বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ জুলাই, ২০২১— নারীর ক্ষমতায়নের কাজ শুরু হয়েছে বহু আগেই। মেয়েরাও সমস্ত প্রতিকূলতাকে হারিয়ে বিদ্যালয়ের বেঞ্চ থেকে সংসারের খরচ জোগাতে চৌকাঠ পেরিয়ে কাজে যোগদানের মাধ্যমে মেয়েদের স্বপ্নবিলাস নিয়ত প্রাণ পাচ্ছে। এই মহিলা মিছিলের অগ্রগতিতে বড়সড় আঘাত হেনেছে অতিমারি। সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতির সূচকে প্রায় দুই যুগের বেশি পিছনে হাঁটছে খতিয়ান। পরিসংখ্যান বলছে এই ছেদ সহজে মেটানোর নয়। টিকা পেয়েছেন কম, মারা গেছেন সংখ্যায় বেশি মহিলা, এমনটা শুধু নয়। বেঁচে থেকেও মিলেছে চূড়ান্ত অবহেলা-অবজ্ঞা। ঘরে–বাইরে চলে গেছে চাকরি, কমেছে মজুরি, ফেটেছে স্বামীর মারে পিঠ। যন্ত্রণা উপশমের একমাত্র উপায় আইনবিচার – পুলিশ কোথাও গিয়ে কড়া নাড়ার সুযোগটুকুও পায়নি। সোশ্যাল ডিসট্যান্স, ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স আখেরে মানসিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে – ঘরে স্থিতু করে দিয়েছে। শঙ্কিত জীবনকে আরও বিপর্যয়ের ভয় ভরে দিয়েছে নানা সংবাদ। মহিলাদের নিজস্ব অবস্থানগত চিরসংকটের সঙ্গে জুড়ে গেছে অতিমারির ধারাবাহিক ভয়াল ঢেউ। সংসার-কর্ম-ঘর একসঙ্গে ঝুঁকিতে পড়েছে। সবটাই টালমাটাল। আতঙ্কের স্বেচ্ছানির্বাসন কেড়েছে কন্ট্রাসেপ্টিভ ব্যবহারের সুযোগ, বেড়েছে অনির্ধারিত গর্ভধারণ। উত্তরোত্তর সংখ্যা হানা দিয়ে ঊর্ধ্বগতি করেছে চাইল্ড ম্যারেজের গ্রাফ, সমঝোতা হয়েছে গর্ভপাতে।
অতিমারি বদলে দিয়েছে সম্পর্ক। বদলে দিয়েছে ঠিকানা। বদলে দিয়েছে সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ। এই বদলে যাওয়া মুহুর্তের লেন্স দিয়ে পরিবারের মেরুদন্ড মহিলাদের দেখাটা একটু অন্যরকম। ভৌগলিক অবস্থা ও আর্থিক বিন্যাসের নিরিখে বদলের দাগটা চেহারা বদলায়। তারপরেও দিনের শেষে অভাবের বাতাসে গুমোট ঘর। অতিমারিতে মুর্শিদাবাদে ভুয়ো রুপশ্রীর দায়ে চিহ্নিত হল জেসমিনা। চুল ধরে প্রকাশ্যে মার খেল মহিলা প্রধান। মেয়ে কানে শুনতে পায় না বলে সাদা কাগজে সই করে তালাক হয়ে গেল তহমীনার। হাসপাতালে গিয়ে কানে মেশিন দিয়ে বাচ্চার কান্না শুনতে পেলে হাত–পা ছুড়ে কাঁদে মা। আহিনূরের আরব থেকে ফেরা স্বামী বোনের ঠিকানায় পাঠানো টাকা নিতে গিয়ে জানল, সে টাকা আহিনূর নাকি খরচ করেছে। আসলে আহিনূরের হাতে কোনও টাকা দেওয়াই হয়নি। বোনের প্রতারণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে আহিনূরের স্বামী। দুই বাচ্চা নিয়ে এখন দরজায় দরজায় ঘুরছে আহিনূর। একইরকম ঘটনা সাকিরার সঙ্গে। বিবাহিত ছিল স্বামী, সাকিরা জানতে পারে বিয়ের মাস দুয়েক পর। লকডাউনের মধ্যেই সাকিরাকে স্বামীর প্রথম স্ত্রী জানায় দশ লক্ষ টাকা দিলে সে তার স্বামীকে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে দেবে। নাজেহাল সাকিরা আদালতের দরজায় মাথা ঠেকিয়ে বসে। কোভিড ভাগ্যে তালা ঝুলিয়ে দেয়। মিঠুর লকডাউনে বিয়ে। রেজেষ্ট্রি হয়নি। শ্বশুরবাড়ি থেকে যাওয়ার পর আর ফিরতে দিল না স্বামীর পরিবার। প্রথমবার ঢোকার পর হাত ধরে বের করে দিল। দ্বিতীয়বার ৫৬ মিনিট বাড়ির দরজায় অপেক্ষা করার পর মিলল অনুমতি। সরিয়ে দেওয়া হল রান্নাঘরের গ্যাস। হাতে তুলে দেওয়া হল ঝাঁটা, খড়ির উনুন, বিড়ির বাঁধার উপকরণ। স্নাতোকোত্তর মিঠু আজও রেজেষ্ট্রির অপেক্ষায়। প্রতিদিন গালি গালাজ আর অপমানের ব্রেকফাস্ট। প্রতি ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার হুমকির মেনু দিয়ে রাতের ডিনার। ক্রন্দন আর বিলাপের সময় এই অতিমারি। হেরে ও হারিয়ে শুধু বিনাশের সিঁড়ি দিয়ে অবিরাম ওঠা-নামা।
কোভিড কেড়েছে কাজ। তবু ঘরে বসে না থাকার সাহস করেছে শুক্লা। সদ্য ওম্যান এন্ট্রাপ্রেনার শুক্লার চায়ের দোকান দিয়ে হাতে খড়ি লকডাউনে। বন্ধক রেখেছে কানের দুল। ধার নিতে হয়েছে দশ হাজার টাকা। চলছে দোকান। শোধ হচ্ছে না ধারের টাকা। ক্রেতা কম। বুটিক মালিক শতরূপার গতবছর পুজার সময় অ্যাসেট সেল হয়েছে। আবার আসতে চলেছে পুজো। আজও ঋণ শোধ করে সামলে ওঠা হয়নি। টেলার আরাধনার অর্ডার পাওয়া বন্ধ হয়েছে বহুদিন। বাড়ির সামনেই টেবিল পেতে নিয়ে বসেছে স্যানিটাইজার ও ডিম। চার হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে সারাদিন বসে জীবিকার সন্ধান। আশা-নিরাশায় চলছে দিন। শপিং মলের চঞ্চলার কাজটা আছে। মাইনে থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে ৩০ শতাংশ টাকা। বেকারি ব্যবসায়ি চন্দনার পাউরুটি-বিস্কুটের ভাটিতে থাকত নয় জন লোক। এখন কমে তা তিনজন। ঘরের সোনা বন্ধক। সংকট কাটার নাম নেই। অভিবাসী পুরুষ শ্রমিক প্লেনে করে কর্মক্ষেত্রে ফিরলেও মহিলাদের ফেরা হয়নি। আর্জিনা দিল্লি থেকে গ্রামে ফিরে এসে টেলারিং কাজ শিখেছে। কিন্তু দোকান আর খোলা হয়নি। ক্ষেতমজুর কাকলি শোরেন লকডাউনে কাজের ডাক পেয়েছে কম। গুজরাট থেকে ফেরার পর স্বামীই পাচ্ছে কাজের ডাক। কাকলীদের কাজ কেড়েছে ঘরের আপনজন। অর্থনৈতিক অবস্থা যত কঠিন হয়েছে মেয়েদের কাজে যোগদানের ব্যাপারে নিরুৎসাহ করা ততই বেড়েছে।নিরক্ষর-শিক্ষিত, গ্রাম-শহর ছবিতে খুব বেশি বদল হয়নি।
