বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
- মাসি, বেগুন কত করে দেবে?
- বেচতেছি তো দেড়শ করে, তুমি নিলে একটু কম করে দেবান। কতটা নেবা?
- দেড়শ! বলো কি গো! বেগুনের এতো দাম? তুমি অনেক বেশি বলছো।
- কি যে বলো বাবা, য্যামন দামে কিনি তেমন বেচি। সাড়ে চারশ টাকা পাল্লা কিনছি। এর কমে বেচলি কিছু থাকবে? ঝাঁঝালো কন্ঠে মাসি জবাব দেন।
লক্ষ্মী মাসি। মাঝ বয়সী। আঁটোসাঁটো গড়ন। পরনে সস্তা সাদা শাড়ি এবং গোলগাল মুখ দেখে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের “মাসিপিসি”র কথা কারো মনে পড়ে যেতেই পারে। বাজার থেকে কিছুটা দূরে বড় রাস্তার পাশে চট বিছিয়ে সবজি নিয়ে বসেন রোজ।
- তা জানি না। একশ করে হলে দু’শ-আড়াইশ নিতে পারি। দেবে তো দাও। নিচু হয়ে বেগুন বাছতে বাছতে আমি বলি।
- একশ কুড়ি টাকা করে কেনা পড়িছে। একশ টাকায় বেচলি, বাকিটা কি ঘর থেকি দেব বাবা? মাসির গলায় বিরক্তি।
- তাহলে আর কি করা যাবে। এই দুটো ওজন কর। আমি আর কথা বড়াই না।
- আমরা কি করব বাবা, বাজার তো আগুন। কোনও জিনিসে হাত দিয়ার উপায় আছে। অধ্ধেক জিনিসই কিনতি পারি না বাবা। আমার তো অল্প পুঁজির ব্যবসা। দু’এক রকম কিনতিই পয়সা শেষ হয়ে যায়। এতো দামে আনাজ কিনে কি লাভ করা যায়? দাঁড়িপাল্লায় বেগুন ওজন করতে করতে মাসি বলে।
- কোত্থেকে আসো তুমি? মালপত্র কেন কোত্থেকে?
- বারুইপুরের অনেক ভেতরে থাকি বাবা। রাত আড়াইটায় ঘুম থেকে উঠি। ফাস টেরেন ধরি। সবজি নিয়ে ভোর থাকতি থাকতি কলকাতায় আসি। কেনা-বেচা শেষ করি ফেরার টেরেন ধরতি ধরতি দুপুর পার হয়ি যায়। বাড়ি ফিরতি সেই বিকেল। নাকে মুখে কোনও রকমে দুটা গুঁজে আবার বেরতি হয়। বাড়ি বাড়ি ঘুরে শাক-সবজি জোগাড় করি। বাজার থেকেও কিছুটা কিনতি হয়। দাম- দস্তুর করে শাক-সবজি কিনে বাড়ি ফিরতি ফিরতি সন্ধ্যে পেরিয়ে যায়। নাতিডারে পাইভেট থেকে এনে, খেয়িদেয়ি শুতি শুতি নটা বেজি যায়। মাসি এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে যায়।
- তা, সারাদিন খেটেখুটে যা পাও, তাতে কি সংসার চলে?
- এতে কি সংসার চলে বাবা। তোমাকে বললি তো লিয়ে লেবে না। রাতদিন খেটি দু’শ-আড়াইশ থাকে। তা দিয়ে কি হয়? চেকারকেই দিতি হয় কুড়ি-পঁচিশ। এখানে বসার জন্য তোলা দিতি আরো তিরিশ। আটো ভাড়া কত বেড়ি গেছে। বাস ভাড়ার তো ঠিকঠিকানা নেই। যে যা পাচ্ছে নিচ্ছে। দিদি তো এদিকটা একটু দেখতে পারে।
- দিদি তো দেখছে। তোমাদের লক্ষ্মী ভান্ডার দিচ্ছে যে। পাও তো লক্ষ্মীর ভান্ডার? তাতে কিছু উপকার হয়?
