বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

সন্দেশখালির ঘটনা থেকে শিক্ষা

সন্দেশখালির ঘটনা থেকে শিক্ষা

উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়

photo

নতুন বছরের শুরু থেকেই সন্দেশখালির গরীব গুর্বোদের জীবনের চালচিত্র সবাই দেখছেন। খবরের কাগজের পাতায়, বৈদ্যুতিক চ্যানেলগুলো উত্তর ২৪ পরগনার সুন্দরবন সংলগ্ন দ্বীপাঞ্চলের রোমহর্ষক দিনলিপি তুলে ধরেছে। এবারের ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল একমাসের আগে। এই অঞ্চলের তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি শেখ শাহজাহানের প্রাসাদে রেশনের খাদ্য দুর্নীতির তদন্তে হানা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি। শাহজাহানের তরতাজা বাহিনীর এসব সহ্য না হওয়ায় হামলা চালিয়েছিল ইডি ও সাংবাদিকদের উপর। এরই পরিণতিতেই শাহজাহানকে যেতে হয় গোপন আস্তানায়। আর সেখানে বসেই তিনি আদালতে আবেদন করে যাচ্ছে যে, তাঁকে গ্রেফতার না করার শর্তে আত্মসমর্পণ করতে রাজি আছে। বর্তমান সরকারের রাজ্যের এই পুলিশ প্রশাসন না থাকলে আমরা দেখতেই পেতাম না তৃণমূল কংগ্রেস কত বড় জাদুকর।
এই অত্যাচারী দুর্বৃত্ত অদৃশ্য হওয়ার পর প্রজারা সংযম হারিয়েছে। বিদ্রোহ করছে। তার পেয়াদা বাহিনী যেসব ছোট কৃষকদের জমি, ভেড়ি দখল করেছে তার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে। তাদের বিবরণ থেকে জানা যাচ্ছে, কীভাবে মানুষকে সামান্য টাকার বিনিময়ে করা হয়েছে সস্তা শ্রমদাস। ওই প্রান্তিক মানুষদের সংসারের মায়েরাও হয়েছে হারেমের বাঁদি। কারণ শাসক তো মা-মাটি-মানুষের। কোনও রকম কেউ যদি চেষ্টাও করেন এই জুলুম এড়িয়ে যেতে তার চাষের জমিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে নোনা জল। আর হারেমের বাঁদির জোগানে নেমে এসেছে কোদালের বাঁটে মার।
এরপর দখল করা সম্পত্তির জোরে ধান্দার পুঁজি থেকেই অর্জিত হয়েছে বিপুল অর্থ। যার জোরেই তৃণমূল কংগ্রেসের মাফিয়াদের অনুগত হয়ে পড়েছে প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সকলেই জানেন, এই ঘটনা নতুন কিছু নয়। শিক্ষিকাকে জলের জগ ছুড়ে মারা, উপাচার্য, অধ্যক্ষকে পেটানো, আধ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে বোমা মারার হুঁশিয়ারী শুনেছি গণশত্রুদের কাছ থেকে।
দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যেমন ধান্দা পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তেমনই সমাজের স্বাভাবিক অর্থনীতির পাশাপাশি তৃণমূলও ধান্দা পুঁজির সমান্তরাল অর্থনীতির একটা পশ্চিমবঙ্গীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
রাজ্যের অতীতের প্রতিটি সরকারের শাসন পর্বেই সমাজে এই ধরনের মস্তানদের দাপট দেখা গেছে।
কিন্তু একটি বৈশিষ্ট্যে তৃণমূল কংগ্রেস শাসক দলের প্রশাসন একেবারেই আলাদা, তাহল সরকার-প্রশাসন আইনের রক্ষকের চরিত্রই হারিয়ে ফেলেছে। যেমন একবার, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ঘরের দরজার পাশে একজন বিশেষভাবে সক্ষম মেয়েকে নিয়ে বসে পড়েছিলেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী। তখন জ্যোতি বসু বলেছিলেন, এই সমাজে এরকম ঘটনা ঘটে। যদিও তিনি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্ত তার মানে এটা নয় যে, বাম জমানায় নারীমাংসলোভী মানুষ ছিল না। আমরা জানি, সুটিয়ার বরুণ বিশ্বাসকে এই অপরাধের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েই শহীদ হতে হয়েছিল। ওখানে দুর্বৃত্তদের আধিপত্য বিস্তার ঘটেছিল বামফ্রন্ট সরকারের শাসনকালে। যদিও বরুণ বিশ্বাসের হত্যা সংগঠিত হয় তৃণমূল আমলেই। কিন্ত আজও বিচারের আশায় ওঁর দিদি কেঁদে কেঁদে ঘোরে আদালতের দরজায়।
