বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

চটশিল্প ও পাল্টে যাওয়া শহর কথা

চটশিল্প ও পাল্টে যাওয়া শহর কথা

বঙ্কিম দত্ত

photo

প্রাকৃতিক তন্তুর কয়েকটি পরিচিত নাম পাট, পশম, রেশম ইত্যাদি। চট প্রাকৃতিক তন্তুগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সস্তা। বিশ্বে তন্তু উৎপাদনে পাট, তুলার পরে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ভারত, বাংলাদেশ, চীন এবং থাইল্যান্ড পাট উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশ। এছাড়াও এটি দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া এবং ব্রাজিলে উৎপাদিত হয়। পাট ‘কোষ্টা’, ‘নলিতা’, ‘বিমলি’ বা ‘মেস্তা’ (কেনাফ) নামেও পরিচিত। প্রাকৃতিক তন্তুর মধ্যে পাটের অনেক অন্তর্নিহিত সুবিধা রয়েছে যেমন এর উজ্জ্বলতা। তাই একে সোনালী তন্তু (গোল্ডেন ফাইবার) বলা হয়। পাটের তন্তুর ভারবহন ক্ষমতা যথেষ্ট। চটের ব্যাগ নিয়ে বাজার করার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তা তারা সহজেই বোঝেন। দীর্ঘ দৈর্ঘ্যের হওয়ায় পাট তন্তুর বাণিজ্যিক মূল্যও যথেষ্ট। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে পাট জৈব-বিয়োজ্য (বায়োডিগ্রেডেবল) এবং তাই পরিবেশ-বান্ধব তন্তু। কৃত্রিম (সিন্থেটিক) তন্তুর চেয়ে পাট ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়ার অন্যতম বিশেষ কারণ এই যে ব্যবহার শেষে পাট নির্মিত দ্রব্যগুলো অল্পদিনের মধ্যে প্রকৃতিতে রাসায়নিক উপাদানগুলো ফিরিয়ে দিয়ে পরিবেশ রক্ষা করে এবং বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য বজায় রাখে। সংশ্লষিত তন্তুর (সিন্থেটিক ফাইবার) কয়েকটির নাম রেয়ন, নাইলন, পলিয়েস্টার। তুলনায় সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত কৃত্রিম তন্তুগুলো প্রয়োজন শেষ হবার পর জৈব-বিয়োজিত হতে কত’শো বছর লাগতে পারে তা অজানা কারণ প্রকৃতিতে এদের কৃত্রিমভাবে যুক্ত করার পর একটা শতকই সবেমাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে। অর্থাৎ এইসব তন্তুর মূল রাসায়নিকগুলো প্রকৃতি থেকে আহরিত হবার পর তা ফিরে যায় না প্রকৃতিতে। বিশ্বযুদ্ধ, প্রধানত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পেট্রোলকে সামরিক জ্বালানীর উৎস হিসাবে ব্যবহারে আটকে না রেখে পণ্য উৎপাদনের কাজে নিয়ে আসা হয় পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রয়োজনে। ডলার আর পেট্রোলিয়ামের সেই গাঁটছড়া এখন ফাঁস হয়ে চেপে বসেছে পরিবেশের গলায়, নানা দেশের অর্থনীতিতে। ফলে জীবনদায়ী প্রাকৃতিক-চক্রগুলো বিপর্যস্ত হচ্ছে, পরিবেশ এমনভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে যে জীবন-মৃত্যুর ভেদরেখাটা বিলীন হয়ে জীবন্মৃত অবস্থায় দিন কাটানোর কঠিন বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এপথেই জীবন্মৃত অবস্থায় ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছেন পাট চাষী ও চটকলের শ্রমিকরা। পাট চাষ থেকে সরে যাচ্ছে পাট চাষীরা, চটমিলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া ও মিলগুলোর রুগ্নতার কারণে কাজ হারাচ্ছেন অথবা অত্যন্ত কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন চটকল শ্রমিকরা। অবস্থার এই ত্রিশঙ্কু চাপে প্রাণ সবচেয়ে বেশি যায়যায় অবস্থা যাদের তারা হচ্ছেন শ্রমজীবী মানুষ। আপাতত মৃতপ্রায় শিল্পাঞ্চলের বন্ধ ও রুগ্ন কারখানার সামনে দাঁড়িয়ে ফিরে দেখা যাক।
বন্দেমাতরম খ্যাত নৈহাটি গঙ্গার তীরে অবস্থিত একটি অঞ্চল যা রেললাইনের এপার-ওপারে বিভাজিত। জলপথকে পরিবহনের সহজ ও স্বল্পমূল্য উপায় হিসাবে নির্বাচনের মাধ্যমে নদীর দু’পাশে গড়ে ওঠে চটকল ও অন্যান্য বড় মিলগুলি। গড়ে ওঠে শিল্পাঞ্চল। স্বাধীনভারতের পতাকার নক্সা তখনও স্বপ্নের গর্ভে।
এই কয়েক দশক আগে পর্যন্ত চটকলের বাঁশির শব্দে বাঁধা ছিল এই অঞ্চলের কর্মতৎপরতা। নদীর নাব্যতাকে সঙ্গী করে ভেসে যেত স্টীমার, গাদাবোট। কারখানার টনটন পাটের তন্তু, বস্তা আর চট চলত দেশ-দেশান্তরে। ছিল কাগজ তৈরির মিল, রঙ তৈরির কারখানা, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, কনটেনার তৈরির কারখানা। স্বভাবতই ছিল বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি প্রয়োগের বিস্তীর্ণ সুযোগ। ম্যানুফাকচারিং শিল্পের অধীনে কর্মরত শ্রমিকের চিন্তাও ছিল অনেক আধুনিক। এক শেডের নীচে নানা ধর্মের শ্রমিকের সহযোগিতামূলক সম্পর্কের প্রতিফলন ছিল সমাজেও। ধর্মীয় পরিচয়ের থেকে শক্তিশালী ছিল শ্রমজীবী পরিচয়। ধর্ম ছিল অন্তরের ভিতরে। জীবন চলমান ছিল আপন আপন ছন্দে। থিয়েটার, যাত্রা, জলসা ছিল কারখানার সহযোগিতার ছন্দে আন্দোলিত। একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা, রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জন্মজয়ন্তী, আন্ডার হাইট ফুটবল টুর্নামেন্ট লেগেই থাকতো শিল্পাঞ্চলে। কুলি-লাইন থেকে একইসঙ্গে ভেসে আসতো রামা হো, আজানের সুর আর বসন্তে হোলি হ্যায়। প্রতিবেদকের বেড়ে ওঠা হুগলী নদীর পাড়ে চটকল অধ্যুষিত এই শিল্পাঞ্চলে। ঘরে ঘরে ছিল চটকলে কাজ করা মানুষজন। কেউ শ্রমিক, অনেকেই কর্মচারী। পড়াশুনায় অমনোযোগীকে অভিভাবক যেমন ‘পড়া ছাড়িয়ে চট কলে ঢুকিয়ে দেবো’ বলতেন, তেমনই উচ্চ বেতনের কারণে চটকলে ‘বাবু’ হিসাবে যুক্ত হয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছাড়তেও দেখা গেছে।
