, আপাতদৃষ্টিতে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা হাসপাতাল-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা অনেকটা বেড়েছে বটে, কিন্তু পরিষেবার গুণমান ভয়াবহ, বিশেষত শিক্ষার ক্ষেত্রে। ফলে সুস্থ এবং সুষ্ঠু জীবনধারণের বুনিয়াদি অধিকার থেকে অগণন মানুষ বঞ্চিত। সেই অধিকারের দাবিতে কোনও সংগঠিত আন্দোলন নেই, এমনকি বিশেষ কোনও প্রতিবাদও শোনা যায় না। বামপন্থী দল বা গোষ্ঠীগুলির প্রচারে এই অভাব-অভিযোগের কথা থাকে বটে, কিন্তু বাঁধা গতে, ফাটা রেকর্ডের মতো সেগুলি বাজানো হয়। ‘চোর ধরো জেল ভরো’ যে মাত্রায় প্রচারিত, ‘স্কুল চালাও চিকিৎসা করো’ তার তুলনায় কিছুই নয়। এই অভাব কি বামপন্থী রাজনীতির দুর্বলতার একটা বড় কারণ নয়? বলা হতে পারে— সাধারণ মানুষ যখন নিজেদের সন্তানের শিক্ষার দৈন্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না, মাসের পর মাস স্কুল বন্ধ থাকলেও, অথবা স্কুলে শিক্ষক না থাকলেও, কিংবা বিরাট এলাকা জুড়ে স্কুলে বিজ্ঞান পড়ানোর ব্যবস্থা না থাকলেও তা নিয়ে অভিযোগ করছেন না, তখন বিরোধী দলই বা তা নিয়ে শোরগোল তুলবে কেন? এমন যুক্তি আর যেখানেই চলুক, বামপন্থী রাজনীতির পরিসরে নিশ্চয়ই চলতে পারে না। সেই রাজনীতির অনুশীলনের অন্যতম প্রধান শর্তই তো জনচেতনা জাগ্রত করা। শিক্ষার দুরবস্থা যে শ্রমজীবী মানুষের ভবিষ্যতের পক্ষে সর্বনাশা, সেই চেতনা জাগ্রত করা এবং তার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা কি বামপন্থীদের কাজ নয়?বস্তুত, সাধারণ মানুষ সন্তানের শিক্ষার প্রয়োজন বোঝেন না, এমন কথা একেবারেই ঠিক নয়। সেই আশির দশক থেকে বহু সমীক্ষায় বারংবার একটা কথাই উঠে এসেছে, দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়েও ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে চান। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে এই তাগিদের আরও একটা সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে— মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে তো বটেই, খুব গরিব ঘরেও প্রাইভেট টিউশনের প্রচলন অতিমাত্রায় প্রবল। অভিভাবকরা লেখাপড়ার মূল্য না বুঝলে এটা হতে পারত না। তা হলে তাঁরা কেন স্কুলগুলো ঠিকভাবে চালানোর দাবি তোলেন না? পশ্চিমবঙ্গে শতকরা আশি ভাগের বেশি শিক্ষার্থী এখনও সরকারি স্কুলে পড়ে, এবং তাদের প্রায় সকলেই মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়ে। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীদের একটা অংশের অভিভাবকরাও যদি স্কুলে ভাল করে লেখাপড়া শেখানোর দাবি তুলতেন, সরকার তথা রাজনৈতিক দলকে সেই দাবি পূরণে অন্তত কিছুটা তৎপর হতেই হতো, এইভাবে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাকে বানের জলে ভাসিয়ে দিয়ে তাঁরা পার পেতেন না। সেটা হয়নি কেন? তার কারণ অনুমান করা কঠিন নয়। সর্বজনীন শিক্ষার অধিকার আইনে স্বীকৃতি পেয়েছে, কিন্তু তার প্রকৃত অর্থ আমাদের রাজ্যে অধিকাংশ নাগরিকের অধরা থেকে গেছে। সর্বশিক্ষা যে একটা কথার কথা নয়, শুধু স্কুলে ছেলেমেয়েদের নাম লেখানো এবং নাম-কা-ওয়াস্তে পরীক্ষা আয়োজনের ব্যাপার নয়, তাদের লেখাপড়া শেখানোর সুবন্দোবস্ত করা যে সরকারের দায়িত্ব, এই ধারণাটাই জনচেতনার অঙ্গ হয়ে ওঠেনি। মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এটাই ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছেন যে স্কুল যেমন চলছে তেমনই চলবে, কোনও মাস্টারমশাই বা দিদিমণি নিজের আগ্রহে ভাল করে পড়ালে সৌভাগ্যের কথা, তা না হলে কিছু করার নেই, যার সামর্থ্য এবং সুযোগ আছে সে প্রাইভেট টিউটর রাখবে বা সন্তানকে কোচিংয়ে পাঠাবে, যার নেই তার কিছুই করার নেই।
