বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে লেখাটা শুরু করা যাক। সম্ভবত ২০০৭ সাল। স্কুলে ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন। এবিটিএ-র প্রার্থী ছাড়া আর একজন মাস্টারমশাই নির্দল প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি কংগ্রেস কর্মী হিসেবে এলাকায় পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও নির্বিঘ্নে নমিনেশন জমা দিলেন। প্রচারও করলেন। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটও মিটল। ফলাফল বেরোনোর পর দেখা গেল তিনি মাত্র ৪টি ভোট পেয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে জয়ী হয়েছেন এবিটিএ-র প্রার্থীরা।
২০১২ সাল। একই স্কুলে ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন। তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থিত শিক্ষা সেলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হয়ে গেলেও এবিটিএ-র পক্ষ থেকে কোনও প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হচ্ছে না। ইউনিট সেক্রেটারির কাছে কারণ জানতে চাইলাম। তিনি বললেন যে, নির্বাচনে ওরা আমাদের প্রার্থী দিতে নিষেধ করেছে। জোর করে প্রার্থী দিলে হাত-পা ভেঙে দেবে বলে শাসিয়ে গেছে। আমি আর কোনও কথা বলার সাহস পেলাম না। নির্বাচনের দিন দেখলাম একদল বাহুবলী হাফ প্যান্ট, লুঙ্গি পরে স্টাফ রুমের বাইরে পায়চারি করছে। কারো মুখে কোনও কথা নেই। চারিদিকে থমথমে পরিবেশ। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শিক্ষা সেলের প্রার্থীরা জয়ী হল। এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উদাহরণ দিয়ে দাবি করছি না যে, বাম আমলে গণতন্ত্র চর্চায় কোনও বিকৃতি ছিল না। বামফ্রন্ট সরকারের আয়ু যত বেড়েছে ছাপ্পা ভোট, ধমকানো-চমকানো, পেশিশক্তির ব্যবহার ইত্যাদি অনৈতিক কাজ বেড়েছে।
২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআইএম বিরোধী সমস্ত ভোট মমতা ব্যানার্জির ঝুলিতে জমা হয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজ্যে ক্ষমতা দখল করলেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারলেন না। “বদলা নয়,বদল চাই” স্লোগানে মুখরিত বাংলা দেখল সিপিআইএমের পার্টি অফিস একে একে দখল হয়ে যেতে। গায়ের জোরে লাল পতাকা হটিয়ে সিপিআইএমের বদলে তৃণমূলের তেরঙ্গা উড়ল। কয়েক হাজার বাম কর্মীকে ঘর ছাড়া, গ্রাম ছাড়া করা হল। মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে আরো কয়েক হাজার বাম কর্মীকে জেলে বন্দি করা হল। ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার সমস্ত ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে ফেলা হল।
ক্ষমতায় আসার পর প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন। গায়ের জোরে লুট করা হল সাধারণ নাগরিকের ভোটাধিকার। বোমা-বন্দুক-তরোয়াল উঁচিয়ে গ্রামীণ বাংলাকে তটস্থ করে, জীবন ও রক্তের বিনিময়ে পঞ্চায়েত দখল করল তৃণমূল। গণতন্ত্রের পরিত্রাহি অবস্থা দেখে সেদিন বাংলার মানুষ আশাহত হলেও মমতা ব্যানার্জির উপর ভরসা রেখেছিলেন। কিন্তু সেই ভরসা আঘাতে আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল অচিরেই। সরকার অত্যন্ত সুচারুভাবে বাংলার মানুষের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিতে তৎপর হয়ে উঠল। এমন কি মানুষের বাক স্বাধীনতাও কেড়ে নেওয়া হল। অন্যের তৈরি একটি নিরীহ কার্টুন ফরওয়ার্ড করার অপরাধে অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে তুলে এনে জেলে বন্দি করা হয়। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের তানিয়া ভরদ্বাজ, বর্ধমানের শিলাদিত্য সেনের কথা নিশ্চয় আমাদের মনে আছে। প্রশ্ন করার অপরাধে বা ভিন্ন মত পোষণ করার জন্য তাদের গায়ে মাওবাদী তকমা সেঁটে দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করা হয়নি। বিপুল জনাদেশ পেয়ে ক্ষমতায় আসর পর রাজ্যের শাসক-শিরোমণির এহেন কাজকে আর যাই বলা হোক না কেন, গণতন্ত্রসুলভ কোনওভাবেই বলা যাবে না। গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল মানুষকে অত্যন্ত সাহসী হতে হয়। অন্যের মত শোনার, অনুধাবন করার মানসিকতা না থাকলে গণতন্ত্র চর্চা করার ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন করা যায় না।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্র চর্চার যেটুকু পরিসর অবশিষ্ট ছিল, এই সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর সেটুকুও কেড়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করল। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন এনে গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয়করণ করার লক্ষ্যে সরকারি এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কমিটির মাথায় বসিয়ে দিয়ে বিদ্যালয়গুলিতে আধিপত্য বিস্তার করা হল। শিক্ষক প্রতিনিধির সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে কমিটি নির্বাচনের অধিকার বিদ্যালয়ের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হল। বর্তমানে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিনিধির ইচ্ছাধীন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেতার লিখিত অনুমোদন ছাড়া স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন করা কোনওভাবেই সম্ভব নয়। এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ স্কুলে ম্যানেজিং কমিটি গঠন করা যাচ্ছে না। আর কমিটির মাথায় বসে থাকা শাসক দলের কৃপাধন্য রাজনৈতিক প্রতিনিধি স্কুলগুলিকে করে খাওয়ার জায়গা করে তুলেছে। এককথায় বিদ্যালয় পরিচালনায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা ধ্বংস করে দলীয় আধিপত্য কায়েম করা হল। একইভাবে পরিচালন সমিতির মাথায় শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কহীন রাজনৈতিক নেতাদের বসিয়ে দিয়ে কলেজগুলোর স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে।
তৃণমূল শাসনের প্রথম ভাগে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শাসক দলের তাণ্ডব— বোমা, গুলি, পুলিশকর্মী হত্যা সব কিছুই দেখা গেছে। অশান্তি এড়ানোর অজুহাতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিভিন্ন কলেজের ছাত্রছাত্রীরা লাগাতার দাবি জানাচ্ছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা দীর্ঘদিন অনশন চালিয়ে গেলেও সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে কলকাতা-যাদবপুর-প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলেছে বাম ছাত্র সংগঠনগুলি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ কার্যত তুলে দিয়ে ছাত্রদের গণতন্ত্র চর্চার প্রাথমিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার জন্য এই সরকার ভীষণ তৎপর। শুধু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, সরকারি অফিস আদালত থেকে শুরু করে অটো-বাস ইউনিয়নগুলো রাতারাতি দখল করে নেওয়া হয়। সরকারি দলের ইউনিয়ন ছাড়া অন্য কোনও শ্রমিক ইউনিয়নে নাম লেখালে কাজের কোনও সুযোগ পাওয়া যাবে না। সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। এমন কি বিরোধী দলের কর্মচারী ইউনিয়ন করার অপরাধে শ্রমজীবী মানুষকে গলা ধাক্কা থেকে শুরু করে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন সহ্য করাটা এ রাজ্যে দস্তুর হয়ে উঠেছে। শুধু কর্মচারী ইউনিয়ন নয়, জনগণের ভোটে নির্বাচিত বিরোধী দল পরিচালিত পঞ্চায়েত বা পৌরসভা ক্ষমতার জোরে দখল করে নেওয়ার চেষ্টা এ রাজ্যের শাসকদল নিরন্তর করে চলেছে। নির্বাচনে পরাজিত হয়েও ঝালদা পুরসভা দখলে রাখার জন্য যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা রাজ্যের শাসকদলের ঘটিয়ে চলেছে তা গণতন্ত্রের লজ্জা। বিরুদ্ধ মত বা স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর শোনার মত ন্যূনতম সহিষ্ণুতা রাজ্যের সরকারের নেই। শান্তিপূর্ণ অবস্থান-বিক্ষোভ-মিছিল করার অনুমতি এ রাজ্যে মেলে না। এই মুহূর্তে এই রাজ্যে ন্যায্য অধিকারের দাবিতে যতগুলি ধর্না-অবস্থান চলছে, তার প্রত্যেকটাই মহামান্য আদালতের অনুমতিক্রমে চলছে। মিটিং মিছিল করার অনুমতির জন্যে অন্য রাজনৈতিক দলকেও উচ্চ আদালতের কাছ থেকে অনুমোদন আনতে হয়। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত একটি সরকার মানুষের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের করার গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে সর্বত্র আধিপত্য বিস্তার করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সদর্পে।
গণতন্ত্র মানে শুধু রক্তপাতহীন নির্বাচন নয়। গণতন্ত্রের ব্যপ্তি ও গভীরতা সূদুরপ্রসারী। প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করার উপযুক্ত পরিসর সৃষ্টি করারই হল গণতন্ত্র চর্চার অনুকূল পরিবেশ। সব থেকে পশ্চাদপদ মানুষও নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার মত স্বক্ষমতা অর্জন করতে গণতন্ত্রের হাত ধরে। গণতন্ত্রের সেই পরিবেশ শুধু আমাদের রাজ্যে নয়, সমগ্র দেশেই ভীষণভাবে আক্রান্ত। সারা দেশে ও এই বাংলায় গণতন্ত্রের দাবি ক্রমেই সোচ্চার হচ্ছে।