বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

লেবাচাঁদ টুডু প্রয়াত

লেবাচাঁদ টুডু প্রয়াত

শোভন পাল

photo

২ জুলাই, ২০২২ সন্ধ্যায় ঐতিহাসিক গোপীবল্লভপুর কৃষক আন্দোলনের অন্যতম সামনের সারির সংগঠক লেবাচাঁদ টুডু ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ১৯৬৯ সালে গোপীবল্লভপুর কৃষক আন্দোলনে যে সমস্ত স্থানীয় যুবক অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন আদিবাসী যুবক লেবাচাঁদ টুডু।
দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার নকশালবাড়ি এলাকায় কৃষক আন্দোলন যে আলোড়ন তৈরি করেছিল তার অনুপ্ররণায় প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় ও প্রেসিডেন্সি কনসোলিডেশনের এক ঝাঁক ছাত্র-যুব বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা সীমান্ত এলাকায় চলে যান কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য। তাঁরা সেখানে প্রেসিডেন্সি কলেজের মেধাবী ছাত্র ভূমিপুত্র সন্তোষ রাণার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তিনি তখন গোপীবল্লভপুরের নয়াবাসান বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতার চাকরি করছিলেন। তিনিও স্কুলের চাকরি ছেড়ে কৃষকদের জাগরিত করার কাজে ব্রতী হন। ছাত্র-যুবরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষকদের জোতদার-মহাজনদের আধা সামন্তবাদী কর্তৃত্ব ও শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করতে প্রচার শুরু করেন। একের পর এক গ্রামের কৃষকরা সংগঠিত হতে থাকেন। এই পর্বে মূলত সন্তোষ রাণার প্রেরণায় লেবাচাঁদ কৃষক আন্দোলনে সামিল হন। আদিবাসী গ্রাম ও পাড়াগুলিতে লেবাচাঁদের পরিচিতি আদিবাসী কৃষকদের সংগঠিত করতে বিশেষ কাজে লাগে।
১৯৬৯ সালের দ্বিতীয় ভাগে গোপীবল্লভপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে চলা জোতদার, সুদখোর মহাজনদের শোষণ জুলুম ও কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে কৃষকরা উত্তাল আন্দোলনে ফেটে পড়েন। নভেম্বর মাসে হাজার হাজার কৃষক, কৃষক রমণী মাঠে নেমে তাদের মেহনতের পাকা ধান কেটে নিজেদের ঘরে তোলেন। যুবকদের দল লাঠি, তীর-ধনুক নিয়ে কৃষকদের ধান কেটে ঘরে তোলার কাজে পাহাড়া দেন। এ ছিল দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষক জনতার এক মহান উৎসব। ভেঙে পড়ে জোতদার-মহাজনদের শোষণ-জুলুমের কর্তৃত্ব। মহাজনদের সিন্দুক ভেঙে বন্ধক রাখা গহনা, জমির দলিল কৃষকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। শুরু হয়ে যায় জোতদার-মহাজনদের বেআইনিভাবে দখল রাখা জমি দখল ও বন্টনের কাজ। জোতদার-মহাজনদের প্রতিরোধ ভাঙতে কোথাও তাদের বন্দুক লুঠ করা হয়। ওই এলাকায় পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়। গ্রামে গ্রামে ইএফআর ক্যাম্প বসে।
এই আন্দোলনের সাফল্য সারা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর আগে চারু মজুমদারের সঙ্গে এই ছাত্র-যুবদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হলেও ১৯৬৯ সালের ধান কাটার আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে মূলত সুশীতল রায়চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে প্রেসিডেন্সি কনসোলিডেশনের ছাত্র-যুবরা সিপিআই(এমএল) দলে যোগ দেন। গড়ে ওঠে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা সীমান্ত রিজিওনাল কমিটি। পরবর্তী কালে লেবাচাঁদ টুডু ওই রিজিওনাল কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে চারু মজুমদারের খতম অভিযান সহ বাম হঠকারি লাইন সিপিআই(এমএল) দলে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭০ সালে সিপিআই(এমএল) দলের পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ওই