- হ্যাঁ, লক্ষ্মীর ভান্ডারের এক হাজার টাকা পাই বটে। কিন্তু তাতে কি বা হয়? সারা মাস সবজি বেচে যেটুকুন পাই, তার সাথি হাজার টাকা যোগ করি কোনও মতে চলে সংসার। জিনিসের যা দাম। কোনও কিছুতে তো হাত দেওয়া যায় না। মাছ-মাংস তো পাতে পড়ে না। পিতিদিন ডাল ভাত জোটাতেই তো ঘাম ছুটি যায়। জানো তো বাবা, ছেলেটা আমার রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। ঝাড়খন্ডে না কোথায় থাকে। শুনিচি, ভাল রোজগার। কিন্তু এখানে এক পয়সা ঠেকায় না। বৌমা বলে সব টাকা নেশা করে উড়ি দেয়। ওর বাবাও জাত মাতাল। সংসারের কোনও খোঁজ রাখে না। মদ খেয়েই পড়ি থাকে সারাদিন। মাঝেমাঝে জোরজুলুম করি পয়সা নিয়ে যায়। না দিতি চাইলে মারধোরও করে। ছেলেও বাবার ধারা নেছে। বৌ-ছেলেকে দেখে না – আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ফুত্তি করে। তা বাবা, এরম অভাবের সংসারে লক্ষ্মীর ভান্ডারের হাজার টাকা কোথায় লাগে বলো তো দেখি?
প্রায় একই কথা বলেছেন আশাকর্মী ফতেমা বিবি (নাম পরির্তিত)। ডায়মন্ডহারবারের লাইনের একটি গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর মাস মাইনে (সাম্মানিক) ৪৫০ টাকা। ২৪ ঘণ্টা সজাগ থাকতে হয় — রাত-বিরেতে প্রসুতি মাকে নিয়ে হসপাতালে ছুটতে হয়। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে অসুখ-বিসুখের খবর রাখতে হয়। ভোটের আগে সরকার ৭৫০ টাকা বাড়িয়েছে। সারা মাস পরিশ্রম করে ফতেমা বিবি এখন হাতে পান ৫২৫০ টাকা। লক্ষ্মীর ভান্ডারের এক হাজার যোগ করে মোট ৬২৫০ টাকায় দুর্মূল্যের বাজারে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হয়। স্বামীর তেমন রোজগার নেই। লকডাউনে তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। স্বামীর ওষুধের টাকা জোগানো মুস্কিল হয়ে পড়ে। ছেলে দুটো কিছুটা পড়াশোনা করেছিল। কাজ পায়নি। ছোট ছেলেটা ট্রেনে করে দূরের গ্রামে গিয়ে মোবাইলের সিম বিক্রি করে। এরকম অভাবী সংসারের একজন গৃহকর্ত্রীকে লক্ষ্মীর ভান্ডারের হাজার টাকা কতটা সক্ষমতা দিতে পারে সে বিষয়টা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। অথচ একজন আশাকর্মী রাতদিন কঠোর পরিশ্রম করে গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পের সিংহভাগ দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে সামাল দেন। অন্যের ঘরে আশা জাগিয়ে রাখা যাদের কাজ, তারা যদি নিরাশায় ডুবে থাকে, তাহলে নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দ্যেশ কি সফলতা পায়।
লক্ষ্মীর ভান্ডারের হাজার টাকায় লক্ষ্মী মাসির বা ফতেমা বিবির জোড়াতালির সংসারে কিছুটা সুরাহা হয় ঠিকই। কিন্তু লক্ষ্মী মাসিদের জীবন যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে যায়। হাজার টাকার অনুদান ব্যাঙ্ক থেকে তুলে আনার আনন্দ লক্ষ্মী মাসিদের জীবনে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে এই টাকা কোন ফাঁক দিয়ে কখন যে গলে যায়, তা তারা টের পেলেও কিছুই করতে পারেন না। লক্ষ্মী মাসির লক্ষ্মী ভান্ডার চিরকাল শূণ্যই থেকে যায়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে প্রান্তিক পরিবারগুলির আর্থিক লেনদেন পুরুষ দ্বারা পরিচালিত হয়। কোন টাকা, কোন খাতে কিভাবে ব্যয় হবে, তা নির্ধারণের অধিকার যেন সংসারের পুরুষ সদস্যের। প্রান্তিক পরিবার কেন, অনেক স্বচ্ছল পরিবারের উপায়ক্ষম মহিলারাও অনেকে নিজের উপার্জিত অর্থ ব্যয়ের অধিকার পান না। পিতৃতন্ত্রে আকন্ঠ নিমজ্জিত, নারী-পুরুষের মধ্যে জমিন-আসমান ফারাক যে সমাজে বিদ্যমান — সেই সমাজের প্রান্তিক পরিবারের মহিলারা লক্ষ্মীর ভান্ডারে মতো প্রকল্পের টাকা পেয়ে, নিজের কাজে ব্যয় করে কিছুটা ভাল আছেন বলে, যারা অনুমান করেন, তারা বাস্তবকে মানতে চাইছেন না।
