বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

আজকের আন্দোলনে চেতনার সীমাবদ্ধতা

আজকের আন্দোলনে চেতনার সীমাবদ্ধতা

অরূপ ঘোষ

photo

যে বামপন্থী সংগঠনগুলি ষাটের দশকে খাদ্য আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে মেহনতি মানুষের ঘরের মানুষ হয়ে উঠেছিল, তারা আজ অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। তার কারণ নিহিত হয়ে আছে পুঁজিবাদের পট পরিবর্তনে। আজ ফ্যাসিস্ত দল মানুষকে বিনামূল্যে পাঁচ কেজি আনাজ দিচ্ছে, আর দক্ষিণপন্থী দল বিনামূল্যে দুয়ারে দুয়ারে রেশন পৌঁছে দিচ্ছে। পুঁজিবাদের এই পট পরিবর্তনের সঙ্গে বামপন্থাকেও যে নতুন ভাবে ভাবতে হবে আজ তার অভাব। তাই শুধুমাত্র চুরিকে কেন্দ্র করে দক্ষিণপন্থী পার্টিদের বিরোধিতা মানুষের মনে দাগ কাটতে পারছে না। আসলে যে পুঁজিবাদ প্রতিমুহূর্তে শ্রমিকের উদ্বৃত্ত মূল্য চুরির উপর বেঁচে থাকে, সেই চুরিকে উন্মোচন না করে শুধুমাত্র চুরির দোহাই দিয়ে চুরিহীন বিকল্প পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গঠন, মানুষের কাছে কি গ্রহণযোগ্যতা পায়? তাই পুঁজিবাদে শ্রম চুরির সঙ্গে প্রকৃতি চুরির আসল রহস্য উন্মোচন করার মধ্য দিয়েই, শ্রমিক কৃষকের প্রচেষ্টায় একটি প্রকৃতিকেন্দ্রিক সংহত অর্থনীতি গড়ে তোলা যায়, সেটা বিচার্য বিষয় না হয়ে, চুরিহীন বিকল্প পুঁজিবাদের মধ্যে মানুষ বিকল্প খুঁজে পাবে কী করে?

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রম ও প্রকৃতি চুরি সাধারণ চোখে দেখা যায় না কেন

পুঁজিবাদে পুঁজির একটি সঞ্চলন আছে, যে সঞ্চলনে শ্রম ও প্রকৃতির বিষয়টি চাপা পড়ে থাকে। পণ্য, অর্থ, পুঁজির সঞ্চলনের গতি সর্বত্র বিরাজ করে এমনভাবে, যে এই তিনটি ছাড়া সমাজ বা মনুষ্য জীবন চলা সম্ভব নয় বলে মনে হয়। পুঁজিবাদ হচ্ছে অর্থকে ক্রমহারে বর্ধিত করার ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানার বিস্তার ঘটে শুধুমাত্র পৃথিবীর কয়েকজন ধনশীল মানুষের। এই ব্যবস্থায় শ্রম ও প্রকৃতির অপরিহার্যতা সহজে ধরা পড়ে না। মানুষ তার প্রয়োজন মেটায় প্রকৃতির সঙ্গে শ্রম করে উৎপাদনের মাধ্যমে। এখানে শ্রম ও প্রকৃতি উভয়েই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু আমাদের মনুষ্য জাতির মনে হয় শ্রম সচল, প্রকৃতি নিষ্ক্রিয়। তখন আমরা ভুলে যাই সালোকসংশ্লেষ ছাড়া গাছের বৃদ্ধি হয় না। সালোকসংশ্লেষই আবার আমাদের রেচনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলিকে গ্রহণ করে আমাদের জন্য উৎপাদন করে মুখের আহার। এই আহার গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়, তার থেকে শক্তি বের করতে গেলে যে অক্সিজেন দরকার হয়, তা গাছ সরবরাহ করে, আমাদের তৈরি করা কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে শোষণ করে। মানুষ ও প্রকৃতির এই বিপাকীয় প্রক্রিয়াই হচ্ছে মনুষ্যজাতির বেঁচে থাকার শর্ত। কিন্তু পুঁজিবাদে অর্থের বৃদ্ধি ও তজ্জনিত প্রবাহকে সচল রাখার জন্য রাস্তাঘাট, যানবাহন, এমনকি তথ্যের প্রবাহের গতিকেই উন্নয়ন বলা হয়। পুঁজিবাদী উন্নয়নের এই বিপাকীয় ব্যবস্থা কৃত্রিম এবং প্রকৃতির বিপাকীয় ব্যবস্থার বিপরীত। কিন্তু একটি অন্যটির উপর নির্ভরশীল হলেও এখানে একটি ব্যবস্থা পুরোপুরি স্বতন্ত্র। পুঁজির বিপাকীয় ব্যবস্থা মানুষ ও প্রকৃতির বিপাকীয় ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু মানুষ ও প্রকৃতির বিপাকীয় ব্যবস্থা স্বতন্ত্র। শুধু তাই নয়, মানুষকে এই প্রাকৃতিক বিপাকীয় ব্যবস্থাকে সঠিক রেখেই বেঁচে থাকতে হয়। অথচ পুঁজিবাদী বিপাকীয় ব্যবস্থা এই প্রাকৃতিক বিপাকীয় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে।

