বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

অপূরণীয় যে ক্ষতি

অপূরণীয় যে ক্ষতি

জিনাত রেহানা ইসলাম

photo

শ্রমজীবী ভাষা, ১ এপ্রিল, ২০২২— রামপুরহাট এখন ইতিহাসের পাতায়। সেখানে এক শাসক দলের নেতা তথা পঞ্চায়েত উপপ্রধানের হত্যা, এবং তার জেরে নারী-শিশু-সহ আটজনের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু, রাষ্ট্র আর নাগরিকের সম্পর্ক নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। আমরা মনে করি, রাষ্ট্র অভিভাবক। নাগরিক স্বজন। আর্তের চোখের জল মুছবে, আকুতিতে সাড়া দেওয়ার কথা রাষ্ট্রের —এইটি সহজ ও সরল হিসেব। কারণ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নিরাপদ আশ্রয় নাগরিকের একমাত্র ঠিকানা। সে সব বিশ্বাস বর্ণে বর্ণে ভুল হয়ে যায়, যখন নিজের ঘরে নিশুতি রাতে আগুন লাগে রাজনৈতিক ধ্বংসোন্মাদনায়। দেখা যায়, নাগরিককে রক্ষার প্রতিটি রাষ্ট্রীয় হাতিয়ার বিকল ও নিষ্ক্রিয়। ঘর তছনছ হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একটি গ্রাম, কিন্তু গোটা রাজ্যই মুহুর্তের মধ্যে বেসামাল।
তবুও ন্যায়ের প্রহরী হতে চায় মানুষ। রাষ্ট্রের চোখে যে নগণ্য, সে-ও আশ্চর্য নির্ভীক হয়ে সত্যকে প্রকাশ করে। যেমন রামপুরহাটের ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বলেছেন প্রাণে বেঁচে-যাওয়া পরিচারিকা। সরকারি ক্ষতিপূরণের ঘোষণাতেও সেই স্বর চাপা পড়ে না,  বারবার প্রকৃত বিচারের  দাবি রাখে। টাকা-চাকরি নয়, অপরাধীর শাস্তি। আগুনে পুড়ে- যাওয়া পরিবারের এক বাচ্চা মেয়ে মা-খালাকে মার খেতে দেখে নানাকে ফোন করে। হ্যাঁ, বাঁচানোর শেষ চেষ্টা। এই বেদনার জন্য যারা দায়ী, তারা ক্ষমার অযোগ্য। যে গলা তুলে খুনির শাস্তি দাবি করতে পারছে না, সে-ও ফিসফিসিয়ে প্রার্থনা করছে — দুষ্টের দমন হোক। রাষ্ট্র পক্ষপাতমুক্ত হোক। সরকার জনগণের হোক। প্রতিজ্ঞা নিক রাষ্ট্র – ‘নেভার এগেইন’। সরকার গণতন্ত্রের পাঠে শিক্ষিত হোক। রাজনীতি, প্রশাসন, উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় নরহত্যা কী করে এড়ানো যায়, তার আগাম প্রস্তুতির ম্যাপ তৈরি হোক।
তা হচ্ছে কোথায়? আমরা দেখলাম, স্বজনের ঘর পুড়ল। মহিলা-শিশু আগুন গায়ে ছটপট করল। রাষ্ট্রনিযুক্ত প্রহরীরা ঘুমন্ত। দেহ পুড়ে শেষ। তারপর শান্ত করার প্রকরণ শুরু। দহনলীলার প্রেক্ষাপট মর্মান্তিক। রাষ্ট্রীয় অবজ্ঞা ও অসতর্কতা আরও বেদনাদায়ক। একবিংশের বিশ্ব দেখায় রাষ্ট্র নিজের নাগরিকের বিরুদ্ধে কখনও সন্ত্রাস ব্যবহার করে, নইলে সমর্থন করে। যখন প্রাণে মেরে ফেলে না, তখনও ঘর-বাড়ি বিষয়-সম্পত্তি নষ্ট করার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। একবারে প্রাণে মেরে ফেলার চেয়ে এটি আরও মারাত্মক। হত্যার সাক্ষ্য দেওয়াও তখন ভয়ানক স্পর্ধা। কেন না, সুবিচার অর্জন কঠিন। আবার গণহত্যার নৃশংসতার অভিজ্ঞতা যে মেয়েদের হয়, তাদের অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত করার প্রক্রিয়াও খুব সীমিত। তাই এই বিষয়ে প্রতিরোধ, ও আগামী দিনের পরিকল্পনারও অভাব থেকে যায়।
তাই বগটুই গ্রামে ঘরের বাইরে থাকা সেই পোড়া বাড়ির একমাত্র জীবিত সদস্য, ওই পরিচারিকার স্বর শোনা জরুরি। বিচার চাইবার সাহস ও ক্ষমতাবানের পুরস্কার বা তিরস্কার উপেক্ষা করার সততাকে সম্মান করা দরকার। তাঁর বক্তব্য প্রমাণ ও তথ্যের হিসেবে প্রথম সারিতে থাকা জরুরি। এক শান্তিপূর্ণ ও সমন্বিত সমাজের প্রতিনিধিত্ব আগুন পেরিয়ে-আসা এই নারীটির করার কথা।
