বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১— গ্রামের নাম সংগ্রামপুর, জেলা দক্ষিণ ২৪ পরগণা। ট্রেন লাইনের পাশে গ্রাম। শিয়ালদা থেকে ৪৭ কিলোমিটার। জীবিকার জন্য শহরে যেতে ট্রেনই ভরসা এখানকার মানুষের। ট্রেন না চলায় গ্রামের অধিকাংশ ‘দিন আনা, দিন খাই’ শ্রমজীবী মানুষের রুজি-রোজগার প্রায় বন্ধ।
ফজলুল হক মোল্লা ওস্তাদ কাটার। দক্ষ কারিগর। কাজ করতেন হরলালকায়। দৈনিক মজুরি ছিল ৯০০ টাকা। মাসে রোজগার ছিল ২২ হাজার টাকার বেশি। ওভারটাইম কাজ করলে রোজগার বাড়তো। লকডাউনে কাজ চলে গেছে। প্রথম দু’ মাস কোম্পানী ২০০০ টাকা করে পাঠিয়েছিল। তারপর ওস্তাদ কাটার ফজলুল হক কোম্পানীর হিসাবের খাতা থেকে বাদ। যেমন হয়েছে দেশের বিপুল সংখ্যক অসুরক্ষিত শ্রমিকের ভাগ্যে। দেড় বছর কোনও কাজ নেই প্রৌঢ় ফজলুলের। ট্রেন চলছে না। কাজেও যেতে পারছেন না। ট্রেন চললেও কাজ ফিরে পাবেন তার আশা কম। বড় সংসার— কিভাবে সংসার চলবে, সেই চিন্তায় চিন্তায় রাতের ঘুম চলে গেছে।
মফিজুল মোল্লা। ইনিও কাটার। গ্রামেই যত্ন নিয়ে টেলারিংয়ের কাজ করেন। আশেপাশের মানুষেরা তাঁর কাছে কাজ করাতে আসতেন। ঈদের মতো পরবে ভীড় লেগে যেত। মাসে উপার্জন ছিল ১২ হাজার টাকারও বেশি। লকডাউনে মানুষের হাতে টাকা নেই— সামান্য কয়েক জন একান্ত নিরুপায় হয়ে তাঁর কাছে পোষাক তৈরি করাতে আসেন। এখন আয় মাসে তিন হাজার টাকাও হচ্ছে না। সেই সামান্য টাকায় তেল কিনবেন না ডাল কিনবেন। সংসারে কারও অসুখ-বিসুখ হলে মাথায় হাত।
মফিজুল জানালেন, তাঁরা রেশন পাচ্ছেন। রাজ্যের কার্ডে ৩ কেজি গম, ২ কেজি চাল; আবার কেউ কেন্দ্রের কার্ডে ৪ কেজি চাল, ৩ কেজি গম ও ৩ কেজি আটা। কিন্তু তেল, মসলা, সব্জি, ডাল কেনার টাকা যোগাড় করাই মুস্কিল। কারও কারও স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড আছে। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি না হলে তার সুবিধা পাওয়া যায় না। সাধারণ অসুখ-বিসুখে ওষুধ কেনার টাকার জন্য ধার করতে হয়।
গোলাম রসুল পড়াশোনা করা চৌকশ ছেলে। বেসরকারি এজেন্সির হয়ে ব্যাঙ্ক-বীমা কোম্পানীর ঋণ পরিশোধের কিস্তি সংগ্রহের কাজ করেন। ঝুঁকি নিয়ে স্পেশাল ট্রেনের ভীড় ঠেলে কাজে যান বটে— কিন্তু যাঁরা ঋণ নিয়েছেন তাঁদের অবস্থাও অথৈবচ, ঘুরে বেড়ানোর পরিশ্রমটাই হয়, কিস্তি আর সংগ্রহ হয় না। সুতরাং গোলামের কমিশন বাবদ আয়ও অতি সামান্য।