বিশ্বজুড়ে মহিলাদের নিরবচ্ছিন্ন বিপদ বাড়িয়েছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য পরিষেবার অনিশ্চয়তা, কর্মক্ষেত্রের হঠাৎ নীতিমালার পরিবর্তন ও মানসিক স্বাস্থ্য জনিত বিড়ম্বনা। মানসিক স্বাস্থ্য প্রভাবিত করেছে ১৮-২৫ বছরের মেয়েদের ৫০ শতাংশ। ২৬-৩২ বছরের ১১ শতাংশ। পোষ্ট প্যান্ডেমিক মেয়েদের ঘরের কাজের সময় বেড়েছে মেয়েদের ৫.৮২ ঘণ্টা। ৮৬ শতাংশ মহিলা পারিবারিক হিংসার জন্য সাহায্যের আবেদন করেননি, ৭৭ শতাংশ ঘটনার উল্লেখ করতে যাননি। শেষের দশ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে পারিবারিক হিংসার অভিযোগ। প্রি-প্যান্ডেমিক ওম্যান হেলথ ইন্ডেক্সে ১৫৫ র্যাংক ছিল ভারতের। তারপর পরিস্থিতি সামনে। কোভিডের টিকা নিয়ে প্রেগন্যান্ট ও পিরিয়ডকালীন মহিলাদের বিভ্রান্তির শেষ ছিল না। হেলথ কেয়ার সার্ভিস যে জেন্ডার নিউট্রাল নয় তা প্রমাণ করে এসব জটিল সংকট। কোভিড পজিটিভ মায়েদের লেবার, ডেলিভারি, ব্রেস্টফিডিং গাইডলাইন নানা জায়গায় নানা রকম। নিরাপদ গর্ভপাত, নবজাতকের যত্নের মতো স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ অধিকার থেকে বঞ্চিত মহিলারা। কাজ হারানো চাকুরিরত মহিলার মাত্র দুই শতাংশ সেলফ এমপ্লয়মেন্টের ব্যবস্থা করতে সমর্থ হয়েছেন। অস্থায়ী মাইনের (ডেইলি ওয়েজে) সঙ্গে যুক্ত ২১ শতাংশ মহিলা কাজ ফিরে না পেয়ে নিজেদের অন্য কাজে নিয়োজিত করেছেন। পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় সাতগুণ বেশি কাজ হারিয়েছে জীবিকায় যুক্ত মহিলারা। এবং একইভাবে পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় ১১ গুণের বেশি ফিরে পাননি পুরানো কাজ। লকডাউনের পরে অসংগঠিত ক্ষেত্রে ৭৯.২৩ শতাংশ মহিলা বেকার হয়ে পড়েছেন। লকডাউনের সময় মোট ৮৫ শতাংশ ডোমেস্টিক হেল্পার কর্মহীন হয়েছেন। তার মধ্যে মহিলা ৯০ শতাংশ। বিশ্বের সর্বত্র মহিলাদের বিষয়ে এক নিঃশব্দ অবহেলার স্রোত বইছে। আর তা প্রকট করেছে প্রি-কোভিড-পোষ্ট-কোভিড বার্তা।
ইন্দোনেশিয়া, মোজাম্বিক সহ নানা দেশে কন্ট্রাসেপ্টিভ বাজার থেকে উধাও হয়েছে। ইতালি সহ নানা দেশ গর্ভপাত বাতিল করেছে। লেবাননে অ্যাপার্ট্মেন্টে ব্লকের বাইরে ঝুলেছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের নোটিশ। তবুও কিছু দেশের নীতি নির্ধারকরা আশার আলো দেখিয়েছে। ইতালি বাড়িয়েছে ডোমেস্টিক অ্যাবিউজ হেল্পলাইন। বদলেছে ফার্মেসীর গোপনীয় বিজ্ঞপ্তির প্রোটোকল। অষ্ট্রেলিয়া অ্যান্টি ভায়োলেন্সের জন্য বাড়িয়েছে ফান্ড। কেনিয়া মহিলাদের দিয়েছে টেলিফোনিক সার্ভিস। পাকিস্থান বাড়িয়েছে মহিলাদের জন্য ক্যাশ ট্রান্সফার। আলজেরিয়া দিয়েছে পেইড লিভ মহিলাদের (প্রেগন্যান্সি, জটিল অসুখ, বাচ্চাদের যত্ন নেওয়ার জন্য)। ছোট্ট দেশ টোগো মহিলাদের জন্য বরাদ্দ করেছে ৫ ডলারের বেশি নগদ টাকা। কানাডা বাড়িয়েছে ন্যাশনাল চাইল্ড কেয়ার বেনিফিট। নিউজিল্যান্ড কাজের সপ্তাহ চারদিনে নামিয়ে আনার ঘোষণা করেছে – বেকারত্ব কমাতে ও ট্যুরিজিমের ব্যবসার মন্দা কাটাতে। কোভিড মহিলাদের আর্থিক দুর্দশা প্রকট করেছে। মহিলাদের প্রতি মানবিক হওয়ার দিকনির্দেশ করছে।
