বামপন্থা ও গণতন্ত্রের কথোপকথন

[রাজ্য]

[রাজ্য]

১০ মার্চ ধর্মঘট ও তার সামাজিক প্রভাব

১০ মার্চ ধর্মঘট ও তার সামাজিক প্রভাব

অর্জুন সেনগুপ্ত

photo

একটি ধর্মঘটের পর্যালোচনা শুধুমাত্র তাতে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা দ্বারা বিচার্য হয় না, বিশ্লেষণের আওতায় আনতে হয় তার সামাজিক প্রভাবও। ১০ মার্চ সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, ডাক্তার, নার্স, আদালত কর্মচারী, আধা সরকারি কর্মচারীদের সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের ডাকা ধর্মঘটে বিপুল সংখ্যক কর্মচারী অংশগ্রহণ করেছে। সরকার হুমকি দিয়েছে, আদেশনামা দিয়েছে, সারাদিন হাজিরার সুযোগ দিয়েছে, তাও কর্মচারীদের ধর্মঘট থেকে নিবৃত করতে পারেনি। এই ব্যাপক অংশগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মঘটের সামাজিক প্রভাব নিয়েও আমাদের আলোচনা প্রয়োজন ভবিষ্যৎ কর্মসূচির স্বার্থে। যেসব সংবাদপত্র বাংলায় পশ্চাতপদতা ঠেকানোর ঠিকেদারি নিয়েছে, যারা ইতিপূর্বে সংগঠিত প্রায় প্রতিটি ধর্মঘটের অসফলতার বার্তা বহন করেছে, তারাও বাধ্য হয়েছে ১০ মার্চের ধর্মঘটের সফলতার বিবরণ দিতে। অন্যান্য সংবাদমাধ্যম, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে এই বার্তাই পৌঁছেছে জনমানসে। কেন? তবে কি তৃণমূল সরকার শাসক শ্রেণীর আস্থা হারাচ্ছে? হতে পারে। কিন্তু শুধু সরকারের হালচাল দিয়ে সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের আন্দোলন পরিচালনার মুন্সিয়ানাও এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য ।
মঞ্চ প্রথম দিন থেকেই সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে তার নিরপেক্ষতা ঘোষণা করেছে। একমাত্র সরকার ছাড়া কোনও শাসকদলের বিরুদ্ধেও প্রচার করা হয়নি। সরকার গড়া, ফেলাও যে এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য নয় তা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে। মঞ্চের একমাত্র উদ্দেশ্য যে দাবি আদায় তা সরকার ও কিছু অতি বিপ্লবী রাজনৈতিক পক্ষের অপপ্রচার সত্ত্বেও জনমানসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে কর্মচারী শিক্ষক ও ব্যাপক জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে ও মঞ্চ একটি সফল কর্মচারী ধর্মঘট উপহার দিতে সমর্থ হয়েছে।
কিছু বন্ধু গণ আন্দোলনের এই আবশ্যিক চরিত্র সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল না হয়ে মঞ্চকে এর তার রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক বলে গাল পাড়ছেন। আসলে কিছু বাঁধাধরা রাজনৈতিক বুলি কপচিয়ে অবস্থানগত সঠিকতা অর্জন করা যায় কিন্তু গণ আন্দোলন বা ধর্মঘট পরিচালনা করা যায় না।
