বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
মুর্শিদাবাদের সাগরদীঘি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলাফল এরাজ্যে আপাতদৃষ্টিতে থিতু হয়ে আসা সমীকরণে একটা ধাক্কা দিয়েছে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কেন্দ্রে বাম–কংগ্রেস জোটের প্রার্থীর জয় নিয়ে তাই উদ্বিগ্ন শাসক তৃণমূল ও বিরোধীপক্ষের দাবিদার বিজেপি, উভয়েই।
এই ফলাফলের জেরে যে দুটি প্রশ্ন জোরালো ভাবে উঠে আসছে, তাহলে কি তৃণমূলের প্রতি সংখ্যালঘুদের সমর্থন ভাঙছে? এবং রাজ্যে বিকল্প শক্তি হিসাবে বিজেপির বদলে ফের বাম–কংগ্রেসকেই বেছে নিতে চলেছেন ভোটদাতারা? যদি এই দুইয়ের উত্তর হ্যাঁ হয়ে থাকে তাহলে তার কারণ বিশ্লেষণ করাও জরুরি। যদিও একটা বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে ওপরের দুটি প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। যদিও কী কী কারণে এমনটা ঘটল তা চিহ্নিত করাটা জরুরি।
এখানে দুটো প্রাসঙ্গিক তথ্যের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। ২০২১ সালে বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৭১ শতাংশ। সেবার বিজেপি পেয়েছিল ২১ শতাংশ ভোট, বাম–কংগ্রেস পেয়েছিল ৬ শতাংশ ভোট। ২০২২-এ ওই কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তৃণমূলের ভোট কমে হয় ৫১ শতাংশ, বিজেপিও কমে হয় ১৩ শতাংশ এবং সিপিএম প্রার্থীর ভোট বেড়ে হয় ৩০ শতাংশ। মানে তৃণমূলের ভোট কমেছিল ২০ শতাংশ, বিজেপির কমেছিল ৮ শতাংশ এবং বাম প্রার্থীর ভোট বেড়েছিল ২৪ শতাংশ। এর মানে তৃণমূল ও বিজেপির ভোট যতটা কমেছিল, তার বেশিরভাগ গিয়েছিল বামদের পক্ষে।
সাগরদীঘি কেন্দ্রে ২০২১ সালে তৃণমূল, বিজেপি ও বাম-কংগ্রেস জোটের ভোট ছিল যথাক্রমে ৫১, ২৪ ও ১৯ শতাংশ। ২০২৩ এর উপনির্বাচনে তিন দলের ভোট— তৃণমূল ৩৪.৯৪ শতাংশ, বিজেপি ১৩.৯৪ শতাংশ এবং বাম–কংগ্রেস জোট ৪৭.৩৫ শতাংশ। এর মানে, এবার তৃণমূলের ভোট কমেছে ১৬ শতাংশ, বিজেপির কমেছে ১০ শতাংশ এবং বাম–কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে ২৮ শতাংশ। মানে তৃণমূল ও বিজেপি দুদলের মোট ভোট ২৬ শতাংশ কমলেও জোটের ভোট বেড়েছে তার চেয়েও ২ শতাংশ বেশি। একটা উপনির্বাচনে কোনও পক্ষের ২৮ শতাংশ ভোট বৃদ্ধি সাধারণ ব্যাপার নয়।
এক বছরের কম সময়ের মধ্যে দুটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তৃণমূলের ভোট কমেছে। দুটি কেন্দ্রেই ভোট খুইয়ে দ্বিতীয় স্থান থেকে সরে গেছে বিজেপি। ভোট বাড়িয়ে বালিগঞ্জে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বামেরা এবং সাগরদীঘিতে প্রথম স্থানে চলে এসেছে বাম-কংগ্রেস জোট। খেয়াল করতে হবে যে দুটোই উপনির্বাচন। উপনির্বাচনে সাধারণত সমীকরণ বদলায় না, স্থিতাবস্থাই জারি থাকে। বালিগঞ্জ ও সাগরদীঘিতে হিসেবে ওলটপালট হয়েছে। ফলে পর্যবেক্ষকদের একাংশের মত, এই দুই কেন্দ্রের সংখ্যাতত্ত্বে হাওয়া ঘোরার একটা ইঙ্গিত রয়েছে।
