বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১ মে, ২০২২— গ্রামবাংলার তৃণমূল স্তরে জনস্বাস্থ্যের ভার আজ আশাকর্মীদের ওপর। কার জ্বর হয়েছে, কোন মায়ের কী অবস্থা, কে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত, শিশুদের আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ানো, টিকার ব্যবস্থা করা— সবই দেখতে হয় আশাকর্মীদের। গর্ভবতী মাকে নিয়ে দিনে–রাতে যখনই হোক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, করোনা রোগীর বাড়িতে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, প্রতিদিন অক্সিজেন লেভেল পরীক্ষা করা, সুগার, প্রেশার, হার্টের রোগী শনাক্ত করা, টিবি রোগীকে ওষুধ খাওয়ানো ইত্যাদি নানা কাজে ২৪ ঘন্টা পরিষেবা দিয়েই চলেছেন আশাকর্মীরা। কিন্তু তাঁরা নিজেরা কেমন আছেন? খোঁজ নিতেই বেরিয়ে এল এক করুণ চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে পিছিয়ে পড়া জেলা পুরুলিয়ার বরাবাজার ব্লকের বান্দোয়ান সেন্টারের আশাকর্মী দ্রৌপদী মাহাতো। নিজে সুগারের রোগী। এইসব কাজ করতে করতেই একদিন জ্বরে পড়লেন। প্রসঙ্গত কাজ করতে করতে আশাকর্মীরা এমন অভ্যস্ত যে নিজেদের রোগ–অসুখকে পাত্তা দেন না। সামান্য জ্বর ভেবে প্রথম দিকে গুরুত্ব দেননি, কাজ করে গেছেন। ছ’দিন পর খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। শয্যাশায়ী অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করার চার দিনের মাথায় শ্বাসকষ্টে মৃত্যু হয় তাঁর। বাড়িতে দুই নাবালক সন্তান। তাঁর স্বামী আমাদের ফোন করে খবরটা দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “দিদি সরকারি কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে কি?” অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাই যে কর্মরত অবস্থায় আশাকর্মীর মৃত্যু হলে তাঁর পরিবারের জন্য সরকারের কোনও ব্যবস্থা নেই। আশাকর্মী সুভদ্রা মাহাতো হাসপাতালে ডিউটি করতে আসার পথে দুর্ঘটনায় মারা যান। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পাঠরত তাঁর ১৮ বছরের মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল “মাসি, মায়ের উপার্জনের টাকাতেই আমাদের পরিবার চলতো। আমার আর ছোট ভাইয়ের পড়াশোনাও চলত ওই টাকাতেই। এখন কী করে চলবে? যদি মায়ের চাকরিটা পাওয়া যায় একটু দেখো।” বোকা মেয়ে জানত না, মা ছিলেন সরকারের স্বেচ্ছাসেবিকা। দায়িত্ব অস্বীকার করার জন্য নিয়োগের সময়ই আশাকর্মীদের ভলান্টিয়ার করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। চাকরি তো দূরের কথা, মৃত্যুকালীন ক্ষতিপূরণ পর্যন্ত এক পয়সাও নেই। প্রসবের পর মা এবং সন্তান যাতে সুস্থ থাকে, ৬ মাস পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো, মা নিজে যেন তার শরীরের যত্ন নেয়, এসব বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখভাল করার কাজ একজন আশাকর্মীর। কিন্তু আশাকর্মীর নিজের মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। রাস্তায় নেমে দাবি করতে হচ্ছে, আশা কর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে হবে। কী নির্মম ব্যবস্থা!