পুঁজিবাদী বিপাকীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ভূমিকা

পুঁজিবাদে প্রত্যেকটি মানুষই তার অর্থকে উচ্চ হারে বর্ধিত করতে চায়। তার টাকাকে ব্যাঙ্কে রেখে হোক, শেয়ার বাজারে খাটিয়ে হোক বা ব্যবসা করে হোক। একমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর শ্রম বেচা ছাড়া আর কিছু থাকে না। আর এই শ্রম কেনা বেচার মধ্যেই অর্থের বৃদ্ধির রহস্যটি লুকিয়ে আছে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিক যে পণ্যটি বেচে তার নাম হচ্ছে শ্রম, শ্রমিক শ্রেণী ৮ ঘণ্টার জন্য তার শ্রম বেচলেও সে যে মূল্য ফেরত পায় সেটা তার শ্রমশক্তির অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। ধরা যাক শ্রমিক মজুরি হিসেবে পাচ্ছে তার দেওয়া শ্রমশক্তির মাত্র এক ঘণ্টার মূল্য। বাকি সাত ঘণ্টার না ফেরত পাওয়া শ্রমিকের শ্রমই উদ্বৃত্ত মূল্য বা মুনাফা রূপে মালিকের সম্পদ বৃদ্ধি ঘটায়। তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমমূল্যে বাজারে অন্যান্য পণ্য বিক্রয় হলেও শ্রম নামক পণ্যটি সমমূল্যে বিক্রি হয় না। আর এই অসম লেনদেনকে চাপিয়ে রাখতে গেলে শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করতে হয় রাষ্ট্রকে। আর উৎপাদনের মধ্যে শ্রমকে জোগান দেওয়ার জন্য যে কাঁচামালের দরকার হয় তা প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করতে হয়। পুঁজির মালিকরা যাতে সস্তায় বা প্রায় বিনামূল্যে এই কাঁচামাল পেয়ে যায় সেই দিকেও নজর রাখতে হয় রাষ্ট্রকে। তা না হলে পুঁজির যে বিপাকীয় চক্র অর্থাৎ শ্রম ও প্রকৃতিকে শোষণ করে মুনাফা বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে চলা ঘটবে না।

পুঁজির এই বিপাকীয় সমস্যা আজ দেখা যাচ্ছে কেন?

আজ পুঁজি বাড়াতে গিয়ে শ্রম ও প্রকৃতির বিপাকীয় সম্পর্ক ভারসাম্য হারাচ্ছে। এই সমস্যা ৯০-এর দশকের পর থেকে দ্রুতবৃদ্ধি পাচ্ছে। তার কারণ নয়া অর্থনীতি এমনই এক অক্ষের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেখানে বাজারই হচ্ছে সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। ফলে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে বাজারকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজিবাদের উপর একটি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল এখন পুঁজিবাদের উপরে কোনও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেই। এর ফলে এখন যেটা হয়েছে — আগে ফাটকা (স্পেকুলেটিভ) পুঁজি উৎপাদনশীল পুঁজির অধীনে ছিল, এখন বাজারের কারণে ফাটকা পুঁজি প্রধান জায়গায় চলে গেছে। অর্থাৎ তার অধীনেই উৎপাদনশীল পুঁজি চলে গেছে।

