বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

গ্রাম পথে বাম

গ্রাম পথে বাম

উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়

photo

পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছিল এবার তৃণমূল দলকে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হবে। আগের মতো করে বিপুল জয় ছিনিয়ে নিয়ে আসা যথেষ্ট কঠিন। তাই হয়েছে। তারপরও মমতা ব্যানার্জির দল হয়তো স্বস্তি বোধ করতে পারেন। বিশেষ করে, যখন সিপিআইএম, কংগ্রেস ও আইএসএফ ও অন্যান্য বাম, নির্দল প্রার্থীরা বহু ক্ষেত্রে হেরে গেছে।

এই নির্বাচন পর্ব সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষেরর কাছে অনেকগুলো প্রশ্ন তুলে দিল।

সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় শাসনকালে পঞ্চায়েত আইন তৈরি হলেও জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্টের শাসনকালে ওই আইনে গ্রামীণ স্বশাসন ও গণতন্ত্রকে সম্প্রসারিত করে কার্যকর করা হয়। গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষকে পঞ্চায়েতের যুক্ত করার প্রক্রিয়াও শুরু হয় নিম্নস্তরে উন্নয়নের স্বার্থে। সময়ের নিয়মে যা অনেকটাই সাফল্য লাভ করেছিল। কিন্তু বিধি বাম!

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে এবিষয়ে আলোচনা করেছিলেন এবং পরে সংবিধান সংশোধন করে সারা দেশে চালু করেন এই পঞ্চায়েত আইন। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে, ধনতন্ত্রের পূজারী রাজনৈতিক দলের অভিমুখ পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমাদের দেশে রাষ্ট্রের নেতৃত্বে আছে একচেটিয়া পুঁজি। আমাদের দেশের সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল উদারনৈতিক বুর্জোয়া গণতন্ত্রের।

নয়া উদারনীতির পর্বে সারা দুনিয়ায় সমাজতন্ত্রের সঙ্কট ও দুর্বলতার সুযোগ নিল শোষক শ্রেণী। দেখা গেল, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনকল্যাণমূলক নীতি বর্জনের প্রবণতা। আমাদের দেশ ও রাজ্যেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। উনিশ বিশের তফাৎ থাকতে পারে। শাসক দলগুলি জনগণের কল্যাণে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্থার ওপরে আস্থা না রেখে, ওই সংস্থাগুলো কর্তৃত্ব দখলের জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

কিন্তু আবার শাসক দলের জোর জুলুম, খুন হিংসাত্মক ঘটনাবলী ও চূড়ান্ত ছাপ্পাবাজীর পরও এই মন্থর ফলাফল প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে এই পঞ্চায়েত নির্বাচন আরেকটি বিষয়কে স্পষ্ট করেছে, বামপন্থীদের আহ্বান অনুযায়ী ‘বাম পথে গ্রাম’ শব্দার্থে না হলেও ‘গ্রাম পথে বাম’ উদ্ভাসিত চেহারায় দৃশ্যমান হয়েছে। সামনে বাকি অনেক পথ। কঠিন পথ।

২০২১ সালে বামফ্রন্ট-কংগ্রেস-আইএসএফ-র মিলিত শতকরা ভোট ছিল, ১০%। বামপন্থীরা ‘শূন্য’ হল! এবারের ২০২৩-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে এতো প্রহসনের পরেও তাদের ভোট সেটাই বেড়ে হল ২১%। আর ২০২১ সালের যে “বিরোধী” বিজেপির শতকরা ভোট ছিল ৩৮%, সেটাই ২০২৩-এ পঞ্চায়েত নির্বাচনে কমে হয়েছে ২২%। মানে কী? বামেদের ভোট বেড়েছে ১১%, বিজেপির কমেছে ১৬%। অথচ খেয়াল করলে দেখবেন, কোন সংবাদ মাধ্যম কি “বাম বাড়ছে, বিজেপি কমছে” গোছের খবর করছে।