পাট ভিত্তিক শিল্প স্থাপনের অনুপ্রেরণা আসে স্কটল্যান্ডের ডান্ডি থেকে। ১৮৩৩-এ প্রথম তিমির তেলে ভিজিয়ে পাট কাটার যান্ত্রিক প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন একজন ডান্ডি ব্যবসায়ী টমাস নেইগ। ব্রিটিশ বণিকরা ১৮৪০ সাল থেকে ডান্ডির মিলের কাঁচামাল শন (একরকম ঘাস) প্রতিস্থাপনের জন্য বাংলা থেকে কাঁচা পাট রপ্তানি শুরু করে। যদিও এর আগে বাংলার পাট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ১৭ শতক থেকে ডাচ, ফরাসী এবং পরবর্তীতে অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের দ্বারা রপ্তানি করা শুরু হয়। ভারতে ব্রিটিশ লুন্ঠনের তখন যৌবনকাল। ১৮৮৫ সালে জর্জ অকল্যান্ড একজন বাঙালি অংশীদার (শ্যামসুন্দর সেন) নিয়ে কলকাতার হুগলি নদী তীরবর্তী রিষড়া নামক স্থানে প্রথম চটকল স্থাপন করেন। জমির ঊর্বরতার কারণে কাঁচা পাট উৎপাদনের একচেটিয়া এলাকা সম্পূর্ণ বাংলাজুড়ে হলেও অধিকাংশ পাট চাষ হতো প্রদেশের পূর্ব অংশে (বর্তমান বাংলাদেশে)। ১৯৪৫ সালে পাট চটচাষের এলাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি একরে। দেশে বিদেশে কাঁচাপাটের চাহিদা বৃদ্ধিই এর কারণ। দেশ-বিভাজন পশ্চিমবাংলার সামনে বিপদ এনে হাজির করে। ব্রিটিশরা এমনটাই চেয়েছিল। কাঁচামাল ওপারে, শিল্প এপারে। এটা ছিল এই বাঙলার চটশিল্পে বড়ো ধাক্কা। এসব উৎপাদন সমস্যা সামাল দিয়েও একরকম চলছিল। নয়া আর্থিক নীতি চটশিল্পের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিল। মালিকানা ততো দিনে পাটের বাজারের ফোড়েদের হাতে। শ্রমিকরা কন্ট্রাকরাজের অধীন। চুড়ান্ত শ্রমিক শোষণ আর লকআউট লেঅফ মালিকদের যথেচ্ছ ব্যবহারের হাতিয়ারে পরিণত হল। শ্রম আইনকে পকেটে রেখে পেনসন, গ্রাচ্যুইটি বঞ্চিত করে অবসরে বাধ্য করা হল শ্রমিক ও কর্মচারীদের। বন্ধ হয়ে গেল একদা রমরমিয়ে চলা চটকলগুলো। সিন্থেটিক ফাইবার লবিকে খুশি করতে খাদ্যদ্রব্য পাকেজিংয়ে চটের বস্তা ব্যবহারের বাধ্যতামূলক নীতি লঘু করলো দেশের সরকার। এক সময়ের সমৃদ্ধশালী শিল্প, বাংলার চটকলগুলিতে স্থায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা গত ১০ বছর ধরে ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বললেই জানা যায় যে স্থায়ী, স্পেশাল এবং অস্থায়ী শ্রমিকদের মধ্যে মিল মালিকেরা শুধুমাত্র অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগের দিকেই বেশি আগ্রহী। ভারতের জুট কমিশনের রেকর্ড অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত চটশিল্পে প্রায় ৪৬,৪৮৭ জন স্থায়ী শ্রমিক এবং ১,০৮,৪৬১ জন চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক কর্মরত ছিলেন। তবে, রেকর্ডের বাইরেও চটকলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত প্রায় ৩ লাখ মানুষ রয়েছেন। এদের মধ্যে প্রতি তিনজনের মধ্যে দু’জন চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন, যা শুধুমাত্র কাজ থাকলে ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা দেয়। চূড়ান্ত এই শ্রমিক শোষণ উপহার দিয়েছে ‘জিরো নাম্বার শ্রমিক’। তাদের কর্মসংস্থানের পরিচয় নম্বর কার্যত শূন্য, কারণ তারা চটকলের সঙ্গে নিবন্ধিত নয়। এ ধরনের শ্রমিকদের প্রায়ই এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে চটকলে পাঠানো হয়, যা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে থাকে। আগে ছিল ‘বদলি’। একজনের বদলে অন্যজনের শ্রম। এল চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক। পিএফ নেই, গ্রাচ্যুইটি নেই। কাজ বারো ঘন্টার, মজুরি ন্যূনতম মজুরির অনেকটাই নীচে। প্রায় সব চটকল শ্রমিকই বস্তিতে বাস করেন – যা থেকে তাদের বেতন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কিছু কিছু চটকলে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকরা দিনে মাত্র ২০০ টাকা পান, যা বাংলায় অদক্ষ শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির চেয়ে অনেক কম। আর সরকারি রেকর্ডে তাদের বেশিরভাগের নামই নেই। উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় প্রায় ৬০,০০০ চটকল শ্রমিক রয়েছেন। বিশাল চটকলগুলোর কাছেই রয়েছে শ্রমিকদের কলোনি, যেখানে প্রায় সবাই বসবাস করেন। প্রতিটি শ্রমিক কলোনিতে সাধারণত মাত্র একটি সাধারণ বাথরুম থাকে, তাও দরজা বা পর্দা ছাড়া। জনৈক শ্রমিক জানাচ্ছেন যে তাঁর কোয়ার্টারে ছেলেকে, দুই নাতিকে এবং পুত্রবধূকে নিয়ে বসবাস করেন। তাঁর বাড়ির দিকে যাওয়া সরু গলির দু’পাশে রয়েছে একই ধরনের ঠাসাঠাসি ছোট ঘরের সারি। একটি দুর্গন্ধযুক্ত নর্দমা গলিটিকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। দিনের বেলা এটি শিশুদের খেলার মাঠ, আর রাতে এটি হয়ে যায় একটি যৌথ টয়লেট। অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের তলায় চাপা পড়ে গেছে শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। জীবনের মানোন্নয়নের জন্য শ্রমিক আন্দোলনের চেয়ে কর্মচ্যুতি আটকানোকেই জীবন সংগ্রামের লক্ষ্য করতে বাধ্য হচ্ছেন শ্রমিকদের বড় অংশ। এই বাস্তবতা মেনে নেওয়া কষ্টকর কিন্তু তা নিষ্ঠুর সত্য। জীবনের এই ছন্দপতন নতুন ছন্দে ফিরতে সময় নেয়নি। শ্রমিক পরিবারের সবাই শ্রমিক। কেউ ডেলিভারী ম্যান, কেউ অন্যর বাড়ির পরিচারিকা, দোকান, শপিং মল বা আবাসনের প্রহরী ইত্যাদি। সবজি বিক্রেতা, বাস-লরির টায়ারের রাবার ছাড়িয়ে সূতো বার করা, ঠেলা চালানো ও দিনমজুর হিসাবে অন্যরাজ্যে চলে যাওয়াটা কেবল বন্ধ চটকলের শ্রমিক পরিবারের রোজনামচা নয়। মজুরির ক্রমহ্রাসের সঙ্গে সমঝোতা করেই এই রোজনামচায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে চালু মিলের জিরো শ্রমিকের পরিবারের সদস্যরা। কিছুটা আয় বাড়ে দিনভর পরিশ্রমের বিনিময়ে। সেই টাকার অঙ্কেই দিতে হয় বাড়ি ভাড়া, সন্তানের পড়াশুনার খরচ, কিনতে হয় রোগের ওষুধ। কোম্পানি কবেই এসবের দায় ঝেড়ে ফেলেছে, ধীরে ধীরে সরকারও হাটছে এপথেই। এত কিছুর মধ্যেই মাঝে মাঝে শ্রমিক মহল্লায় খবর হয় চটতন্তু গলায় জড়িয়ে ঝুলে পড়ার। শ্রমিক ও তার পরিবার জানে পাটের দড়ি মজবুত, সহজে ছিঁড়ে পরে না।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.