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার আশাকর্মী মালা দাস সকাল থেকে বেরিয়ে তার এলাকায় এসিএফ প্রোগ্রাম, ফাইলেরিয়া প্রোগ্রাম সেরে দুপুরে সবে মাত্র বাড়ি ঢুকেছেন দুটি খাওয়ার জন্য। সঙ্গে ফোন এল তাকে এখনই যেতে হবে। মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে, তাই স্কুলের গেটে মেডিকেল ক্যাম্প সাজিয়ে বসতে হবে। না খেয়ে মালা মাঠ–ঘাট ভেঙে দুপুর রোদে ছুটলেন ডিউটি করার জন্য। পরীক্ষা শেষ হলে সবাই চা, প্যাকেট পেল, মর্যাদা পেল। কিন্তু আশাকর্মীর যেন কিছু পেতে নেই, তিনি শুধু দিতেই আছেন। NRHM (National Rural Health Mission) এর অন্তর্গত ASHA প্রকল্প চালু হয় ২০০৫ সালে কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে। প্রসূতি ও শিশুর মৃত্যুতে ভারত তখন বিশ্বে প্রথম সারিতে। গ্রামীণ ভারতের বেশিরভাগ মা তখন বাড়িতেই শিশুর জন্ম দিতেন। মা ও শিশুকে হাসপাতালমুখী করা, আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির তত্ত্বাবধানে নিয়ে আশা ছিল মূল উদ্দেশ্য। ২০০৫ সাল থেকে ধাপে ধাপে ২০১১ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ব্লকে আশাকর্মী নিয়োগ করা হয়। রাজ্যে এখন প্রতি ১২০০ জনে একজন, অর্থাৎ প্রায় ৫৫ হাজার আশাকর্মী কাজ করেন। এখনও নিয়োগ চলছে। এঁরা সকলেই গ্রামাঞ্চলের অভাবী সংসারের মেয়ে বউ, অনেকেই বিধবা। অনেকের পরিবারের আর কোনও রোজগার নেই, আশাকর্মীর উপার্জনেই সংসার চলে। শুরুতে মা ও শিশুদের নিয়ে ৫-৬ ধরনের কাজ করতে হত। সাম্মানিক ভাতা ছিল ৮০০ টাকা, দৈনিক ভাতা ২৬ টাকা । কেন্দ্রে তখন কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার, রাজ্যে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার। আশা কর্মীদের কাজ সরকারি স্থায়ী পরিষেবা ক্ষেত্রে সরকারি কর্মীদের মতো কাজ হলেও নিয়োগের সময় থেকেই আশাদের স্বেচ্ছাসেবিকা আখ্যা দিয়ে শ্রমিকের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে কেন্দ্রের সরকার। রাজ্য সরকারও নীরব ও উদাসীন থাকে।
এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বহু রক্তক্ষয়ী লড়াই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষে শ্রমিকরাও কিছু অধিকার অর্জন করেছিলেন। যেমন প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশন, মেডিকেল ভাতা, ছুটি, মেডিকেল ছুটি, ইএসআই এবং আট ঘন্টা শ্রম দিবস। আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক হলেও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে মুষ্টিমেয় কিছু ধনী পরিবার। এই মালিক শ্রেণীর বেশি মুনাফা লাভের স্বার্থে কেন্দ্র বা রাজ্যের ক্ষমতায় যে দলই এসেছে, শ্রমিকদের এই অর্জিত অধিকারগুলো এক এক করে ছাঁটাই করতে শুরু করে। বিভিন্ন সরকার এক এক করে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে ভেঙে ভেঙে ঠিকাদার মালিকদের হাতে দিয়ে দেওয়া শুরু করে। এই ঠিকাদারি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকেই সরকার নিজেও নিজের অধীনস্থ কর্মচারীদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা শুরু করে। স্থায়ী কর্মচারীর বদলে চুক্তিভিত্তিক, ঠিকা শ্রমিক, স্বেচ্ছাসেবক ইত্যাদি নামে নিয়োগ শুরু করে। স্থায়ী কাজের বদলে প্রকল্পভিত্তিক কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পভিত্তিক কর্মচারীদের একেবারে নামমাত্র সাম্মানিক ভাতা দিয়ে ওই সংক্রান্ত সরকারি সমস্ত কাজ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া শুরু হয়।
ন্যাশনাল রুরাল হেলথ মিশনের অন্তর্গত আশাও এই ধরনের একটা প্রকল্প। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা ক্ষেত্রগুলির মধ্যে স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্ষেত্র। অথচ স্বাস্থ্য পরিষেবাকে প্রকল্পের আওতায় এনে অর্থাৎ তার বেসরকারিকরণ করে এই সমস্ত প্রকল্পের কর্মীদের খুব সামান্য বেতনে উদয়াস্ত পরিশ্রম করিয়ে নেওয়া হয়।