নগদ হস্তান্তর প্রকল্প ভোটের বাজারে আশু ফল দেয়। সেকারণেই কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্যের সরকারগুলি নানা ধরনের নগদ হস্তান্তর প্রকল্প চালু করেছে। এরাজ্যে লক্ষ্মীর ভান্ডার বা কন্যাশ্রী প্রকল্প নারী ক্ষমতায়ন বা নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণ না করতে পারলেও ভোটের জেতার অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে। বাজারে নগদ টাকার জোগান বাড়লে লেন-দেন বাড়িয়ে অর্থনীতিকে কিছুটা সচলও করে। মহিলারা যেটা পাচ্ছেন তা অধিকার নয়। অনুদান মাত্র। আগেকার সময়ে প্রজারা যেমন রাজা-জমিদারদের কাছ থেকে দান পেত, নগদ হস্তান্তর প্রকল্পগুলি তার আধুনিক সংস্করণ। তাছাড়া এই ধরনের সামাজিক প্রকল্পে অনুদান অসহায় মানুষের মধ্যে শাসকদের প্রতি বশ্যতা ও আনুগত্যের জন্ম দেয়, যা শাসকদের নারী সহ অসহায় প্রান্তিক মানুষদের বাঁচার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে সাহসী করে তোলে — অধিকারের লড়াই দুর্বল করে দেয়।
এই প্রসঙ্গে আমাদের রাজ্যের আর একটি নারী ক্ষমতায়নের প্রকল্প কন্যাশ্রী নিয়ে একটা অভিজ্ঞতা এখনে ভাগ করে নিই। ক’দিন আগে কথা হচ্ছিল একজন অবিভাবকের সঙ্গে। মেয়ে একাদশ শ্রেণীতে পড়ে। ভর্তি হওয়ার পর মেয়ে একদিনও স্কুলে আসেনি। পড়াশোনাও করে না। বাড়ির কাজেও হাত লাগায় না। তাই আঠারো হলেই বিয়ে দিয়ে দেওয়ার সমস্ত বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। স্কুলে নামটা লিখিয়ে রেখেছেন নামমাত্র। কন্যাশ্রীর টাকা ব্যাঙ্কে ঢুকে গেলেই স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে দেবেন। অভাবের সংসারে এই টাকা খুব দরকার তাঁর। মেয়ের বিয়ের কাজে টাকাটা লেগে যাবে। অথচ কন্যাশ্রী প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল নাবালিকা বিবাহ বন্ধ করে নারীকে শিক্ষার অঙ্গনে নিয়ে আসা। উচ্চ শিক্ষায় মেয়েদের আগ্রহী করাও এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু পরিসংখ্যান থেকে দেখতে পারি যে, নাবালিকা বিবাহে দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম সারিতে। ফলে কন্যাশ্রী প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যও মাঠে মারা যাচ্ছে।
অনেকে মনে করেন, লক্ষ্মীর ভান্ডার এবং কন্যাশ্রী — এই দুই প্রকল্প রাজ্যের নারী সমাজকে “আপন ভাগ্য জয় করার” অনেকটা অধিকার দিয়েছে। কিন্তু বাস্তব তো উল্টো কথা বলে। নারীর উপর শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচার এবং বৈষম্য তো দিন দিন ক্রমবর্ধমান। তাহলে লক্ষ্মী ভান্ডার বা কন্যাশ্রীর সুফল কি ভোট রাজনীতিতেই আটকে রইল! এ রাজ্যের প্রান্তিক পরিবারের নারীরা ভোট ময়দানে জনবাদী রাজনীতির উপভোক্তা হিসেবে নিজেদেরকে আটকে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন না তো? নাকি তারা সত্যি সত্যি একটি শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে উঠে আসছে, সে কথা বিচারের ভার ভবিষ্যতের উপর ছেড়ে দিলাম।