ঠিক এখানেই প্রতিস্পর্ধী রাজনীতির, বিশেষত বামপন্থী রাজনীতির একটা বড় দায়িত্ব ছিল, মানুষের মনে অধিকারবোধ জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব, যা সে পালন করেনি। কীভাবে সেই বোধ জাগিয়ে তোলা সম্ভব? বাবাসাহেব আম্বেডকরের ভাষায় বললে, তার উত্তর: শিক্ষিত করো, আন্দোলন করো, সংগঠিত করো। আমাদের বামপন্থী রাজনীতির চালকরা আপাতদৃষ্টিতে এই পথই অনুসরণ করে থাকেন, কিন্তু তাঁদের চিন্তায় ও কাজে সচরাচর একটা মৌলিক ফাঁক থেকে যায়। তিনটি কাজকেই দেখা হয় পার্টি নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত কর্মসূচি হিসেবে— সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান পার্টি শ্রমজীবী মানুষকে শেখাবে, তাঁদের দলীয় পতাকাতলে সংগঠিত করবে এবং আন্দোলন গড়ে তুলবে, যে আন্দোলনে শ্রমজীবীরা দলে দলে যোগ দিয়ে সংখ্যার জোর দেবেন। এই পথ কোনও দিনই যথার্থ পথ ছিল না, এখন তা সম্পূর্ণত কানাগলিতে পরিণত হয়েছে। তার কারণ, মানুষ আজ আর ওপর থেকে নেতাদের বাণী শুনে নিজেদের অধিকারের ধারণা তৈরি করতে একেবারেই রাজি নন, তাঁরা নিজের নিজের জীবন-অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই সেই ধারণা তৈরি করতে চান এবং তৈরি করেন। সেই অভিজ্ঞতা তাঁদের জানিয়ে দিয়েছে যে সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থা নিজেদেরই সাধ্যমতো করতে হবে, সরকার সে-ব্যাপারে উদাসীন, বিরোধী রাজনৈতিক দলও তথৈবচ। এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন সাধন করতে হলে বামপন্থী দলগুলিকে অভিভাবক তথা নাগরিক সমাজকে ‘সঙ্গে নিয়ে’ শিক্ষার সুবন্দোবস্তের দাবিতে সংগঠিত আন্দোলনে নামতে হবে। সঙ্গে নিয়ে মানে পিছনে রেখে নয়, কেবলমাত্র পাশে রেখেও নয়, তাঁদের বাস্তব প্রয়োজনগুলিকে অনুধাবন করে, তাঁদের দৈনন্দিন সমস্যাগুলিকে বিশ্লেষণ করে এবং তাঁরা কী চাইছেন সেটা তাঁদের কাছে শুনে তবেই আন্দোলনের পথ ঠিক করা যাবে।
শ্রমজীবী মানুষের অধিকারবোধ জাগ্রত করার প্রশ্নটা তাঁদের সঙ্গে নিয়ে বিরোধী রাজনীতির পথ নির্ধারণের প্রশ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং দুটো প্রশ্ন পরস্পর গভীরভাবে জড়িত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনযাপনের নিরাপত্তা, এমন সমস্ত বিষয়ে ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি নির্মাণে সাধারণ নাগরিকদের ভূমিকাকে যত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে, সেই রাজনীতি তাঁদের বাস্তব প্রয়োজনগুলির প্রতি যত বেশি মনোযোগী হবে, তাঁদের প্রত্যয় ও আত্মমর্যাদাবোধ তত প্রবল হবে, তত বেশি করে তাঁরা নিজেদের চেতনায় প্রজা থেকে নাগরিক হয়ে উঠতে পারবেন। সেটাই তাঁদের অধিকারবোধ জাগ্রত হওয়ার শর্ত, আবার তার উপায়ও। এবং, নাগরকের অধিকারবোধ যত প্রখর হবে, তাঁদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি নির্মাণের পথও ততই প্রসারিত হবে। বামপন্থী রাজনীতি এই পথেই নিজেকে কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, শক্তিশালী করে তুলতে পারে। স্পষ্টতই, সেটা পরিশ্রমী অনুশীলনের মধ্যে দিয়েই সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গ হতে পারে সেই অনুশীলনের পথপ্রদর্শক।