বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

চিঠিপত্র কোষমুক্ত

চিঠিপত্র কোষমুক্ত

কমল কুমার দাস

photo

কৌশিক সেন ‘আমাদের টিনের তলোয়ার’ (৯-৭) প্রবন্ধে বিজেপি-আরএসএস’এর ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের যে ভয়ঙ্কর দিক তুলে ধরেছেন, তার সঙ্গে মতানৈক্যের কোনও অবকাশ নেই। বিজেপি এই মুহূর্তে দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, অখণ্ডতার পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে গড়ে ওঠা, ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’-এর ভারতবর্ষকে বাঁচাতে হলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি বৌদ্ধিক সমাজের অগ্রণী ভূমিকার কথা প্রবন্ধকার যথার্থ ভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজের সক্রিয় যোগদান ছাড়া, শুধু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে বিজেপির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি প্রতিহত করা সম্ভব নয়।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, প্রবন্ধকার ‘প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্য’-এর দানবীয় চেহারা শুধুমাত্র কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় থাকা আরএসএস-এর মতাদর্শপুষ্ট বিজেপি সরকারের কার্যক্রমে দেখতে পাচ্ছেন? রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকারের কাজকর্মে তা দেখতে পাচ্ছেন না? রাজ্যে বারংবার ঘটে চলা প্রাতিষ্ঠানিক অত্যাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলার বৌদ্ধিক সমাজের সিংহভাগ হয় নীরব, নয়তো সরকারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যের সঙ্গে আপস করছেন। অনেকে সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করে প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যের শরিক হয়ে উঠেছেন। ২০১১ সালে বাংলার ‘অগ্নিকন্যা’র রাজনৈতিক শক্তি যে স্তরে থাকুক না কেন, সিপিআইএম-কে ক্ষমতাচ্যুত করা তাঁর পক্ষে একক ভাবে সম্ভব ছিল না, যদি না বাংলার বৌদ্ধিক সমাজ প্রতিবাদে সরব হতেন। পরিবর্তনের বার্তা বহন করে সে দিন তাঁরা যে কোনও রকমের প্রাতিষ্ঠানিক শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই মানুষ পরিত্রাণের পথ হিসাবে অগ্নিকন্যাকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করার সাহস পেয়েছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর থেকে তৃণমূল সরকার ক্রমাগত গণতন্ত্র চর্চার পরিসরকে সঙ্কুচিত করেছে। মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলেছে। অথচ, বাংলার বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ বিজেপির সঙ্গে তুল্যমূল্য বিচার করে ‘লেসার ইভিল’ আখ্যা দিয়ে তৃণমূল দলের স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্রকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন।

প্রবন্ধকার আরএসএস-বিজেপির সাম্প্রদায়িক চরিত্র সম্পর্কে পাঠককে সজাগ করে দিয়েছেন। অথচ, একদা আরএসএস-ঘনিষ্ঠ বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গুজরাত দাঙ্গায় অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদীকে বিধানসভায় ভাল ফল করার জন্য উপহার হিসাবে তিনি ফুল পাঠিয়েছিলেন। লেখায় সে বিষয়ে প্রবন্ধকার সম্পূর্ণ নীরব।

সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোট উপলক্ষে গণতন্ত্রের যে হত্যালীলা হল, তা যে শাসকের স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট চরিত্রকেই প্রতিভাত করে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া থেকে শুরু করে গণনাপর্ব পর্যন্ত তৃণমূল দল প্রশাসনের সহায়তায় কার্যত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে ধূলিসাৎ করে আধিপত্য কায়েম করেছে। তাই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের নীরবতা শুধু বিস্ময় উদ্রেক করে না, হাড়হিম করা ভয়ও সঞ্চার করে। বাংলার বৌদ্ধিক মহলের এই নীরবতা যতই দীর্ঘায়িত হবে, ততই বাংলার ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। কারণ, সামাজিক পটপরিবর্তনে বা রাজনৈতিক পালাবদলে বৌদ্ধিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। তাঁরাই সমাজের চালিকাশক্তি। দেশের অগণিত সাধারণ মানুষের মতামতকে সংগঠিত করার শক্তি তাঁদের আছে। দেশ, কাল, সমাজ নির্বিশেষে বৌদ্ধিক সমাজের সক্রিয় যোগদানে রাষ্ট্রবিপ্লব নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। বাংলার বৌদ্ধিক মহল যত তাড়াতাড়ি এই সত্য উপলব্ধি করতে পারবেন, ততই ভাল। তাঁদের তরোয়াল টিনের হলেও কোষমুক্ত। তবে মরচে পড়ে ভোঁতা হয়ে গেলে দুশ্চিন্তার বিষয়।

কমল কুমার দাস, কলকাতা-৭৮
২৬ জুলাই ২০২৩
সৌজন্যে: আনন্দবাজার পত্রিকা

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.