প্রি-পোষ্ট কোভিডে মহিলাদের অবস্থা কেন এত শোচনীয়? এই প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সরকাররের কাজের মধ্যেই খুঁজতে হবে। গর্ভস্থ কন্যা, ও সদ্য প্রসুত কন্যা সন্তানেরা পেল না যথযথ চিকিৎসা পরিষেবা। আলাদা কোনও কমিউনিটি পরিষেবার ব্যবস্থা হল না মায়েদের জন্য। মহিলাদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্যনীতির মডেল নিয়ে ভাবা হল না একটিবারও। বিদ্যালয় না যেতে পারা মেয়েদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল ঘরের কাজ ও বিড়ির কুলো। পরিবারের অভাবের কোপ এসে পড়ল মেয়েদের উপর। দিয়ে দেওয়া হতে থাকল নাবালিকা মেয়ের বিয়ে। সিঙ্গল মাদারদের কাজের অভাবে দেওয়া হল না মেয়ের প্রাইভেট টিউশনির পয়সা। করা হল না মেয়েদের অনলাইন ক্লাস। বাড়ির বয়স্ক ও বিধবাদের কাছে থাকা জমানো টাকা ডিমোনিটাইজেশনের সময় বেহাত হয়েছে। তারাও নিঃস্ব। পরিবারে পড়াশুনা করা মেয়েদের টাকার জোগান দিতে তারাও অসমর্থ হল। মহিলাদের অভাব ও পরনির্ভরতার এক করুণ বাস্তবতা সামনে নিয়ে এল এই ভাইরাসের যুগ।
থ্রি এস এর জন্য লড়েছে মহিলা বিশ্ব। মহিলারা চায় সেফটি, সেল্টার, সিকিউরিটি। নিরাপদ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার চায়। আশ্রয় চায় সময়মত সরকারি বিচার ও আইনি ব্যবস্থার। সিকিউরিটি চায় জীবিকার। কোভিড চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মহিলাদের প্রতি বৈষম্যের রেখাটিকে। সযত্নে তা লালিত না হয়ে বিশ্ব থেকে দূর হোক এটাই কাম্য। মহিলাদের শক্তি ও সামর্থ্যর কথাগুলো লেখা হোক। লোরি সোকলের ‘সি ইজ মি- হাউ ওম্যান উইল সেভ দ্য অয়ার্ল্ড’ বার বার চর্চা করুক মহিলাদের লড়াকু জীবনের বৈচিত্রের কথা। গ্লোবাল থেকে ইন্ডিভিজুয়াল ভিশনটা স্পষ্ট হয়ে উঠুক। আলিয়া হামিদ রাওয়ের ‘দ্য ক্রাঞ্চ টাইম’ ঠিক একই ভাবে মেয়েদের বেকারত্বকে একটি জরুরি বিষয় না ভেবে অপশনাল হিসেবে দেখানোর যে সমাজ ভাবনা সেটি তুলে ধরেছেন এই কোভিডের কালে। বেকারত্বের লিঙ্গায়িত ভাবনা পরিবার-বিবাহ এই বন্ধনগুলির ভাঙনকে প্রভাবিত করে। আর সেই ভাবনার বীজ কোভিড দশায় কখনও সুপ্ত কখনও প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। ভাইরাসের দিন মুছে যাক। মুছে যাক মহিলাদের দুর্দশার দিনও। রাষ্ট্র মহিলাদের প্রতি সহনশীলতা ও ইনক্লুসিভ অভ্যাগমনের দিকে নিজেদের বেশি করে প্রস্তুত করুক। কোভিড মুক্ত পৃথিবী মহিলাদের প্রতি সমান্তরাল অন্তরঙ্গতা স্থাপন করে এই বিশ্বের প্রতি আরও নমনীয় হয়ে উঠুক।