নিজামুদ্দিন মোল্লা চিটফান্ডের প্রতারণায় সর্বশান্ত হয়ে গত কয়েক বছর সেবি’র সচেতনতার কর্মসূচিতে কাজ করছিলেন কয়েক জন মিলে। পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, জেলা, শহরে চলে যেতেন তাঁরা। সম্পূর্ণ অপরিচিত জনপদে গিয়ে চিটফান্ডের বিরুদ্ধে মানুষকে সজাগ করার কাজ করতেন। দিনে ৫০০ টাকা করে সান্মানিক পেতেন— তার সঙ্গে যাতায়তের ভাড়া, খাওয়া-থাকার খরচ। ১০ দিন কাজ করলে মাসে ৫০০০ টাকা রোজগার। সেই কাজ এখন বন্ধ। বেশ কিছু পাওনা টাকাও বকেয়া আছে। তাঁর প্যাশান হল একটি অখ্যাত শ্রমজীবী ভাষা পত্রিকা মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু লকডাউনে সেই পত্রিকারও ছাপা বন্ধ। সুতরাং ভালবাসার কাজও বন্ধ। হোমিওপ্যাথি জানতেন। রুজির টানে বাড়ি থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে হটুগঞ্জে শুরু করলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা। সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করতেন প্রথম দিকে। দৈনিক যাতায়াতের ধকল শরীরে দেয় না। হটুগঞ্জে আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। সপ্তাহে একদিন ঘরে ফেরেন। কিন্তু চিন্তায় চিন্তায় ঘুম হয় না। হঠাৎ একদিন পড়ে গেলেন, বাঁ দিকটা যেন প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্থ। আত্মীয়-বন্ধুরা নিয়ে গেলেন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এখন বাড়ি ফিরেছেন। বাঁ পায়ে হাটাচলা স্বাভাবিক হয়নি। এই পরিশ্রমী মানুষটি কবে হটুগঞ্জে হোমিওপ্যাথি করতে যেতে পারবেন, সেই নিয়ে জেদ করছেন।
অতিমারি ও লকডাউনের এই পরিস্থিতিতে সংসারের হাল ধরে রাখার জন্য সেরিনা বিবি, সাবিরা বিবিরা অনন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সেরিনা ও সাবিরা আশাকর্মী। তাঁদের উপার্জনই এখন সংসারের বড় ভরসা। তাঁদের সান্মানিক মাসে ৪৫০০ টাকা। এছাড়া গত বছর ও এই বছর ১০০০ টাকা করে কোভিড ভাতা পেয়েছেন ছয় মাস। ঝুঁকি নিয়েই তাঁদের কাজ করতে হচ্ছে। কোভিড পরিস্থিতিতে কাজের চাপ বেড়ে গেছে। টিকাকরণের কাজও সামলাতে হচ্ছে আশাকর্মীদেরই। বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্লিপ বন্টন, টিকার লাইনে ভীড় সামলানো, টিকা দিতে না পারার জন্য মানুষজনের ক্ষোভ শোনা। এছাড়া আশাকর্মীদের নিয়মিত কাজ তো আছেই। গ্রামে ঘুরে ঘুরে প্রসুতি মায়ের খবর নেওয়া, তাঁদের সহযোগিতা ও পরামর্শ দেওয়া। দিনেদুপুরে কিম্বা রাতবিরেতে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আসন্ন প্রসবা মাকে নিয়ে ডেলিভারির জন্য উস্তিতে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া; মায়ের অবস্থা ক্রিটিক্যাল হলে সেখান থেকে ডায়মন্ডহারবারে মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কাজ তাঁদেরই করতে হয়। কিন্তু আশাকর্মীদের সুখ-দুঃখের খবর কে রাখে।
এই অসুরক্ষিত শ্রমজীবীরাই গ্রাম ভারত, এরাই গ্রাম বাংলা। এদের জীবনযুদ্ধ ও অধিকারের কথা কে তুলে ধরবে।