সন্দেশখালির গরীব গুর্বো গ্রামবাসীদের অভিযোগ দ্বিমুখী। শাসকের মধ্যে থাকা সব ধরনের নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের বিস্তার করে ওই দুষ্কৃতিরা নিজের পুঁজি সংগ্রহ করছে। আর এই দুর্বৃত্তরা জীবন যাপন করছে বিলাস বৈভবের মধ্যে। যা লুঠ হয়ে যাওয়া মানুষগুলো দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে দেখে। দুষ্কৃতিরা তাদের রাজত্বের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চালায় নানা ভীতি প্রদর্শন।
পুলিশের প্রশানের দায়িত্ব ছিল জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া, যে কোনও সামাজিক-অপরাধ থেকে অপরাধের থেকে নিরাপত্তা দেওয়া। আইনের রক্ষকরা সেই ভূমিকা পালন করে নি বরং পুলিশ সাহায্য করেছে অপরাধীদের। পুলিশ দুর্বৃত্তদের সবরকম অপরাধগুলো আড়াল করেছে। আজও যখন বিভিন্নভাবে জনবিক্ষোভ ফেটে পড়ছে তখনও অনেক মায়েরা নিজের পরিচয় দিয়ে তাদের ওপরে ঘটে চলা পৈশাচিক অপরাধগুলো দায়ের করতে পারছেন না। এই সুযোগে পুলিশ ও শাসক দলের মুখপাত্ররা বলছে, রাজনৈতিক স্বার্থে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে, আসলে তেমন কিছু ঘটে নি। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী তো বলেছেন, প্রথমে শেখ শাহজাহানকে টার্গেট করে এই এলাকায় ঢুকেছে, তারপর গন্ডগোল পাকানো হয়েছে। আর এই প্রেক্ষাপটেই বিজেপি, আরএসএস গদি মিডিয়ার সাহায্যে শক্তিও সঞ্চয় করতে চেষ্টা করছে।
একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, আমাদের গণতন্ত্র নাকি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ! অথচ আজ দেখছি, এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অংশ পুলিশ জনগণকে দমনের জন্যে সব কিছুই করছে। তাই তো
এখানে পুলিশ প্রতিবাদী ছাত্রকে খুন করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে। রাতের অন্ধকারে প্রতিবাদীদের বাড়ি ভাঙচুর করার যুক্ত বলে অভিযুক্ত হচ্ছে পুলিশ। গণতন্ত্রের বড় হাতিয়ার নির্বাচনে ‘মতদান’, তাও লুঠ করতে আজকে পুলিশই দক্ষ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছে। যে কোনও রাজনৈতিক বিবাদে চলছে বোমা-গুলি। খুন এখন জলভাত । সন্দেশখালিতে তৃণমূলের জন্যে এক আইন, আর বাম ও বিরোধীদের জন্যে অন্য আইন।
একটা সমস্যা হল, জানি না কেউ বুঝতে পারছেন কিনা – এই সন্ত্রাস শুধুই কিন্ত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। ছড়িয়ে যাবে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠির মধ্যে, জাত,ধর্ম ভাষাভাষীর মধ্যে যা ভারত ও এই বাংলাকে দুর্বল করবে। তাই এর বিরুদ্ধেই সকলকে প্রতিরোধের সংগ্রাম গড়ে তোলা খুব জরুরি।
একজন প্রিয় নাট্য অভিনেতাকে বলেছিলাম এই কথাটাই। তিনি বললেন, ‘‘জীবনে সুখে থাকাটা একটা আর্ট। একটা শিল্প। সবাই এই আর্টকে অর্জন বা আয়ত্ত করতে জানেন না। আমি খুব দুঃখী, আমি খুব কষ্টে আছি – এই কথাগুলোর মধ্যে কোনও শিল্প নেই। শিল্প আছে সেখানে – যেখানে হাজার শূন্যতা, হাজার অপমান, হাজার হাজার না-পাওয়া তবু তারই মধ্যে, সেই শতকষ্টের ঝর্ণাতলাতেও একটি মানুষ কেমন নীরবে, নির্বিকার বিভোরতায় একটা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। ❑
আসলে জীবনের কোনও না-পাওয়াকেই বিশেষ গুরুত্ব দিতে নেই। কষ্টকে উচ্চতর মর্যাদার আসনে বসতে দিলেই তা জীবনের সমগ্র অনুভূতির উপরে দখলদারি ফলাতে শুরু করে। তখন খুব সামান্য কারণেই জীবন বিস্বাদ হয়ে ওঠে আর মন বিকল্প খুঁজতে চায়। কিন্তু দুঃখ তো আর জীবনের একটা দরজা দিয়ে ঢোকে না! তার অজস্র প্রবেশপথ। কটা দরজাকে বন্ধ করবেন? কটা দরজার দিকে তাকিয়ে বসে থাকবেন, এই বুঝি দুঃখ এল! এই বুঝি সুখ বেরিয়ে চলে গেল আমার ঘর থেকে!
কে বলেছে সুখে থাকলেই শুধু ভালো থাকা যায়? জীবনের সর্বস্ব হারানো মানুষও এই জীবনেরই কোনও না কোনও শিকড় থেকে রস সংগ্রহ করে দিব্য বেঁচে থাকে। আসলে একমাত্র শিক্ষকের আসন ছাড়া দুঃখকে আর কোথাও বসতে দিতে নেই। দিনান্তে তাকে পূজা করতে হয়। তার প্রসাদী ফুল, তার আলো আমাদের সামনের পথ দেখায়।’’

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.