বগটুই গ্রামের কেবিলা বিবি এখন ‘বেওয়া’। স্বামী হারিয়েছেন। রাজনৈতিক হিংসার বৃত্তের বাইরে তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি। প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের পুলিশের সমালোচনা করছেন। স্বামী হত্যার পেছনে আখেরে নিজেদের কাছের ও দলের লোকেদের অভিযুক্ত করেছেন। নিজের মত জানাতে একটুও কুণ্ঠিত হননি। তাঁর সামনের অনিশ্চিত জীবনের হিসেব কষার সময় কারও নেই। ‘হত্যা’ হত্যাই। তাকে জাস্টিফাই করার জন্য কোনও রাজনীতি বা ষড়যন্ত্রের তত্ত্বই যথেষ্ট নয়। তার চেয়েও বড় কথা, সেই পরিবারের মহিলার আগামীর দিনের বিপর্যয় নিয়েও কোনও ভবিষ্যৎবাণী সহজ নয়। জ্বালিয়ে দেওয়া ও পুড়িয়ে দেওয়ার সংস্কৃতিকে হাতিয়ার করার সেই শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ প্রয়োজন। সিভিল সোসাইটির লাগাতার উচ্চকিত কন্ঠস্বরের অপেক্ষায় হয়তো কেবিলা বিবিরা। মাথার ছাদ ও জীবনসঙ্গী হারানো অনেকেই হয়ত ন্যায়বিচারের অপেক্ষায়।
ক্ষতিপূরণ এক সরকারি বাধ্যবাধকতা। আইন করে এটায় পরিবর্তন আনা দরকার। মৃত পরিবারের মানুষ দুই-পাঁচ-এক লক্ষ টাকা দিয়ে কী স্বপ্ন দেখতে পারে? চাকরি  দিয়ে স্বচ্ছলতা কেনা যায়। স্বস্তি কিছুতেই নয়। স্বজন হারানোর ক্ষতি কখনও টাকা দিয়ে পূরণ হয় না। ন্যায় বা জাস্টিস দিয়ে হয়। আর জাস্টিস কতজনকে জেল –হেফাজতে নেওয়া হল, তা দিয়েও ধার্য করা যায় না। ন্যায় নিশ্চিত করা যায় কেবলমাত্র জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ-রাজনৈতিক দল নির্বিচারে আইনের বিচার পাওয়ার অটুট বিশ্বাস নির্মাণের মধ্যে দিয়ে। রাতের অন্ধকারে এতগুলি নারী-শিশুর হত্যা হিসেব গুনতে গুনতে আবার স্পষ্ট হয় যে, নারী নিরাপদ নয়। নিজের ঘরে শুধু নয়, বাইরে থেকে দুদিন ঘুরতে এসেও নয়। মৃত্যু কখন কী ভাবে তাদের মাথায় এসে পড়বে তা বলা যায় না। স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও নিহত নারীদের প্রতি সামান্য সম্মান দেখাতে অপরাগ। মৃত্যুর কারণ হিসেবে উচ্চারিত তথ্য যে  সম্পূর্ণ মিথ্যা, তা দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই অবজ্ঞা অবিশ্বাসের ইট পেতে দেয়। ভোটের রাজনীতি যে কিছুতেই নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদার রক্ষা করতে পারেনি, সেই কথার পুনরাবৃত্তিই হয়।
গ্রাম বাংলার রাজনীতিতে অবিরাম প্রতারিত নারী। ঘরের টাকা, ভাতার টাকা পাওয়ার নামে তাদের সঙ্গে নানা ছলচাতুরি চলে, সে সব গল্প এখন সকলের জানা। তাদের ভোটটাও ভুল বুঝিয়ে আদায় করে নেওয়া হয়। শিক্ষা ও সিদ্ধান্তহীনতা তাদের ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় ক্ষমতার পেছনে। রাজ্যের ৪৯ শতাংশ মহিলা এই আলেয়ার পেছনে ছুটেই চলেছে। নেই চাকরি, নেই আনপেইড লেবারের খতিয়ান, নেই আত্মনির্ভর এক আর্থ-সামাজিক জীবন। এখন আবার প্রাণ বাঁচিয়ে রাখাও দায়! কখন অন্ধকার নেমে আসবে। হঠাৎ জানা যাবে, সদর দরজা শুধু ভেতর থেকে নয়, বাইরে থেকেও আটকানো। কেউ জ্বালিয়ে দেবে। কিংবা হয়তো কখনও মারতে ঢুকে পড়বে একদল উন্মত্ত। বিনা বিচারে বাস্তিল দুর্গে আটকে থাকার মতো, এক দিন সেখানেই অজানা কারণে মরে যেতে হবে। বেঁচে যাওয়া সদস্যকে উপহার দেওয়া হবে আগামীর একরাশ অন্ধকার ও দিশাহীন জীবন। আর সেই বেদনার বালুকাবেলায় এক সরকার আসবে, আর এক সরকার যাবে। গণতন্ত্রের এই আহ্নিক ও বার্ষিক গতির চক্করে বেচারা নারী-শিশুদের মৃত্যুর হিসেব দরকষাকষিতেই হারিয়ে যাবে। শূন্য শুধু মূল সংখ্যার আগে ও পরে হিসেব মতো যোগ হতে থাকবে। ঠিক কতজনের মৃত্যু দেখালে ন্যায়দন্ডের মুখরক্ষা হয়! ঠিক কত ক্ষতিপূরণ দিলে জনগণের ক্ষোভ কমে, সেটাই আসল অঙ্ক। এই হত্যা আসলে ক্ষমতার ইশারাকে ধিক্কার দেয়। প্রশাসন যন্ত্রে সিস্টেম অপারেট করার প্রকরণ মূর্খ অনুশীলন, তার মুখে কালি ছেটায়। সেই কালি কেবিলা বিবিদের হাতিয়ার হলে বগটুই-এর মতো গ্রামগুলি নিরাপদ। নইলে অশনিসংকেত মহিলাদের সম্মুখে জ্বলজ্বল করছে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.