ফাটকা পুঁজি ও তার বাজার

শেয়ার, বন্ড, ডেরিভেটিভ, এগুলি হচ্ছে ফাটকা পুঁজি, আর এদের কেনাকাটা যে বাজারে হয়ে থাকে তাকে ফাটকা পুঁজির বাজার বলে। আগে শেয়ার-এর বিপরীতে কোম্পানির সম্পত্তির একটি মালিকানা ছিল, সেটা কত বাড়তে পারে তার উপরে মানুষ ফাটকা খেলত। যেমন টাটা মোটরের শেয়ার ইত্যাদি। কিন্তু ডেরিভেটিভ হচ্ছে খনিজ তেলের দাম আগামী মাসের কুড়ি তারিখে কত হতে পারে তার উপরে অনুমান করা, পুরোপুরি ফাটকা খেলা। এই ডেরিভেটিভ হচ্ছে আজ প্রধান ভূমিকায়। আর লভ্যাংশের মূল জায়গাটা এই বাজারে দিয়ে দিতে হলে, শ্রমিক ও প্রকৃতির শোষণকে চূড়ান্ত মাত্রায় তুলতে হবে। এই কারণেই বড় বড় কারখানার কাজকে আউটসোর্স করে দেওয়া হয়েছে সেই সব স্থানে যেখানে শ্রমিকের মজুরি খুবই কম এবং দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করানো হয়, কোনও শ্রম আইন নেই। এই কারণেই আমাদের দেশের সরকার শ্রম আইনটাকেই তুলে দিতে চাইছে, তার জায়গায় প্রায় দাস যুগের শ্রম আইন আনা হচ্ছে। ফলে সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর যে ক্ষমতা ছিল শিল্পকে ঘিরে তাকে একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়েছে। পাশাপাশি মানুষকে বেনাগরিক করে জমির উপর মানুষের যে ব্যক্তি
মালিকানার অধিকার থাকে তা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এই কারণেই ছত্রিশগড়ে মাওবাদী দাগিয়ে আদিবাসীদের জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। যত বেশি সস্তা শ্রম ও সস্তা কাঁচামাল পাওয়া যাবে তত বেশি শেয়ার বাজার ও ফাটকা বাজারে সুবিধা পাওয়া যাবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আদানিদের একদিকে ফাটকা পুঁজির জাল বিস্তার করতে সরকার সাহায্য করেছে। আর তাকে দেখিয়ে এলআইসি ও এসবিআই থেকে টাকা তুলে নিয়েছে, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টে যা পরিষ্কারভাবে সামনে চলে এসেছে। আর এই অর্থ দিয়েই সে সরকারি বন্দর, এয়ারপোর্ট, খনি জলের দরে কিনে নিচ্ছে বা কখনও অর্থ ছাড়াই মালিকানা হস্তান্তর করে নিচ্ছে। আর এই ফাটকাকে সুবিধে দিতে গিয়ে বিশ্বব্যাপী জঙ্গল নিধন হচ্ছে মারাত্মকভাবে। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মধ্যে ধরে না রাখতে পারলে পৃথিবীর তাপমাত্রা চক্রাবর্তে বেড়ে যাবে। তাই শ্রম শোষণ ও প্রকৃতি শোষণ এই দুইয়ের বিরুদ্ধে প্রকৃতি কেন্দ্রিক শ্রমিক কৃষকের সংহতি মূলক অর্থনীতি গঠন করে আজ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুলতে হবে।
আজ প্রকৃতি কেন্দ্রিক শ্রমিক কৃষকের সংহতি মূলক অর্থনীতি কোনও মস্তিষ্কপ্রসূত কথা নয়। খোদ আমেরিকার বুকে কোভিডের সময় এবং এআই প্রবর্তনের ফলে কাজহারা শ্রমিকের দল মিসিসিপি উপত্যকায় কৃষকদের সঙ্গে দল বেঁধে প্রকৃতিকেন্দ্রিক সংহতি অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। মেক্সিকোর চিয়াপাস অঞ্চলে একই ভাবে শ্রমিক কৃষকরাও প্রকৃতিকেন্দ্রিক অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। বলিভিয়ায় দেখা যাচ্ছে একই রকম তৎপরতা, লাতিন আমেরিকার জুড়েই কর্পোরেটদের বিরুদ্ধে শ্রমিক কৃষকরা এইরূপ অর্থনীতি গড়ে তুলছে। তাই শ্রমিক কৃষকের এই সংহতি মূলক কর্মপদ্ধতির থেকে শিক্ষা নিয়ে আজ আমাদের বামপন্থীদের এগিয়ে যাবার রাস্তা বার করতে হবে।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.