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর বিধানসভা ও লোকসভা মিলিয়ে বাংলায় উপনির্বাচন হয়েছে চার জায়গায়! শান্তিপুর, বালিগঞ্জ, সাগরদিঘি বিধানসভায় এবং আসানসোল লোকসভায়। এই চার জায়গায় বিজেপির শতকরা ভোট কমেছে গড়ে ১৬.৫% হারে। বামফ্রন্ট কিম্বা জোটের শতকরা ভোট বেড়েছে গড়ে ১৭% হারে।

আর ৮৫টি মিউনিসিপ্যালিটি নির্বাচনে বিজেপির শতকরা ভোট কমেছে গড়ে ২২% হারে। বামফ্রন্ট কিম্বা জোটের ভোট বেড়েছে গড়ে ৪% হারে। কলকাতা কর্পোরেশন সহ রাজ্যের আরও ৪টি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজেপির শতকরা ভোট কমেছে গড়ে ২২% হারে। বামফ্রন্ট কিম্বা জোটের ভোট বেড়েছে গড়ে ৬% হারে। এইসব প্রতিটি নির্বাচনে ভোটের নামে তৃণমূল প্রহসন করেছে।

২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের ফলাফলের ১৪টি গ্রামীণ বিধানসভা এলাকার স্যাম্পেলিং-র তথ্য গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রায় ৬০ হাজার আসনের উপর প্রোজেক্ট করলে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালের হিসেবে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ-র কপালে জোটার কথা ছিল মাত্র ৮৭৩টি পঞ্চায়েত আসন। অথচ বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জিতছে প্রায় আট হাজার আসন। আসনের বিচারে ৯ গুণ! আচ্ছা, “বামেদের রক্তক্ষরণ” নিয়ে সংবাদ অনেক দেখেছেন, কিন্তু এই যে ধারাবাহিক শতকরা ভোট আর পঞ্চায়েতে আসন বৃদ্ধি নিয়ে কিছু দেখতে পাচ্ছেন।

বিকেলে নির্বাচন ঘোষণা করে কাল মনোনয়ন, মনোনয়ন জমা নেওয়ার অফিসাররাই অদৃশ্য, মনোনয়ন আটকাতে গুণ্ডাদের ক্যাম্প, তৃণমূল দল গড়ে এক সেকেন্ডে মনোনয়ন জমা, নিয়ম করে হাইকোর্টে থাপ্পড়, ভোটের দিন কমিশনারের ভোট শুরুর তিন ঘণ্টা পরে দপ্তরে যাওয়া। দুনিয়ায় কোনও জায়গায় দেখেছেন নাকি গণনার দিন রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটের সার্ভার ডাউন!

কেউ এটা বলছেন না, একটাই তো কমিশন, একটাই তো নির্বাচন, আর একদিনেই তো গণনা, তাহলে নানা রকম ফল পাওয়া যাচ্ছে কোথা থেকে। মানুষ সঠিক ফল জানবে কিভাবে। আদালত পঞ্চায়েত ভোটের ফলের উপর স্থগিতাদেশ দিয়ে প্রমাণ করল আসলে ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে।

হিংসা লুঠ খুন তান্ডবের সময়ে নিভৃতে নীরব থেকে তৃণমূলের নির্বাচনী সাফল্য নিশ্চিত হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী ইন্টারভিউতে বলছেন, “সিপিএম জিতে কী করবে? পঞ্চায়েত এমন সিস্টেম, বিরোধী কেউ জিতলেও তাকে তৃণমূলে আসতেই হবে। না হলে পয়সা কোথায় পাবে?” ত্রি-স্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মৌলিক বিষয় হল মানুষের অংশগ্রহণ, দুর্নীতি যাতে না হয় তার জন্য পঞ্চায়েতের সমস্ত কিছুই স্বচ্ছভাবে মানুষের কাছে রাখতে হয়। গ্রাম সংসদ বসবে, মানুষ প্রশ্ন করবে, নীতি প্রণয়নে অংশগ্রহণ করবে, সংযোজন করবে, প্রয়োজনে সংশোধন করবে। Participatory Democracy–এ এটাই ছিল পঞ্চায়েতে দুর্নীতির চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ছিল পঞ্চায়েতের হৃদ স্পন্দন। কিন্তু দলের নাম তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রীর আদর্শে আলোকিত তৃণমূল বিশ্বাস করে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণে।