বাম হঠকারি লাইন কার্যকরি করতে গিয়ে গোপীবল্লভপুর এলাকায় স্কোয়াড অ্যাকশন শুরু হয়। তার পরিণতিতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তীব্র হয়। কৃষক জনতা দূরে সরে যেতে থাকেন। একে একে গ্রেপ্তার হন অসীম চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষ রাণা সহ বহু নেতৃত্ব। গ্রেপ্তার হন লেবাচাঁদ টুডু এবং তাঁর স্ত্রী কুনি টুডু। গোপীবল্লভপুরে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন স্থিমিত হয়ে পড়ে। একই ভাবে, ডেবরা এলাকার কৃষক আন্দোলনও স্থিমিত হয়ে যায়।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৯৪৭ সালের ২২ এপ্রিল অধুনা ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুরের ভালুকখুলিয়া গ্রামে দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারে লেবাচাঁদের জন্ম। পিতা লক্ষ্মণ টুডুর ছয় পুত্র ও দুই কন্যার কনিষ্ঠতম। লক্ষ্মণ টুডু ছিলেন দরিদ্র কৃষক। তাঁর কাছে অতোগুলি সন্তান প্রতিপালন করা ছিল কঠিন বিষয়। অধিকাংশ ভূমিহীন-দরিদ্র কৃষক ও আদিবাসী পরিবারের মতো লেবাচাঁদের পরিবার প্রায়শই অর্ধাহারে থাকতেন। পড়াশোনা চালানো ছিল আরও কঠিন কাজ। অভাবের কারণে নাবালক বয়েসেই লেবাচাঁদকে অতি সামান্য মজুরি ও সারা বছর ভাতের জন্য ভাতুয়া খাটতে হতো। এর ফলে পড়াশোনায় বার বার ছেদ হয়। তার মধ্যেই তিনি পড়া চালিয়ে যাওয়ার ঐকান্তিক আগ্রহের কারণে এক-দু’ বছর ভাতুয়া খাটার পর আবার স্কুলে ফিরে যেতেন। তিনি ক্লাস নাইন পর্যন্ত লেখা-পড়া চালিয়ে যান। তিনি বাংলা, কিছুটা ইংরাজি লিখতে পড়তে পারতেন। কারাগারে দীর্ঘ বছর থাকাকালীন সময়ে সতীর্থদের সহযোগিতায় লেখা-পড়ার কাজ চালিয়ে যান।
আন্দোলনের মধ্য দিয়েই খড়িকাশোলের কুনি সোরেনের সঙ্গে লেবাচাঁদের পরিচয় ও প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁদের বিবাহ হয়। কিন্তু তাঁরা উভয়েই গ্রেপ্তার হয়ে যান। ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের পতনের পর ১৯৭৭ সালে তাঁরা মুক্তি পেলে সাঁওতাল সমাজের রেওয়াজ অনুযায়ী কুনি দেবীকে টুডুর পরিবারে স্থান দেওয়া হয় না। লেবাচাঁদ স্ত্রীর সম্মান রক্ষার জন্য পাটবাঁধায় কুড়েঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করেন। আমৃত্যু তাঁরা সেখানেই ছিলেন। তাঁরা ছিলেন নিঃসন্তান। দারিদ্রের মধ্যেও অতিথি আপ্যায়নে তাঁদের চেষ্টা সকলের নজরে আসত। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে পরস্পরের প্রতি তাঁদের একনিষ্ঠতা ও ভালবাসা উদাহরণ হিসাবে থেকে যাবে। ২৬ নভেম্বর ২০২০ কুনি দেবী ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন।
জেল থেকেই সন্তোষ রাণা ও লেবাচাঁদ টুডু সিপিআই(এমএল) প্রার্থী হিসাবে ১৯৭৭ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সন্তোষ রাণা গোপীবল্লভপুর কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৩,৪০১ ভোট পেয়ে জয়ী হন। লেবাচাঁদ টুডু নয়াগ্রাম কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৭,০৭১ ভোট পেয়ে (১৭.৪৯%) তৃতীয় স্থানে ছিলেন। তিনি ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে সিপিআই(এমএল) প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ২৯,৩৩৮ ভোট (৫.৯৭%) পান।
লেবাচাঁদ টুডু আদিবাসী সম্প্রদায়ের অন্যতম নেতা হিসেবে উঠে আসেন। আদিবাসীদের অধিকার, ভাষা ও স্বশাসনের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭৯ সালে গঠিত ঝাড়খন্ড সংযুক্ত সংঘর্ষ মোর্চা এবং ১৯৮৫ সালে গঠিত ঝাড়খন্ড সমন্বয় কমিটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি আদিবাসী গাঁওতারও অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.