মঞ্চ তার একবছর চলার মধ্য দিয়ে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা শ্রমিক শ্রেণীকে দিতে সক্ষম হয়েছে। কর্মচারীদের দবিকে পেশার গণ্ডি অতিক্রম করিয়ে শ্রেণীর দাবিতে প্রসারিত করেছে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক দাবিকে রাজনৈতিক দাবিতে পর্যবসিত করেছে। ধরুন বহু আলোচিত ও এক পক্ষ দ্বারা ধিকৃত মহার্ঘভাতার দাবি। বলা হয়েছে, সরকার আদর্শ নিয়োগকর্তা। সরকারই শ্রমিকের মজুরি সংক্রান্ত আইনের নিয়ন্ত্রক। সে যদি নিজের কর্মচারীদের মজুরি বঞ্চনায় (ডিএ বেতনের অবিচ্ছেদ্য অংশ) সফল হয় তবে বেসরকারি মালিকদের কাছেও একটি বার্তা পৌঁছে যায়। শ্রম আইন প্রণেতা, আদর্শ নিয়োগকর্তাই যদি তার কর্মচারীকে মহার্ঘভাতা না দিয়ে পার পেয়ে যায় তবে বেসরকারি মালিকেরা হাতে মাথা কাটবে শ্রমিকের। অর্থাৎ এই দাবিটি আদায় করার দায়ভার আর শুধু সরকারি কর্মচারীর রইল না, দাবিটি হয়ে উঠলো সমগ্র শ্রেণীর। ধর্মঘটেও তার প্রভাব পড়লো। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষও তাদের এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করলো দাবিটিকে। উৎসাহ পেল কর্মচারী ধর্মঘটকে সফল করতে। সবকটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন বাড়িয়ে দিল সংহতির হাত। বিভিন্ন কারখানার ইউনিয়ন মঞ্চে এসে সমর্থন জানালো আন্দোলনকে।
দ্বিতীয় দাবিটি তো সরাসরি শ্রেণীর দাবি। আবার পেশার গুরুত্বপূর্ণ দাবিও বটে। সব মিলিয়ে সরকারি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় ছয় লক্ষ পদ খালি। নিয়োগ প্রায় বন্ধ। স্বাভাবিক ভাবেই কাজের বোঝা বেড়েছে অসম্ভব। তার উপরে সংখ্যাল্পতার কারণে কর্মচারীদের সরকারি আক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষমতাও কমছে। তাই স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগের দাবি আজ পেশার স্বার্থেই উত্থাপিত। আবার বেকার যুবক, যুবতীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রশ্নে তা সমগ্র শ্রমজীবী জনতারও দাবি হয়ে উঠেছে ও সমর্থন আদায় করে নিয়েছে।
তৃতীয় দাবিটি অনিয়মিত কর্মীদের নিয়মিতকরণের ও ঠিকা প্রথা বিলোপের। স্থায়ী কর্মচারীদের সঙ্গে চুক্তি ভিত্তিক কর্মীদের একটা বিরোধ লেগেই থাকে। তাতে উভয়ই দায়ী। স্থায়ীদের উঁচু নাক আর অস্থায়ীদের শাসক যোগ। উভয় পক্ষই উপলব্ধি করেছে এই অন্তর্কলহে ক্ষতি উভয়েরই। কেউই অর্জন করতে পারবে না নিজস্ব দাবি আর সরকারের পোয়া বারো।
ধর্মঘটের অব্যবহিত পরেই শাসক স্বমূর্তি ধারণ করেছে। শিক্ষক ও কর্মচারীদের আক্রমণ করছে। মঞ্চও তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। জেলায় জেলায় নেতৃত্ব খবর পেয়েই ছুটে গেছেন আক্রান্তের পাশে। আইনি সহায়তায়ও দেওয়া হয়েছে। দুষ্কৃতকারীদের পরিচয় জেনে নিয়ে পাল্টা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে প্রস্তুত মঞ্চ।
কর্মচারী, শিক্ষক, সাধারণ মানুষের সহায়তায় কর্মচারীরা আর রক্ষণাত্মক নন। ১৮ মার্চ থেকে ডাক দেওয়া হয়েছে ডিজিটাল স্ট্রাইকের। অর্থাৎ কর্মচারী, শিক্ষক নিজেদের গ্যাটের পয়সায় কেনা ও রিচার্য করা মোবাইল, কম্পিউটার ব্যবহার করবে না সরকারি কাজে। কাজের ঘন্টার বাইরে পালন করবে না কোনও সরকারি নির্দেশ যা আসে বৈদ্যুতিন যন্ত্র বাহিত হয়ে। ১৭ মার্চ জেলায় জেলায় হবে বিক্ষোভ মিছিল। প্রস্তুতি গড়া হচ্ছে লাগাতার ধর্মঘটের। কর্মচারীদের অবস্থান চলছে টানা ৪৭ দিন আর অনশন ৩১ দিন। ফেসবুক বিপ্লবীদের মতো ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছে না কর্মচারীরা। ঘুমন্ত দৈত্য জেগে উঠেছে। ডাক দিচ্ছে শ্রেণী ভাইদের।

Copyright © 2021 - 2022 Shramajeebee Bhasha. All Rights Reserved.