বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন
[রাজ্য]
শ্রমজীবী ভাষা, ১৬ মে, ২০২২— হাফ বেলার কাজ সেরে কাঁধ থেকে বাঁকগুলোকে নামিয়ে পেছনে একটা ইট গুঁজে গাছের ছায়ায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে পুরুষ কর্মীরা। কিছুটা দূরে উঁচু করে সাজানো ইটের পাঁজায় হেলান দিয়ে বসে আছে মহিলারা। পাঁচিল লাগোয়া গাছের ছায়ায় ইটের পাঁজায় কয়েকজন মজুর মা তাদের ধুলো মাখা ছেলেমেয়েদের তদারকি করছে। ইটের গুড়ো আর কয়লার ধুলো, ঘামে ভেজা শরীরগুলো কাদামাখা মনে হচ্ছে। সকাল দশটাতেই যেন আগুনের হলকা বইছে ভাটা চত্বরে। সূর্যের তাপে এবং ভাঁটির গরমে পুরো এলাকাটা ফার্নেসে পরিণত হয়েছে। ক্রাশার মেসিনে গুড়ো হওয়া কয়লার ধুলোয় বাতাস বেশ ভারি। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তাই কাজ শেষে কেউ আবার ভাটা থেকে বেরিয়ে উল্টো দিকের দোকানের সামনে গিয়ে বসেছে। কেউ কেউ দোকান থেকে বিড়ি কিংবা খৈনি কিনে লুঙ্গির খুটে বা হাফ প্যান্টের পকেটে গুজে রাখছে সন্তর্পণে। ইটের গুড়ো আর কাদামাখা শরীর থেকে ঝড়ে পড়ছে অঝোর ধারায় ঘাম। চোখে মুখে ক্লান্তি আর বিষন্নতার ছাপ। কারো কারো চোখ বন্ধ। হয়ত ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রথম বেলার কাজ সেরে কিছুটা জিরিয়ে নিচ্ছে তারা। কেউ কেউ ওভার টাইম করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভোর পাঁচটা থেকে ইট বইবার কাছে লেগেছে এরা। ভাঁটির ভেতর থেকে পোড়ানো ইট বাঁকে করে সাজিয়ে বাইরে এনে সারি সারি গুছিয়ে রাখার কাজ করে পুরুষ কর্মীরা। আর মহিলা কর্মীরা ভ্যানে করে কাঁচা ইট ভাঁটির ভেতরে নিয়ে যায়। কেউ আবার ভ্যান ঠেলার কাজ করে।
ভাটার বাইরের চা-বিড়ির দোকানে দেখা হল বিজয় কর্মকারের সঙ্গে। হাড় ভাঙা খাটুনির পর বিড়িতে সুখটান দিচ্ছে ঘাসের উপর উপুড় বসে। ইছামতীর ঠান্ডা বাতাস ঘামে জ্যাব জ্যাবে শরীরে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে মনে হল।কাজ শেষ হয়ে গেল দাদা? আমার প্রশ্ন শুনে মুখে হালকা হাসি ছড়িয়ে বিজয় বলল, হ্যাঁ, প্রথম বেলার কাজ শেষ হল।এবার ওভার টাইমে ঢুকব।আবার সাড়ে তিনটে থেকে ওই বেলার কাজ শুরু হবে। একবেলায় কত মজুরি পাও তোমরা? আমার প্রশ্ন শুনে এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে সুজয় একটু বিরক্তির সুরে বলল, ইট ভাটায় কোনও মজুরি সিস্টেম নেই। যত খাটবে তত পয়সা। না খাটলে পয়সা নেই। এক হাজার ইট ভাঁটির ভিতর থেকে বাইরে এনে সাজিয়ে রাখলে ১৭৫ টাকা। যাদের গায়ে শক্তি বেশি তারা একবেলায় দু' হাজারের বেশি বইতে পারে।আর যাদের গতরে শক্তি কম তারা এক-দেড় হাজার। ১৮-১৬-১৪ ভাগে কাজ চলে ভাটায়। কেউ বাঁকে একবারে আঠারোটা করে বইতে পারে। যাদের গতরে শক্তি কম তারা ষোলটা অথবা চোদ্দটা করে বইতে পারে। আর কাঁচা ইট এক হাজার বইলে ১৮০ টাকা পাওয়া যায়। মাঠ (যেখানে ইট কাটা হয়) থেকে ভ্যানে করে কাঁচা ইট বয়ে ভাঁটির ভেতরে পৌঁছে দিতে হয়। একবার এক ভ্যানে একশর বেশি কাঁচা ইটি আনা যায় না। ভ্যান ঠেলার কাজটা মেয়েরাই করে। অনেক বাচ্চাকেও ভ্যান ঠেলতে দেখলাম। দু' বেলা খাটলে ৩৭০-৪০০ টাকা রোজগার হয়। যারা ওভার টাইম খাটে তারা আর একটু বেশি পায়। তাও ভোর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত খেটে ৫০০- ৬০০ টাকার বেশি আয় হয় না। একটা ছোট্ট মেয়ে সুজয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাড় জির জিরে অপুষ্ট শরীর। রুগ্ন হাতটা দোকানের দিকে বাড়িয়ে সে বলে, বাবা বিস্কুট কিনে দাও।খিদে পেয়েছে। ততক্ষণে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তার মা। শরীরে তাঁরও অপুষ্টির ছাপ। কোটরগত চোখে উদ্বেগের চিহ্ন। শাড়িটা জীর্ণ হলেও পরিষ্কার। বাবার কাছে চলে আসার জন্য মেয়েকে বকাবকি করেন। হাত ধরে টানতে থাকেন। বিজয় গাঁট থেকে একটা কয়েন বউের হাতে দেয়। মা-মেয়ে দোকানের দিকে পা বাড়ায়।
