বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
খুব বৃষ্টি হল এবার। কখনও একনাগাড়ে, কখনও দমকে-দমকে নেমে বেসামাল করে দিল জনজীবন। বানভাসি মানুষ, জলে আটকে পড়া যাত্রী, তছনছ হয়ে যাওয়া রাস্তা-সেতু, পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া বাড়িঘরের স্মৃতি রেখে গেল এবারের বর্ষা। শহর-গ্রাম মিলিয়ে মৃত্যুর সংখ্যাটাও নেহাৎ কম নয়। ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর (IMD) দেশের ৭৩৮টি জেলার মধ্যে ৭২৭টিতে বৃষ্টির হিসাব রাখে। সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখ অবধি মোট ২৬৯টি জেলায় স্বাভাবিকের থেকে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানাল তারা। এর মধ্যে ৮৫টি জেলায় বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের তুলনায় আরও ষাট শতাংশ বেশি। বাকি ১৬৪টিতে রেকর্ড হয় ২০ থেকে ৫৯ শতাংশ অতিরিক্ত বৃষ্টি। এইসব জেলার মধ্যে অধিকাংশ অবশ্য দেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত। রাজস্থানের মত রাজ্যও পড়ছে এর মধ্যে। তুলনায় শুকনো এলাকায় যদি এই অবস্থা হয় তাহলে অন্যান্য অংশের অবস্থাটা আন্দাজ করা যায় সহজে। অন্য একটা পরিসংখ্যানও আছে এক্ষেত্রে। সেটা সরবরাহ করেছে দিল্লীর সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যাণ্ড এনভায়রনমেন্ট। তাদের তথ্য অনুযায়ী জুন থেকে অগাস্ট, এই তিন মাসের প্রত্যেকটা দিনে দেশে চরম আবহাওয়ার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে কোথাও না কোথাও। অস্বাভাবিক বেশি বৃষ্টিপাত, বন্যা, এবং ভূমিধ্বসের খবর এসেছে প্রায় প্রতিটি দিনেই। মেঘভাঙা বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া দপ্তরের বক্তব্য ছিল যে আগের বছরের তুলনায় তেমন কোনও বৃদ্ধি হয় নি। অথচ এবারের বর্ষাতে চেন্নাই শহরে একই দিনে, ৩০ অগাস্ট, পাঁচ বার আলাদা-আলাদা মেঘভাঙা বৃষ্টির খবর পাওয়া গিয়েছে। যে ঘটনা সাধারণত ঘটে পার্বত্য অঞ্চলে, হিমালয়ে, পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় সেটা ঘটতে দেখা গেল সমুদ্রের কাছাকাছি সমতল এলাকায়।১
লেখার বাকি অংশ এই ধারায় এগোলে স্বস্তি বোধ করবে প্রশাসন, বিপর্যয়ের দোষটা যে পুরোপুরিভাবে খামখেয়ালি বর্ষার তাতে কোনও সন্দেহ থাকবে না। অন্যান্য জায়গার মতো কলকাতা শহরের হাল তো একইরকম! সেখানে লাগামছাড়া বর্ষা না হলে তো ঘটত না প্রাণহানি, সম্পত্তিহানি। অতএব দোষী খোঁজার জন্য ওই উপরে, আকাশের দিকে তাকানোটাই শিষ্ট নাগরিকের কর্তব্য। বেশ। এবারে অন্য একটা পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। ১৯৯২ থেকে ২০২১, এই তিরিশ বছরে কলকাতা শহরে পরিবর্তন ঘটেছে অনেক। মাথা তুলেছে বহু অট্টালিকা, জন্ম নিয়েছে বহু শপিং মল, শহরে বাস করতে এসেছেন লক্ষ-লক্ষ নতুন নাগরিক। বেড়েছে শহরের পরিধি, জলের ব্যবহার, জলের নিষ্কাশন। একইসঙ্গে আর একটা পরিবর্তন হয়েছে যা শহরের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতার পূর্বদিকে যে জলাভূমি রয়েছে, যার নাম ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যাণ্ডস, তার এলাকা কমেছে বেশ অনেকটা। ৬৫,৩০০ বর্গ কিলোমিটার থেকে হয়েছে ৪২,০০০ বর্গ কিলোমিটার। এই যে এক তৃতীয়াংশ জলাভূমি উধাও হয়ে যাওয়া তাতে শহরের ঠিক কী এল-গেল? অনেক কিছু। এই জলাভূমিতে উৎপন্ন মাছ আর শাকসব্জি পুষ্টি যোগায় শহরবাসীকে। বিপুল পরিমাণ মাছের সরবরাহ আসে এই এলাকা থেকে। অন্যদিকে পঞ্চাশ হাজার মেট্রিক টন শাকসব্জি কলকাতা পায় এই জলাভূমি অঞ্চল থেকে। এই উৎপাদনের প্রধান উপকরণ যে জল তা অবশ্য যায় কলকাতা থেকেই। পরিশুদ্ধ জল নয়, শহরের বর্জ্য জলের বড় অংশ রোজ বয়ে যায় পূর্বদিকের জলাভূমিতে। সেই ‘নোংরা’ জল থেকে দরকারি উপাদান নিংড়ে নেয় জলাভূমি। কলকাতার বিষ বুকে ধারণ করে কলকাতাকে ফিরিয়ে দেয় পুষ্টি – এই হল ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যাণ্ডস। অন্যদিকে বর্ষার অতিরিক্ত জলও ঠাঁই পায় সেই জলাভূমিতে। সার কথা দাঁড়ায় – পূর্ব দিকের জলাভূমির অভাবে অভুক্ত থাকবে এবং ভেসে যাবে কলকাতা। বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি নেই এর মধ্যে। এসব সত্ত্বেও সাম্প্রতিকতম প্রশাসনিক পরিকল্পনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই এলাকায় রিয়েল এস্টেট গড়ে তোলার তীব্র আকাঙ্খা।২ তিন দশকেরও বেশি সময় আগে, ১৯৯২ সালে, এখানে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার গড়ার সরকারি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল আদালতে। তাতে আটকে যায় নির্মাণ। রায় দিতে গিয়ে বিচারক সেদিন যে পর্যবেক্ষণ রেখেছিলেন সমাজের কাছে তার মধ্যে একটা কথা খুব চেনা হলেও প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, Nature will not tolerate us after a certain degree of its destruction and it will in any event, have its toll on the lives of the people …৩
পূর্ব কলকাতার জলাভূমি বোজানোর পালা তেমন সীমা পার করার ফলেই কি আজ কলকাতা অক্ষম হয়ে পড়ছে অতিবর্ষণের দাপট সামলাতে? জনজীবনের উপর সেই আঘাত, সেই toll on the lives of the people কি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে আজ? পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে তাতে এই বিপর্যয়ের আঘাত থেকে বাঁচা সহজ হবে না কারও পক্ষে। রিয়েল এস্টেট নির্মাণ যারা করে আর প্রকৃতির-কোলে-অ্যাপার্টমেন্টের লোভে ছুটে যায় যেসব ক্রেতা, তারাও কি বাঁচতে পারবে প্রকৃতির এই রোষ থেকে?
ভাঙছে পাহাড়, ভাঙছে মানুষ
সমতলে যা সত্যি তা একটু ভিন্নভাবে সত্যি উঁচু পাহাড়েও। গত সেপ্টেম্বর মাসে হিমালয়ের অরণ্য ছেদন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীর এবং পাঞ্জাবের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রচুর। পাঞ্জাবে এক-একটা গোটা গ্রাম ভেসে গিয়েছে জলের তোড়ে। এই সময় বিপুল পরিমাণ গাছের গুঁড়ি ভেসে যাওয়ার ছবি দেখে হিমালয়ের বৃক্ষচ্ছেদনের আন্দাজ পান বিচারপতিরা। এই দুর্দশা দেখে তাঁরা বলেন যে এমন চলতে থাকলে এক সময় কোনও অরণ্যই থাকবে না পাহাড়ে। মানুষের জীবন ও পরিবেশের বিনিময়ে উন্নয়ন চলতে পারে না। প্রশাসনিক ব্যর্থতা সম্পর্কে কড়া মন্তব্য শোনা যায় তাঁদের পর্যবেক্ষণে। বিপর্যয়ের ভয়াবহতা দেখে বিচারপতিদের একজন মন্তব্য করেন – এ হল প্রকৃতির প্রতিশোধ!৪
যে হিমালয়ে ইতিহাস তৈরি হয়েছিল গাছকে বাঁচানোর লড়াই ‘চিপকো আন্দোলন’ ঘিরে তার এই পরিণাম সত্যি দুঃখজনক। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার জুড়ে বনাঞ্চল ধংস হয়েছে নানারকম নির্মাণের জন্য। এর মধ্যে বাঁধ তথা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র অন্যতম। হিমাচল প্রদেশের কথাই ধরা যাক। হিমালয়ের কোলে থাকা রাজ্যগুলোর মধ্যে এখানেই সবথেকে বেশি জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। উত্তরাখণ্ড এবং জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসছে দ্রুত। এমনিতে বলা হয় যে পাহাড়ে বন্যা রুখতে কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। কিন্তু পোড় খাওয়া মানুষদের বক্তব্য, সেটা তখনই সম্ভব যখন বন্যা নিয়ন্ত্রণের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হয় বাঁধ। নদীর বিভিন্ন উচ্চতায় জলের প্রবাহ ও সঞ্চয় না-দেখে কেবল খুশিমত নির্মাণ করলে ত্বরান্বিত হয় বিপর্যয়। হিমালয়ে বাঁধ সম্পর্কিত তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয় না বলে অভিযোগ তাঁদের, সবটাই হয় গোপনে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁধ, সংযোগকারী রাস্তা, টাউনশিপ ইত্যাদি নির্মাণের সময় যে পরিমাণ কাদামাটি, বর্জ্য পদার্থ গিয়ে পড়ে নদীখাতে তার পরিমাণ বিপুল। এর ফলে নষ্ট হয় নদীর স্বাভাবিক জলধারণ ক্ষমতা। কী দাঁড়ায় মোটের উপর? একদিকে পঙ্গু নদী, অন্যদিকে অনিশ্চিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জলধারণ ক্ষমতা। সব মিলিয়ে অতিরিক্ত বর্ষণে জলকাদার মারাত্মক স্রোত সৃষ্টি হওয়া এবং তাতে মানুষের চাপা পড়া এক স্বাভাবিক পরিণতি। আগেভাগে উপযুক্ত সতর্কীকরণ ছাড়া বাঁধ থেকে ইচ্ছেমত জল ছাড়া মানুষের জন্য আর এক বিভীষিকা। ২০২৩ সালে হিমাচল প্রদেশের ২৩টার মধ্যে ২১টা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে ‘বাঁধ নিরাপত্তা আইন’ লঙ্ঘন করার কারণে নোটিশ পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন হিমাচল প্রদেশের মুখ্যসচিব। ২০২৫ সালে এসে পদক্ষেপ কড়া হয়েছে আর একটু, এবার রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এফআইআর দায়ের হয়েছে ভাকরা-বিয়াস ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের বিরুদ্ধে।৫
এমন নয় যে এসব জানেন না সচেতন নাগরিকরা। তবে উদ্বেগ আর আলোচনা দেখা দেয় কেবলমাত্র ভয়াবহ বিপর্যয়ের পরপর। তারপর ইস্যু মিলিয়ে যায় হাওয়ায়, উপাদান জমতে থাকে পরের বিপর্যয়ের জন্য। এ প্রক্রিয়ার শেষ কোথায়? গভীরভাবে ভাবলে আতঙ্ক ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প উপস্থিত হয় না সামনে। সেই আতঙ্কই ধ্বনিত হয়েছে শীর্ষ আদালতের বিচারকদের কন্ঠে – এভাবে চলতে থাকলে একদিন আসবে যখন গোটা হিমাচল প্রদেশটাই উবে যাবে মানচিত্র থেকে।৬ কথাটা হিমাচলের জন্য উচ্চারিত হলেও তার অনুরণন ছুঁয়ে যায় মেঘালয় থেকে উত্তরাখণ্ডকে, দার্জিলিং থেকে শ্রীনগরকে। q
তথ্যসূত্র:
১। Kiran Pandey, Rajit Sengupta, Clouds of Crisis, Down To Earth, 15 Sep 2025, Online edition
২। Bonani Kakkar and Pradeep Kakkar, A 30-Year Journey of the East Kolkata Wetlands – Degraded and Diminished, The Wire, 27 March 2024
৩। 1993(1) CLJ, People United for Better living v. State of W.B., Before Hon’ble Justice Mr. Umesh Chandra Banerjee, Decision: September 24, 1992
৪। Krishnadas Rajagopal, Supreme Court expresses concern over felling of trees in Himalayan forests, The Hindu online edition, September 04, 2025
৫। Himanshu Thakkar, 2025 Western Himalayan Floods: What can be done to reduce disastrous impacts? South Asia Network on Dams, Rivers and People, August 30, 2025, Online edition
৬। Shiwani Pandey, India needs to raise its voice against destructive projects in the Himalayas, Down To Earth, 17 Sep 2025, Online edition