২০১১ সাল থেকে সাগরদীঘি আসনে টানা জিতে আসছে তৃণমূল। তবে ২০২১ সাল বাদে বাকি দু’বার তৃণমূল জিতেছে চার থেকে পাঁচ হাজার ভোটে। ২০১৬ সালে তৃণমূল পেয়েছিল ২৬.২১ শতাংশ ভোট, আলাদা করে লড়ে সিপিএম ও কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছিলেন যথাক্রমে ২৩.০৩ এবং ২৩.১৩ শতাংশ ভোট। নির্দল প্রার্থী পেয়েছিলেন ১৮.৬৭ শতাংশ ভোট। সে বছর তৃণমূলের জয়ের পিছনে নির্দলের ভোট কাটারও ভূমিকা ছিল। এই কেন্দ্রে ২০১১ সালে কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ প্রার্থী পেয়েছিলেন ২২ হাজারের বেশি ভোট। ২০১৬র বিধানসভায় তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ পেয়েছিলেন ৩২ হাজার ভোট। সেবার সিপিএম ও কংগ্রেস আলাদা লড়ে এবং দু’ দলের প্রার্থীই ভোট পেয়েছিলেন ৩৯ হাজারের কিছু বেশি ভোট। এর মানে ২০১৬র ভোটে জোট হলে জয়ী হতেন বাম-কংগ্রেস প্রার্থী।
আবার ২০২১এর বিধানসভায় তৃণমূল প্রার্থী জিতেছিলেন ৫০ হাজার ভোটে। সেবার বাম-কংগ্রেস জোট হয়েছিল এবং প্রার্থী ছিল কংগ্রেসের। সেবার বিজেপি ও কংগ্রেস দিয়েছিল সংখ্যালঘু প্রার্থী। ২০২১-এ ২০১৬র তুলনায় বিজেপির ভোট বেড়েছিল ২০ শতাংশ, কিন্তু কংগ্রেসের ভোট কমেছিল চার শতাংশ। এর মানে ২০২১ এ বিরোধী হিসেবে বিজেপিকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন এই কেন্দ্রের ভোটাররা। এবং জোট হলেও বাম ভোট কংগ্রেস প্রার্থীর পক্ষে পড়েনি। অর্থাৎ নীচুতলায় বাম কর্মী-সমর্থকেরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়া নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। বিজেপির আগ্রাসী প্রচারের কারণে ২০২১এর ভোটে বিশেষ সুবিধা পেয়ে যায় তৃণমূল। যদিও বিজেপির ভোট ২০২১ এও বেড়েছে। ২০২১ এ সাগরদীঘিতে বাম-কংগ্রেস জোটের কং প্রার্থী ১৯ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিলেন।
২০২৩ এর ভোটের বৈশিষ্ট্য হল এবারে মূল লড়াইটা সরাসরি হয়েছে তিন রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে। তিন পক্ষের মোট প্রাপ্ত ভোট ৯৬ শতাংশ। অর্থাৎ নির্দল বা বিক্ষুব্ধরা এবার এই কেন্দ্রে কোনও দাগ কাটতে পারেনি। এর মানে, রাজ্যের তিন মূল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লড়াইয়ে আগের তিনটি বিধানসভার ফল উল্টে দিয়ে বাম-কংগ্রেস জোট একেবারে প্রথমে উঠে এসেছে। এটা নিঃসন্দেহে সাগরদীঘির ক্ষেত্রে টেকটনিক শিফট। দ্বিতীয়ত, এবার বাম বা কংগ্রেসের কোনও বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল না যার ফলে বাম-কংগ্রেস জোটের ভোট কাটাকাটি হয়নি। তৃতীয়ত, এর আগে জোট নিয়ে বাম ও কংগ্রেস শিবিরের মধ্যে নানা সংশয় ছিল। এক পক্ষের ভোট জোটের অন্য দলের প্রার্থীদের পক্ষে যাচ্ছে কিনা তা ছিল অস্পষ্ট। কিন্তু এবারের ভোটে যা অত্যন্ত স্পষ্ট তা হল, ভোট ট্রান্সফার নিয়ে জোটের দুই তরফের সমর্থকদের মধ্যে অস্পষ্টতা নেই। অর্থাৎ, সাগরদীঘি উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাম ও কংগ্রেস শুধু রাজ্যের ওপরতলায় নয়, মাঝারি স্তরে ও নীচুতলাতেও দু’পক্ষের কর্মী-সমর্থকেরা হাত মিলিয়েছেন এবং নিজেদের ভোট নিজেরা দিতে মরিয়া হয়ে ছিলেন। ফলাফলে তাই ম্যাজিক তৈরি হয়েছে। এবারের উপনির্বাচনে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।