সুন্দরবনের ঝড়খালির বাসিন্দা বিজয়। বয়স তিরিশ বত্রিশ হবে। বছরের দশেক ভাটায় কাজ করছে। তার একটাই মেয়ে। আদর করে নাম রেখেছে সায়নি। মেয়েকে লেখাপড়া শেখানোর খুব শখ।ভালো করে মানুষ করতে চায় সে। তাই ভাটার বস্তিতে না থেকে বাইরে ঘরে ভাড়া নিয়েছে। মেয়ে বউকে নিয়ে থাকে। বস্তির পরিবেশ তার ভালো লাগে না। ওখানে মেয়েদের মান সম্মান থাকে না। বউকে কাজেও পাঠায় না। শালি ভাটায় কাজ করলেও বউকে সে কাজ করতে দিতে রাজি নয়। মা কাজে গেলে মেয়েকে দেখবে কে। তাই ওভার টাইম করে সে। সারাদিন খাটে।এমন সময় ভাটার ভেতর থেকে ডাক আসে। বিজয় চলে যায়। ভাটার ডাকদিকে পিচের রাস্তা। বামদিকে ইছামতী। রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছে উচ্ছ্বল ইছামতীর আপন বেগে বয়ে চলা। ভরা জোয়ারে টইটুম্বুর নদী। উত্তাল স্রোতে সূর্যের আলো পড়ায় চিকচিক করছে। কেউ যেন গলানো ইস্পাত ঢেলে দিয়েছে নদীর জলে। টুরিস্টের দল ক্যামেরা বন্দি করতে ব্যস্ত ইছামতীর সেই রূপ। মাঝেমাঝে ইঠ ভাঠার চিমনি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া সামনের দৃশ্যপটে কালি লেপে দিয়ে কিছুটা বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
রাস্তার ওপারে ঘাসে ঢাকা সবুজ মাঠ। মাঠের কিনারা ঘেঁসে ছোট ছোট পাকা বাড়ি তৈরি হচ্ছে বসবাসের জন্য। সেখানে আলাপ হল টুটুল, বিজয়, সম্রাটের সঙ্গে। এরাও ভাটা শ্রমিক। ভোর থেকে ভাটায় ইট বইবার কাজ করেছে। ওই বেলায় আবার একই কাজ করবে। এখন ওভার টাইম করছে। ইট বওয়ার কাজই করছে তারা। রাস্তা থেকে বাঁকে করে ইট বয়ে নতুন বাড়ির ভিতের পাশে নিয়ে রাখছে। তবে এটা ভাটা মালিকের কাজ নয়। যিনি এই বাড়ি তৈরি করছেন তার কাজ। এদের বয়স খুব বেশি নয়। আঠারো থেকে আঠাশের মধ্যে হবে। সাত আট বছর ধরে ইট ভাটায় কাজ করছেএরা। ভাটার বস্তিতে থাকে। মজুরি নিয়ে এদের মধ্যে বেজায় অসন্তোষ। মালিকের উপর প্রচন্ড খাপ্পা। কিছুতেই রেট বাড়াতে চায় না মালিক।টাকা বাড়ানোর কথা তুললেই বলে কয়লার দাম প্রচুর বেড়ে গেছে। খরচ অনেক। লোকসানে চলছে ভাটা। বন্ধ করে দেবার ভয় দেখায়। আচ্ছা দাদা, আপনি বলেন, কয়লার দর যখন ছ'শ টাকা কুইন্টল ছেল তখনও বলত লোকসান হচ্ছে, আবার এখন যখন ন'শ টাকা তেখনও বলতেছে লচে চলতেছে। তাইলে ছ’শ টাকা যেখন ছ্যাল তখন তো লাভ হতো। তেখন তো রেট বাড়াইনি। ঝাঁঝাল গলায় এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে টুটুল। গত পাঁচ বছর ধরে ইট বওয়ার মজুরির রেট একই চলছে ভাটায়। হাজার প্রতি একশ পঁচাত্তর টাকা। তাও ইউনিয়নের লাগাতার চাপাচাপির ফলে এইটুকু বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। তার আগে রেট ছিল পঁয়তাল্লিশ টাকা হাজার প্রতি। কাটনি মজুদের রেটটা একটু বেশি। তারা এক হাজার ইট কাটলে পাঁচশ টাকা পায়। ভাটার বস্তিতে বিনা পয়সায় থাকার সুযোগ ছাড়া ভাটা শ্রমিকরা আর কিছু পায় না মালিকের কাছ থেকে। এমন কি কাজ করতে করতে কোনও মজুর অসুস্থ হলেও তার দায় মালিক নেয় না। ডাক্তার ডেকে প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুও করায় না। শরীরে জোর থাকলে কাজ আছে। জোর ফুরলে আবর্জনা ছাড়া কিছুই নয়।তখন না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।
সূর্য তখন মাথার উপর গন গন করে জ্বলছে। আকাশ থেকে যেন আগুন ঝড়ে পড়ছে। এক টিপ খৈনি ঠোঁটের নিজে গুজে দিয়ে সম্রাট বলে আমাদের জীবনটা ইটের মত। মাটির মত নরম ছিলাম। আগুনে পুড়ে শক্ত হয়েছে। এবার একদিন গুড়ো হয়ে যাব।