তৃণমূল জণগনের মধ্যে উন্নত জীবনের আদর্শ রূপায়ণ করতে চায় না। তারা তাই জীবনের প্রতিটি মৌলিক ক্ষেত্রে মাকড়সার মতো দুর্নীতির অন্তর্জাল তৈরি করতে ব্যস্ত। প্রান্তিক গরীব মানুষকে বেকারদের শেখাছে দুর্নীতি করে পয়সা কামাতে। বাহুবলী আর চোরেরা সব জুটেছে তৃণমূলে। এখন এটা একটা ব্যবস্থা।

এত কিছুর পরও মানুষ কিন্তু লড়াইয়ের নতুন ইতিহাস লিখছে বাংলায়। ২০০৮ সালের পর যে গ্রামে লাল পতাকা নিষিদ্ধ ছিল, এবার সেখানেও মিছিলে সেজে উঠেছে, ভেঙ্গে ফেলা পার্টি অফিসে আবার চাটাই পড়েছে, তৃণমূলের হাতে খুন হয়ে যাওয়া ঘরের ছেলে, মেয়ে প্রার্থী হয়েছে, গ্রাম ভেঙ্গে প্রতিরোধ করেছে, মনোনয়ন জমা পড়েছে, ছাপ্পা আটকানোর জন্য লড়াই করেছে। জেতার সার্টিফিকেট নিয়ে বেরিয়ে মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, কেউ নিজের ঘরে লাল ঝাণ্ডা বাঁধতে দেখে উচ্ছ্বাসে মেতেছে, কেউ আড়ালে আবডালে কান পেতে বামপন্থীদের ভাষণ শুনেছে, কেউ কাঁধে হাত রেখেছে কেউ দূর থেকে হাত নেড়ে বলেছে, আমরা আছি। লড়ে যাও।”

গঞ্জের মোড়ে, পাড়ার ঠেকে লাল ঝাণ্ডার সেই লড়ে যাওয়ার গল্প একটু একটু পাঁচ কান হচ্ছে। নির্বাচনী প্রহসনের পর প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষ লাল ঝাণ্ডাকে সমর্থন করেছে। পৃথিবীর ইতিহাস সাধারণ মানুষের লড়াই কোনও জাদুতে হয়নি। হয়েছে রক্ত-ঘামে ভিজেই। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শেষ কথা লিখেছে মেহনতি মানুষই।

যারা ২০২১ সালের পর “৭%” আর “শূন্য” বলে বামেদের রক্তক্ষরণ নিয়ে ভজনা করত, তারা যখন ২১% নিয়ে নীরব। সাধারণ মানুষের সেই লড়াইয়ের ইতিহাস নতুন করে লেখার কাজ শুরু হয়েছে। আর ক্রান্তি কালের ইতিহাসের শিরোনাম রচিত হচ্ছে নতুন অভিমুখে। তাই যে, প্রশ্নটা উঠেছে তা হল আমেরিকার ঘরানার “হয় রিপাবলিকান”, “না হয় ডেমোক্রেটিক” দলের ক্ষমতা পরিবর্তনের পথ নয়। আন্দোলনের পথেই এগোবে বাংলা তথা ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের সংগ্রাম। শাসকের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতেই হবে। সবে সলতে পাকানো শুরু হয়েছে। শক্তিকে বাড়িয়ে দেখলে সর্বনাশ, আবার ছোট করেও দেখলে হবে না। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের সামর্থ্য শক্তিকে বাড়িয়ে নিতে হবে। তার জন্য যেতে হবে খেতমজুর, প্রান্তিক চাষী, দরিদ্র চাষী, স্থান, দিনমজুর, অসংগঠিত মজুর, গিগ শ্রমিকের বেঁচে থাকার সংগ্রামে। সেখান থেকে নতুন শক্তি সংগ্রহের রসদ পাওয়া যাবে। কাল, পরিবেশ, চেতনা ও সংগঠনের অবস্থা বিবেচনায় রেখে পদক্ষেপ নিতে হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.