বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ এপ্রিল, ২০২২— প্রেস ক্লাবের সামনে ২৯ দিন, সল্টলেকের করুনাময়ীতে ১৮৭ দিন, আর গান্ধী মূর্তির পাদদেশে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ১৭৯ দিন। মোট ৩৯৫ দিন এসএসসি-র নবম-দ্বাদশের মেধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত প্রার্থীরা চাকরির দাবিতে অবস্থান বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন খোলা আকাশের নীচে এক নাগাড়ে। উচ্চ শিক্ষায় নিজেদের শিক্ষিত করে, চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে, মেধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েও স্বপ্নের চাকরি অধরাই থেকে গেছে তাদের কাছে। কঠোর পরিশ্রমের সুফলকে রক্ষা করা এবং ন্যায় বিচারের প্রত্যাশায় শরীর ও মনের তেজ নিঃশেষ করতে হচ্ছে ফুটপাত বসে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে আসা এক ঝাঁক তরুণ তরুণী ঘরবাড়ি, আত্মীয় পরিজন ছেড়ে পথের ধারে আশ্রয় নিয়েছে এক বছরের অধিক সময় ধরে। তাদের অপরাধ? নিষ্ঠা সহকারে পড়াশোনা করে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া?
সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে শিক্ষতার চাকরি পেতে গেলে কি ধরনের প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় তা সবার জানা। মেধা তালিকায় নিজের নাম নথিভুক্ত করার জন্য অনেক চরাই উৎরাই পার হতে হয়। শুধু মেধা নয়, পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় করে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয়। শিক্ষকতাকে শুধু পেশা হিসেবে নয়, ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে জীবন গড়ে তোলেন কোনও কোনও মেধাবী। যোগ্য হয়েও চাকরি নেই। অথচ অযোগ্যরা বহাল তবিয়তে চাকরি করছে। সৌজন্যে সরকারি আমলা মন্ত্রী। রাজ্যের স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) পরিচালিত শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থাপনাটাই গত এগারো বছরে দুর্নীতির পাঁকে ডুবে গেছে। মহামান্য আদালতের নির্দেশে গড়া তদন্ত কমিটি নিয়োগ দুর্নীতির যে তথ্য সামনে নিয়ে এসেছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিচারপতি আর কে বাগের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির ৬৩ পাতার রিপোর্ট বলছে, নির্বাচিত প্রার্থী তালিকা বাতিল করে নকল তালিকা তৈরি করেছিল স্কুল সার্ভিস কমিশন, যেখানে অকৃতকার্য প্রার্থীকে দেখানো হয়েছে কৃতকার্য হিসেবে। বিভিন্ন জোন থেকে আসা নির্বাচিত প্রার্থীর তালিকা লোপাট করা হয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিংহের তত্ত্বাবধানে। আর এই সংশোধিত তালিকার ভিত্তিতে পর্ষদ সভাপতি নিয়োগপত্র দিয়েছেন বলে অভিযোগ। এমন কি তথ্য প্রমাণ লোপাট করার জন্য ওএমআর সিট নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। এইভাবে অযোগ্যকে যোগ্যে রূপান্তরিত করার ইনাম হিসেবে বিপুল অর্থের লেনদেন হয়েছে বলে তদন্তকারী অফিসারদের অনুমান। নাম জড়িয়েছে তৎকালীন শিক্ষা দপ্তরের ভার প্রাপ্ত মন্ত্রীর। আদালতের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমোদন পেয়েছে সিবিআই। ডিভিশন বেঞ্চের বদান্যতায় আপাতত স্বস্তি পেয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু স্বস্তিতে নেই যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীরা। স্বস্তিতে নেই সরকারি স্কুলে পাঠরত শিক্ষার্থীর অবিভাবক থেকে শুরু করে শিক্ষা অনুরাগী সাধারণ নাগরিক।
অযোগ্য হয়েও দুর্নীতিকে আশ্রয় করে বিপুল পরিমাণ উৎকোচ দিয়ে শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনে যারা প্রবেশ করছেন সেই ‘শিক্ষক’রা তারা গোটা শিক্ষক সমাজের কলঙ্ক। পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির পাঁকে ডুবে যাওয়া শিক্ষক নিয়োগ শুধুমাত্র যোগ্য প্রার্থীর প্রতি অবিচার করেনি, সরকারি বিদ্যালয়ের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এমনিতে সরকারি ঔদ্যসীন্যে এবং পরিকল্পনার অভাবে সরকারি স্কুলগুলো নানান সমস্যায় জর্জরিত। ছাত্রসংখ্যা নিন্মমুখী। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। এমতাবস্থায় সরকারি সহযোগিতায় ভূয়ো শিক্ষকের আমদানি সরকারি বিদ্যালয়ের অস্তিত্বকে আরো নড়বড়ে করে তুলবে। সম্পন্ন ঘরের ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুলের প্রতি বিমুখতা আরো বাড়বে। সুযোগ বঞ্চিত ঘরের ছেলেমেয়ারা অন্য উপায় না পেয়ে এক রাশ অবজ্ঞা নিয়ে সরকারি বিদ্যালয়ে আসবে। এইভাবে সরকার পোষিত বিদ্যালয়গুলো সামাজিকভাবে দেউলিয়া হয়ে কোনও মতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে। আর ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠবে আরো বেসরকারি স্কুল। বাজার থেকে অন্যান্য পণ্যের মত শিক্ষা কেনার সামর্থ্য যার আছে সে শিক্ষা কিনবে। বাকিরা বাধ্য হয়ে সরকারি স্কুলে যাবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে অসাম্য আরো বাড়বে। নীল সাদা পোষাকের আড়ালে সেই অসাম্যকে আড়াল করা যাবে না। এখন প্রশ্ন হল, শিক্ষা ক্ষেত্রে এই অরাজকতা সৃষ্টির স্রষ্টা রাষ্ট্র শিক্ষা সম্পর্কে কোন মনোভাবকে জনমানসে চারিয়ে দিল? সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বিদ্যালয়গুলির পরিকাঠামোগত সমস্যার অন্ত নেই। শিক্ষকের ঘাটতি, অর্থের অভাব, মিড ডে মিলে প্রয়োজনের তুলনায় যৎসামান্য বরাদ্দ, গ্রামাঞ্চলের স্কুলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ না থাকা ইত্যাদি আরো হাজারও অসুবিধা রয়েছে। তার উপর, শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে চূড়ান্ত দুর্নীতি শিক্ষা সম্পর্কে সরকারের নেতিবাচক মনোভাব আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল। বই-খাতা, জামা- জুতো বিনা পয়সায় সরবরাহ করলেও তৃণমূল সরকার যে শিক্ষার মান উন্নয়নে এবং শিক্ষার প্রসারে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়, তা নিয়োগ কেলেঙ্কারি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। ভোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতার চশমা পরে শিক্ষা ক্ষেত্রকে দেখার অভ্যাস বন্ধ না করলে সরকারি স্কুলগুলি সর্ব শিক্ষা অভিযানের ব্যবস্থাপক হয়েই টিকে থাকবে। সমাজে অন্য কোনও গুরুত্ব তার থাকবে না।