আশাকর্মীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশন, মেডিকেল ভাতা, ছুটি, মেডিকেল ছুটি, ইএসআই — কোনও কিছুই নেই। ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ নিয়মে কাজ করতে হয়। ২০১১ সালে আশাকর্মীদের জন্য চালু হয় ফরম্যাট সিস্টেম। এই ফরম্যাটে ৪২ ধরনের পরিষেবার কাজ করতে বলা হয়। শুধু তাই নয়, রাজ্য সরকারের বহু প্রকল্পের কাজ এবং দপ্তর বহির্ভূত বহু কাজ বাধ্যতামূলকভাবে বিনা পারিশ্রমিকে করিয়ে নেওয়া হয়। না করতে পারলে নিরন্তর জবাবদিহি চলতে থাকে কিংবা প্রশ্ন করলেই আধিকারিকরা কাজ ছেড়ে দিতে বলেন। চব্বিশ ঘন্টা স্বাস্থ্য পরিষেবার এত ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আশাকর্মীদের পারিশ্রমিক খুবই কম — মাসে ছয় সাত হাজার টাকা বেশি হয় না। কাজের বিনিময় ইন্সেন্টিভ এর প্রাপ্য এমনভাবে সাজানো থাকে যেন লটারির মতো। ৯৯ ভাগ কাজ তুলে দিয়ে, কোনও কারণে যদি এক ভাগ কাজ করতে না পারেন তাহলে তাঁর পুরো পারিশ্রমিকই কাটা যাবে। এমনই নির্মম কাজের প্রকৃতি। এ যেন ন্যায্য পাওনা না দেওয়ার জন্যই এই নিয়ম তৈরি করা হয়েছে।
আমাদের রাজ্যে আশা প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকেই অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টার অনুমোদিত ‘পশ্চিমবঙ্গ আশা কর্মী ইউনিয়ন’ দীর্ঘ ১২-১৩ বছর ধরে আশা কর্মীদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে লাগাতার লড়াই আন্দোলন চালিয়ে আসছে। তবে মূল দাবি পূরণ না হলেও বহু দাবি রাজ্য ও কেন্দ্র উভয় সরকার মানতে বাধ্য হয়েছে। আশা কর্মীদের স্বাস্থ্যকর্মীর স্বীকৃতি না দিয়ে ‘স্বেচ্ছাসেবিকা’ হিসাবে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার যে সাম্মানিক ভাতাটুকু দেয় তা আজকের দিনে মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় অতি সামান্য। আশাকর্মীরা নিজে অসুস্থ হলেও কোনও রেহাই নেই। সপ্তাহের শেষে সমস্ত কর্মীদের ছুটি থাকে, কাজের মাঝে বিশ্রাম থাকে। সরকারি আধিকারিকরা আশাকর্মীদের ক্ষেত্রে সে প্রয়োজনও স্বীকার করেন না। অসুস্থ হলে সামান্য সাম্মানিকভাতাটুকুও অমানবিক ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোনও আর্থিক দায় না নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আধিকারিকেরা আশাকর্মীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে শুধুমাত্র ফুল-মালা, সার্টিফিকেট দিয়ে দায় এড়িয়ে যান। আজকের এই অগ্নিমূল্য বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। পেট্রোল-ডিজেল-রান্নার গ্যাস, ওষুধ, চিকিৎসার খরচ, মোবাইল রিচার্জ ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় খরচ বেড়ে চলেছে। অথচ রাজ্য সরকার ৪৫০০ টাকায় আশাকর্মীদের বেগার খাটাচ্ছে। ভারত সরকার স্বীকৃত ন্যূনতম মজুরিও তারা দেয় না। অন্যদিকে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মন্ত্রী-আমলারা ট্যাক্সের টাকা খেলা, মেলাতে নষ্ট করছে। রাজ্য সরকার সরকারি অফিসারদের প্রমোদ ভাতা ১৪০০০ টাকা বাড়িয়েছে। অথচ অপুষ্টি, অসুস্থতার শিকার হয়েও যে আশাকর্মীরা ২৪ ঘন্টা স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে চলেছেন তারা আজ ধুঁকছে।
উনবিংশ শতাব্দীর সূচনাপর্ব থেকেই কাজের সময় সীমা কমানোর দাবিতে বিভিন্ন দেশে দেশে আন্দোলন শুরু হয়। মানবসভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসে আট ঘণ্টা কাজের দিনের অধিকার আদায় এবং সেই লড়াইয়ে ‘মে দিবস’–এর ভূমিকা শ্রমিক আন্দোলনের একটি অবিস্মরণীয় মাইলফলক। অত্যাচারিত, শোষিত শ্রমিক মজুরি–দাসত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নতুন জীবন বোধ নিয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সংগ্রামের সূচনা করেছিল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দিনে-রাতে ১৫ থেকে ১৮ ঘন্টা হাড়ভাঙা খাটুনি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অনাহার-অর্ধাহারে অকালমৃত্যুকে সঙ্গী করে চলত শ্রমিকদের জীবন যাপন। ১৮৮৬ সালের পয়লা মে আমেরিকার শিকাগো শহরের শুরু হয়েছিল ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন। স্লোগান উঠেছিল ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘন্টা বিশ্রাম, আর ৮ ঘন্টা সৃজন বিনোদনের অবসর। তদানীন্তন শাসকের অত্যাচারে ও বহু মানুষের কোরবানির বিনিময়ে মে দিবসের ঐতিহাসিক সংগ্রামের ইতিহাস রচিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আবার বহু ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অর্জিত আট ঘণ্টা কাজের অধিকারকে পদদলিত করে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রে কোটি কোটি শ্রমিকের দৈনিক শ্রমের ঘন্টার কোনও হিসেব নেই। মে দিবসের রক্তাক্ত ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, প্রতিটি শ্রম-আইন প্রবর্তনের পেছনে রয়েছে শ্রমজীবী মানুষের আপসহীন সংগ্রামের ইতিহাস। সেই ইতিহাসকেই আজ পাথেয় করে আমাদের এগোতে হবে।