বিজেপিকে ঠেকানোর জন্য বামেদের কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে হবে— এই রাজনৈতিক ভাবনা যত বেশি নীচুতলায় শিকড় চারিয়ে যাবে ততো বেশি ভোটের ফলে ম্যাজিক দেখার সম্ভাবনা। এই রকম পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘু ভোট আর সংখ্যালঘু ব্লক ভোট থাকে না, অন্য সব সাধারণ ভোটের মতোই ভাগাভাগি হয়ে যায়। মানে, সংখ্যালঘু আইডেনটিন্টি ছাপিয়ে ভোটারের রাজনৈতিক সত্ত্বা সামনে চলে আসে। এটা যত বেশি হবে তত বেশি এরাজ্যে বিজেপির ভোট কমবে এবং বিরোধীপক্ষ হিসাবে সামনের সারিতে উঠে আসবে বাম-কংগ্রেস জোট। সাগরদিঘির ফলাফলে এই বিষয়টাই সম্ভবত শাসক তৃণমূলকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। এবং চিন্তায় ফেলেছে বিজেপি নেতাদেরও। সাধে কী বিজেপি নেতারা শহিদ মিনারের অনশন মঞ্চে ছুটে যাচ্ছেন আর ডিএর দাবিতে ধর্মঘটীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন? তাঁরাও বুঝেছেন এরাজ্যে শাসক বিরোধিতার মঞ্চ হয়ে উঠছে বাম-কংগ্রেস জোট আর পিছনে চলে যাচ্ছে বিজেপি।
এছাড়াও রয়েছে আরও দুটি বিষয়। গত কয়েক বছরে সাধারণ ভোটারদের হাতে নগদ টাকা ও সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া এবং দুয়ারে সরকার কর্মসূচির মাধ্যমে নানা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি চালিয়ে গেছে তৃণমূল সরকার। সেই সুবিধা পেয়েছেন সাগরদীঘির ভোটাররাও। এবং তারপরেও তাঁরা শাসক দলের প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছেন। কোথাও একটা বিকল্প রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর প্রবণতা ছাড়া ভোটরাদের আচরণ এমন হতে পারে কি। কীসের জন্য ভোটাররা এমন শাসক বিরোধী অবস্থানে পৌঁছলেন তা চর্চার সুযোগ আছে।
গত কয়েক মাস ধরে চাকরি প্রার্থীদের আন্দোলন এবং আদালতের হস্তক্ষেপে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এসেছে। এতে জড়িত সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে জেলা ও স্থানীয় স্তরের নেতারা পর্যন্ত। অসৎ পথে অর্থ উপার্জনের বিষয়টি এখন সাধারণ মানুষ জেনে গেছেন এবং কীভাবে যোগ্য প্রার্থীরা চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তাও জনসমক্ষে এসেছে। এসব ঘটনা শাসকের ওপর অনাস্থা তৈরির জন্য যথেষ্ট। এর ওপর রয়েছে তোলা আদায়ের জন্য সর্বস্তরে শাসক দলের কর্মীদের চাপ এবং প্রতিবাদ করলে পুলিশি হেনস্থার ভয়। রাজ্যের একমাত্র বিরোধী বিধায়ককে দিনের পর দিন আটক রাখার ঘটনাও জনমানসে প্রভাব ফেলেছে। যেমন প্রভাব ফেলেছে যেন তেন প্রকারেণ পুরুলিয়ার কান্দু পুরসভা দখলে রাখার নির্লজ্জ প্রয়াস। এই সমস্ত ঘটনা পরম্পরা জনমানসে সরকারের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাগরদীঘির ভোটাররা এসবে কতদূর প্রভাবিত হয়েছেন তাও বোঝা দরকার।
সাগরদীঘির ফলাফল রাজ্যে হাওয়া বদলের ইঙ্গিত কিনা তা খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করা উচিত। তবে এটাও সত্যি যে, জন সমর্থনের ভিত যে সরেছে তা খানিকটা বুঝেছেন সরকার ও শাসক দলের মাথারাও। তাদের মাথা গরম করা প্রতিক্রিয়াও সেই কারণেই। যে হারে ধর্মীয় নেতাদের ব্যবহার করে সংখ্যালঘু ভোট ধরে রাখার জন্য তৎপরতা শুরু হয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে সাগরদীঘির ভোটারদের দেওয়া বার্তাটা ভালভাবেই পৌঁছেছে রাজ্যের শাসকদের কাছে।